|
কলাবাগান ১৮৮০ |
সমকালীন ইতিহাসগ্রন্থ না থাকায় ইতিহাস পুনর্গঠনে আকর সূত্র হিসেবে প্রতœসূত্র অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করতে হয়। এ পথ ধরে ঢাকা নামের উৎস সন্ধান করা যেতে পারে। প্রাচীন ভারতে গুপ্ত বংশের রাজা সমুদ্রগুপ্তের সময়ের (৩৩০-৩৮০ খ্রি.) একটি স্তম্ভ পাওয়া যায় এলাহাবাদে। স্তম্ভের গায়ে রাজপ্রশস্তি লেখা ছিল। এ স্তম্ভলিপিটি ইতিহাসে এলাহাবাদ প্রশস্তি নামে পরিচিত। প্রশস্তির লিপিমালার এক জায়গায় প্রথমবারের মতো ‘ডবাক’ নামটি পাওয়া যায়। এখান থেকে জানা যায় সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বের একটি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নাম ডবাক। প্রশস্তিতে এমন কয়েকটি রাজ্যের নাম লেখা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে সমতট, ডবাক, কামরূপ ইত্যাদি। প্রাচীন জনপদ হিসেবে সমতট ও কামরূপের অবস্থান স্পষ্ট। বর্তমান কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে ছিল সমতট জনপদ। কামরূপের অবস্থান ছিল আসামে। ডবাক নামটি পরবর্তীকালে উচ্চারিত ঢাকা নামের সঙ্গে মিল থাকায় অনেক পণ্ডিত মনে করেছেন এই ঢাকারই আদি নাম ডবাক। সিদ্ধান্তটির পেছনে কিছু যুক্তিও রয়েছে। বর্তমান ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে সাভার উপজেলার অবস্থান। প্রাচীনকালে সাভারে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক সূত্রে বলা হয় ৭ ও ৮ শতকে ‘সম্ভার’ নামে এক রাজ্য ছিল (ঢাকার ইতিহাস, যতীন্দ্র মোহন রায়)। সম্ভার রাজ্যের রাজধানীর নাম ডবাক। পাল শাসনামলে সাভার ছিল গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ বসতি। সম্ভার রাজ্যের রাজার নাম ছিল হরিশচন্দ্র। যদিও রাজা হরিশচন্দ্রের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গত দেড় দশক আগে প্রতœতাত্ত্বিক খননে সাভার বাসস্ট্যান্ডের সামান্য পূর্ব দিকে একটি প্রাচীন স্থাপনার অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। যা স্থানীয়ভাবে হরিশচন্দ্র রাজার বাড়ি নামে পরিচিত। অনুমান করা হয়, সম্ভার রাজ্য আজকের ঢাকা শহর অঞ্চলেও সম্প্রসারিত ছিল। ৭ ও ৮ শতকের সমৃদ্ধ জনপদ সাভারের দক্ষিণ সীমানায় বর্তমান ঢাকা অঞ্চলে আরও প্রাচীন জনপদের অস্তিত্ব থাকতে পারে বলে প্রতœসূত্র ইঙ্গিত করছে। সেই সূত্রে সমতটের উত্তরে এবং বর্তমান সাভারের দক্ষিণে এ অঞ্চলটি সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চল ডবাক হওয়া সম্ভব। ডবাক নামের সঙ্গে ঢাকা শব্দের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ডবাক যুগ পরম্পরায় মানুষের মুখে উচ্চারণ বিকৃতি ঘটে এক সময় ঢাকায় রূপান্তরিত হতে পারে। যদি এ সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা যায় তবে ৪-৫ শতকেই ডবাক নামের অন্তরালে ঢাকাকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
|
রমনা চত্তর ১৯০১ |
এর অনেক কাল পর সুলতানি আমলের একটি শিলালিপিতে আরও স্পষ্টভাবে ঢাকা নামটি পাওয়া যায়। একই সঙ্গে এ নামটির পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে ধারণা করা যেতে পারে ‘ঢাকা’ নামটি এ অঞ্চলের একটি মৌলিক নাম। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কারণে নির্দিষ্ট কালপরিসরে অঞ্চলটির নতুন নামকরণ হয়েছে। আবার এক পর্যায়ে আদি ঢাকা নামটি ফিরে এসেছে। এ সূত্রে বলা যায় ঢাকা নামটি সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তিতে উচ্চারণ বিভ্রাটের কারণে ডবাক হতে পারে। সুলতানি আমলে উল্লিখিত শিলালিপিটি ভারতের বীরভূমে পাওয়া যায়। মসজিদের গায়ে সাঁটা এ শিলালিপির উৎকীর্ণের তারিখ ৮৬৪ হিজরি অর্থাৎ ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ। এ সময়ে বাংলার সুলতান ছিলেন রুকনউদ্দিন বারবক শাহ। শিলালিপিতে মসজিদ নির্মাতার নাম লেখা হয়েছে ‘তারবিয়াত খানের পুত্র উলুঘ আজালকা খান। তাকে পরিচিত করান হয়েছে ‘শহর ঢাকা’র প্রধান গুমস্তাহ হিসেবে (Abdul Karim, Corpus of Arabic and Persian Inscriptions of Bengal, Dhaka, Asiatic Society of Bangladesh, 1992.p. 151)। সে যুগে খাজনা আদায়কারী কর্মকর্তার উপাধি ছিল গুমস্তাহ। বারবক শাহের পিতা সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের সময় ঢাকা সোনারগাঁওয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল বা ইকলিমের রাজধানী ছিল। এ কারণে ঢাকা শহরের একজন প্রধান গুমস্তাহর পক্ষে বাংলা রাজ্যেরই অংশ বীরভূমে মসজিদ নির্মাণ করে দেয়াটা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক ছিল না। শিলালিপিতে আজলকা খানকে স্পষ্টতই ‘কসবা দাখা (ঢাকা) খাস’ অর্থাৎ দুর্গ দেয়াল বিহীন গুরুত্বপূর্ণ শহর ঢাকা বলা হয়েছে।
-
ড. একেএম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment