দেখে এসে লিখেছেন _এস এম নাজমুল হক ইমন
সারি সারি ঘর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ি। দূর থেকে মনে হচ্ছে একটি দুর্গ আবার কখনো মনে হচ্ছে একটি একটানা ঘরের স্কুল। বাড়ির সামনেই একটি বিশাল পুকুর খনন করা। আমরা এগোতে লাগলাম বিশালাকার বাড়ির দিকে। পুকুর পেরিয়ে বাড়ির সামনে যেতেই আরও অবাক করা বিষয়, বাড়িতে প্রবেশের জন্য অনেক দরজা।
নওগাঁ জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মহাদেবপুর উপজেলা আর সেই মহাদেবপুর উপজেলা থেকে আরও ১৩ কিলোমিটার ভেতরে আলীপুর গ্রাম। এ গ্রামেই এই বিশালাকার বাড়িটি। ২৭-২৮ বছর আগেকার কথা। দুই সহোদর সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের উদ্দীন মণ্ডল বাড়িটি তৈরির উদ্যোগ নেন। অবশ্য একমাত্র বোন মাজেদাও তাদের সঙ্গে ছিলেন বাড়িটি নির্মাণের সময়। দুই সহোদর পেশায় কৃষক হলেও তাদের শখ নিতান্ত কম ছিল না। শখের বসেই তারা অনায়াসে প্রতিদিন ১০০ শ্রমিক কাজে লাগিয়ে প্রায় ৬-৭ মাস ধরে কাজ করে নির্মাণ করেন এ বাড়িটি। বাড়ি নির্মাণ শ্রমিকদের খাবারের জন্য প্রতিদিন ৩ মণ চালের ভাত লাগত। বাড়িটি ইট, কাঠ পাথরের তৈরি না হলেও পুরো বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে এঁটেল মাটি দিয়ে। এঁটেল মাটি টেকসই এবং নিজেদের এলাকার মাটি তুলনামূলক ভালো হওয়ার কারণে নিজেদের তৈরি বাড়ি পাশে বিশাল একটি পুকুর খনন করে তা থেকে মাটি তুলেই এ বাড়িটি নির্মাণ করেন কৃষক দুই সহোদর। বাড়িটির ছাউনিতে টিন লেগেছে প্রায় ২০০ বান্ডিল। ১৫০ হাত লম্বা এ বিশাল বাড়িটি দোতলা। তবে ঘরের সংখ্যা কিন্তু চমকে দেওয়ার মতো। ঘরের সংখ্যা ১০৮টি। ঘরগুলো মোটেও ছোট ছোট নয়, তবে বাড়িটির আরও মজার ব্যাপার হলো প্রত্যেক ঘরে জানালার সংখ্যা ৩টি করে আর দরজা ১টি করে। তবে অনেক ঘরে ৪/৫টিও দরজা আছে। সেই হিসেবে এ বিশালাকার বাড়িটির জানালা-দরজার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। আমাদের মাসুদ রানা বলেন, কোনোদিন আমরা জানালা আর দরজা গুনে দেখিনি কারণ হিসাব মেলানো বড় কঠিন আর হিসাব করতে করতে অনেক সময় ভুলেও যেতে হয়, ঘরগুলো ঘুরানো-প্যাঁচানো বলে এক পথ দিয়ে গুনে আসতে আবার অন্য পথে যেতেই হিসাব ভুল হয়ে যায়। তাই কখনো হিসাব করা হয়নি। আরও একটি মজার ব্যাপার, বাড়ির সদর দরজা হলো ১১টি। এ ১১ দরজার যে কোনো দরজা দিয়ে ঢুকলেই বাড়ির ভেতরে যাওয়া যায়।
বিশালাকার বাড়িটি রাজ বা জমিদার বাড়ি না হলেও কোনোটি থেকে কমতি নেই। ২ বিঘা জায়গাজুড়ে নির্মিত এ বাড়ি। বাড়ির দেয়াল অনেকটা মাটি দিয়ে প্লাস্টার করার মতো। আর বিশালাকার মাটির তৈরি বাড়ির বারান্দার খুঁটিগুলো ইটের। দোতলার পাটাতন তৈরি করা হয়েছে তালগাছ চিরে এবং বেশ মোটা বাঁশ দিয়ে। আর এ তালগাছের তক্তা এবং বাঁশের ওপর মাটি দিয়ে এমন করে লেপে দেওয়া হয়েছে যে, দেখে যেন মনে হয় প্লাস্টার করা। ২৭/২৮ বছর আগের পাটাতন, তার ওপর মাটি লেপে দেওয়া যা এখন অবিকৃতই রয়েছে। আর দোতলার বারান্দায় যে রেলিং রয়েছে তা সুন্দর করে নানা ডিজাইনের নকশি করা। বাড়িটির ১০৮ ঘরের হলেও সব ঘর ব্যবহার হয় না। তবে অধিকাংশ ঘরই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বিশালাকার ১০৮ ঘরের এ বাড়িটিতে সমশের মণ্ডল, তাহের মণ্ডল ও বোন মাজেদা খাতুনের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিই বর্তমানে থাকেন। সব মিলিয়ে এ বাড়িতে বসবাসরত সদস্য সংখ্যা ৩৫ জন। তারা ব্যবহার করেন মাত্র ২২/২৩টি ঘর। আমাদের দেশে অনেকেরই ঘর নেই, বাড়ি নেই। কেউ ঘুমায় গাছতলায় আবার কেউ শখে তৈরি করে গণ্ডা গণ্ডা ঘরের বিশালাকার বাড়ি। ১০৮ ঘরের বাড়ি তেমনই এক উদাহরণ। ২০০৪ সালের প্রথমদিকে সমশের আলী মণ্ডল মারা গেছেন। তার ছোট ভাই তাহের উদ্দীন মণ্ডল বেঁচে আছেন তবে আমাদের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। তিনি ব্যক্তিগত কাজে বাড়ির বাইরে ছিলেন। আমরা কথা বলেছি সমশের আলীর স্ত্রী বিউটি বেগমের সঙ্গে। প্রায় ৭৩ বছরের বৃদ্ধা বিউটি খাতুন আমাদের শোনাল এ বাড়িটির সঙ্গে তাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আর এ বাড়িটি নির্মাণ করতে ৬/৭ মাস সময় লেগেছে। টাকা-পয়সাও লেগেছে প্রচুর। শখের বশেই মূলত এ বাড়িটি করেছে তার স্বামী ও দেবর। তবে বিশালাকার বাড়িটি আগে ফাঁকা ফাঁকা না লাগলেও বর্তমানে তার স্বামী না থাকায় এখন অনেকটা ফাঁকা ফাঁকাই লাগে। ঘরগুলো ফাঁকা থাকলেও সব ঘরই পরিষ্কার করা হয় আর কিছু কিছু ঘরে ধান বা চিতান রেখে ঘরগুলো ব্যবহার করা হয়।
0 comments:
Post a Comment