Wednesday, May 5, 2010

তালাকের শীর্ষে প্রেমের বিয়ে

0 comments
আব্দুল আলীম : প্রতিদিন ঢাকা সিটি করপোরেশনে যে হারে বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ জমা পড়ছে তাতে করে আগামীতে হয়তো আর কোনো কবি লিখবেন না, ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’, হয়তো কোনো শিল্পী গাইবেন না ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না’ অথবা কোনো শাহজাহান আর তাজমহল গড়ার স্বপ্ন দেখবেন না। কারণ প্রতিদিন যে পরিমাণে বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ জমা পড়ছে সিটি করপোরেশনে এর প্রায় ৮০ ভাগই প্রেমের বিয়ে। আরো জানা গেছে, এই বিচ্ছেদ চাওয়া দম্পতিদের বৈবাহিক জীবন বেশিরভাগই ১ দিন থেকে শুরু করে দুই বছরের মধ্যে। আর ২ থেকে ৩ বছর বয়সী বিয়ের সম্পর্ক এর পরেই রয়েছে। তবে ৪০/৪৫ বছরের দাম্পত্য সম্পর্কও যে বিচ্ছেদের নোটিশে জমা পড়ছে না এমন নয়। এই নোটিশগুলো যিনি গ্রহণ করেন সিটি করপোরেশনের সেই কর্মচারী রফিক মিয়া জানালেন- নোটিশ দেয়া বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে খুবই তরুণ। এদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। রফিকের ভাষ্যমতে, গত ২ বছরে আমি দেখছি ছেলেদের চাইতে মেয়েরাই বেশি পরিমাণ তালাকের নোটিশ দিচ্ছে। এবং যে সব ক্ষেত্রে মেয়েরা তালাকের নোটিশ দেয় সে সব ক্ষেত্রে প্রায় ৯০ ভাগ প্রেমের বিয়ে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ঢাকা বারের এডভোকেট পারভিন নাজিয়ার সঙ্গে। তার মক্কেল রাসেলের সঙ্গে মাসুমা আক্তারের প্রণয়ের পর গত নভেম্বরে তাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের একমাস পরই মাসুমা বাপের বাড়ি চলে যায় এবং এরপর অন্য একটি ছেলের সঙ্গে তার মন দেয়া-নেয়া শুরু হয়। বিয়ের ৩ মাসের মাথায় সে রাসেলকে জানিয়ে দেয় রাসেল যদি তাকে তালাক না দেয় তবে মাসুমাই তাকে তালাক দেবে। ৫ মাস পর মাসুমা সিটি করপোরেশনে তালাকের নোটিশ দেয়। আগেই অন্য ছেলেকে বিয়েও করে ফেলেছে সে। ফলে রাসেল আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। হাইকোর্টের এডভোকেট মাহাবুবুল ইসলাম জানালেন তার একটি চলমান মামলার কথা। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ধনীর দুলালি সেলিনা আহমেদের সঙ্গে ৪ বছর প্রেমের পর ছেলেমেয়ের দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছিল ফরিদ হোসেনের। কিন্তু বিয়ের ১ বছর ৯ মাসের মাথায় সেলিনা ডিভোর্সের নোটিশ পাঠায় সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে। ফরিদ হোসেনের বাড়িধারার বাড়িতে যেদিন নোটিশ পৌঁছে সেদিন কয়েকবার তার মক্কেল ফরিদ হোসেন জ্ঞান হারায় বলে জানান তিনি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাদের বিয়ে টিকেনি। এইভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে যেমন ডিভোর্সের নোটিশ জমা পড়ছে তেমনি কোনো না কোনো অজুহাতে ছেলেরাও ডিভোর্সের নোটিশ দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিয়ের ৪/৫ বছর পরে যে সব ডিভোর্সের নোটিশ আসছে তার মধ্যে ছেলেরা বেশি ডিভোর্স দিচ্ছে। যাত্রাবাড়ীর ফরিদা আক্তারের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক আলোচনার মাধ্যমেই। বিয়ের সময় সরকারি চাকরিজীবী বলে ফরিদার মা-বাবা বেশ দামিদামি উপহারের নামে যৌতুকও দিয়েছিল। কিন্তু তাদের বিয়ের ৪ বছর পরই বর হাসান কবির ডিভোর্সের নোটিশ পাঠায় এবং ফরিদার বাবা মামলা করে। মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। ডিভোর্সের নোটিশ নিয়ে কথা বলার সময় সিটি করপোরেশনের কর্মচারী রফিক বললেন, প্রতিদিন ৪০/৪৫টি করে ডিভোর্সের নোটিশ পাই। এখন কোনো অনুভূতি হয় না। আগে ডাকযোগে অথবা লোক মারফত নোটিশ পাঠাতো। এখন নিজে এসে দিয়ে যায়। কোন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা বেশি? অনুসন্ধানে জানা যায়, উচ্চ মধ্যবিত্তের মধ্যেই এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় উচ্চবিত্তের এবং নিম্নবিত্তের বিচ্ছেদের ঘটনাগুলো সাধারণত মেয়রের কার্যালয়ে আসেই না। উচ্চবিত্তের কাছে বিচ্ছেদ কোনো ঘটনাই মনে করে না। ফলে নিয়ম মানে না ।
আবার নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রে অনেকেই অসচেতন। তাই জানেই না নোটিশ দেয়ার কথা। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এর ৮, ৯, ১০ ধারা মতে বিবাহ বিচ্ছেদের চূড়ান্তকরণের আগে বিচ্ছেদ চেয়ে স্বামী বা স্ত্রীকে মেয়রের বরাবরে নোটিশ করতে হবে। অবগত হওয়ায় ৯০ দিনের মধ্যে মেয়র বা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে শালিশি বৈঠক ডাকবেন এবং মীমাংসা করতে ব্যর্থ হলে বিচ্ছেদ কার্যকর হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা সিটি করপোরেশনে মেয়র যা ১০টি অঞ্চলের নির্বাহী প্রধানদের মাধ্যমে তালাকের নোটিশ নিষ্পত্তি করছেন। বর্তমানে যে হারে তালাকের নোটিশ জমা পড়ছে তা বিগত ৮-১০ বছরের তুলনায় ৩/৪ গুণ। কিন্তু কেন, কী এর কারণ হতে পারে? এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম মগবাজার কাজী অফিসের প্রধান কাজী মওলানা মোহাম্মদ ফিরোজের কাছে। তিনি বলেন, এখন আর আগের দিন নেই। আগে বিয়ে করতে হলে বা দিতে হলে ছেলে-মেয়ের মা-বাবাসহ তিন-চার পুরুষের খোঁজ নিয়ে পরে বিয়ে হতো। আর এখন আমাদের এখানে আসে সাক্ষী আর বিয়ে হয়ে যায়। এমনও হয়েছে যে এক সপ্তাহে বিয়ে হয়েছে পরের সপ্তাহে ছাড়াছাড়ি করতে এসেছে। বিয়ে ব্যাপারটা যেন একটি ছেলেখেলা হয়ে উঠেছে। এর শেষ কোখায়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেনÑ শেষ নেই বরং বাড়ছে। আমি মনে করি এর কারণ সামাজিক অবক্ষয়। পরস্পরের প্রতি, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, নির্ভরতা কমে যাওয়াই এর অন্যতম কারণ। কাজী সাহেব যে তথ্য জানালেন তাতে করে এখানের চিত্রও বেশ ভয়াবহ। কারণ তিনি মাসে প্রায় ৬০/৬৫টি বিয়ে পড়ান এবং তালাকের পরিমাণ প্রায় ২০/২২টি। বিয়ে ভাঙা নিয়ে সার্বিক এই চিত্র বিশেষ করে প্রেমের বিয়ের ভাঙার চিত্র দিনদিন বেড়েই চলেছে।

0 comments:

Post a Comment