উপমহাদেশে কাঠ খোদাই শুরু হয়েছে মৌর্য আমলে বা তার কিছু পূর্বে। কিন্তু সেই শিল্প বাংলাদেশে এসে পৌঁছতে এবং বহুল প্রচলিত হতে আরো কয়েক শত বছর লেগেছে। গুপ্ত যুগের পূর্বের কাঠ খোদাইয়ের কিছু নিদর্শন বাংলাদেশের নানা স্থানে পাওয়া যায়। কাঠ খোদাইয়ের মাধ্যমে মূলত বিভিন্ন আসবাবের অলংকরণ করাই তখনকার সময় প্রাধান্য পেত। অল্প কিছু ভাস্কর্যের কাজও তখনকার সময় প্রাধান্য পেত। তবে তখনকার মানুষ কাঠের থেকে পাথর খোদাইয়ের মাধ্যমে ভাস্কর্য নির্মাণে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। দারুশিল্পের একাল ও সেকাল নিয়ে লিখেছেন সাজিদুল হক শুভ
দারুশিল্প বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিল্প। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সময়ের পরিবর্তনের সূত্র ধরে দারুশিল্প পরিণত রূপ পরিগ্রহ করেছে। দারুশিল্প কবে থেকে শুরু হয় সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়নি। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, ময়নামতি, মহাস্থানগড়, কান্তজির মন্দির ইত্যাদি প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন খননের ফলে যে ভাস্কর্য পাওয়া গেছে সেগুলো মাটির, কাঠের নয়। এর অর্থ এই নয় যে, তখনো দারু শিল্পের উদ্ভব হয়নি। প্রতœতাত্ত্বিক খননে কাঠের সামগ্রী তথা কাঠের ভাস্কর্য বা যে কোনো ধরনের কাজের অনুপস্থিতির প্রকৃত কারণ সম্ভবত কাঠের ক্ষয়িষ্ণুতার জন্য। কাঠের এই ক্ষয়িষ্ণুতার পেছনে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ, ঝড়, বন্যা, প্লাবন, আগুন ইত্যাদি কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে। আর তাই সময়ের দীর্ঘ সেতু পেরিয়ে কাঠের খোদাই শিল্প অতীত ঐতিহ্য হিসেবে বর্তমানে এসে দাঁড় হতে পারেনি। তবে প্রাচীন প্রস্তর যুগের শুরু থেকেই কাঠের দ্রব্য সামগ্রীর ব্যবহার ও শৈল্পিক নিদর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। প্লাইস্টোসিন পর্বের মাঝামাঝি সময়কালে ইংল্যান্ডে ক্ল্যাকটন-অন-সিতে মধ্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ারের সঙ্গে কাঠের তৈরি বর্ষা ফলক পাওয়া গেছে। মৌর্য-পূর্ব যুগ থেকে বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সূত্রধর সম্প্রদায় দারুশিল্পের কাজে অভ্যস্ত ছিল, যার প্রবহমান ধারা আজও চলে আসছে।
ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণে প্রাচীনকাল থেকেই উপমহাদেশে কাঠের ওপর খোদাই করে নকশা বা ভাস্কর্য তৈরি করার শিল্প অনেক জনপ্রিয় ছিল। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এ অঞ্চলে কাঠ খুবই সহজলভ্য। তখনকার দিনে ভাস্করদেরকে খুবই নীচু শ্রেণীর মানুষ হিসেবে গণ্য করা হতো। সপ্তম শতকের শেষার্ধে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাস নতুন ঝাঁক নিতে আরম্ভ করে। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেই নয়, তার সাথে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়। সূত্রধর সম্প্রদায় অষ্টম ও নব্বই শতাব্দীর সময় এ অঞ্চলে কাঠের বিভিন্ন ভাস্কর্য, রাজা-জমিদারদের ব্যবহার্য খাট-পালঙ্কসহ বিভিন্ন দেব-দেবী, কারুকার্যময় দরজা ইত্যাদি তৈরি করেছিলেন, যেগুলো সেসময়ের তৈরি পাথরের ভাস্কর্য ও শিল্প মাধ্যমের চেয়ে অধিকতর প্রাচীন, শিল্পসম্মত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। পরবর্তী সূত্রধর সম্প্রদায়ের সৃষ্টিকর্ম ধারাবাহিকতায় বাস্তুবিদ্যা থেকে ভাস্কর্যে পরিণত হয়।
অষ্টম শতকের পর থেকে স্বাধীন সুলতানি আমলের শেষ পর্যন্ত দারুশিল্প একটা জায়গাতেই আটকে ছিল- আসবাবপত্র অলংকরণ ও তৎকালীন রাজাদের বা রাজপরিবারের ভাস্কর্য নির্মাণ এবং দেব-দেবীদের মূর্তি নির্মাণ- এই ছিল দারুশিল্পের ব্যাপ্তি। কিন্তু এই উপহাদেশে ইংরেজদের আগমনের পরে থেকে পরিবর্তন ঘটতে থাকে দারুশিল্পের ইতিহাস। কাঠকে আরো অনেক কাজে শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করতে শেখায় ইংরেজরা। ইংরেজরা আগমণের পূর্বে প্রায় সমস্ত মূর্তিই পৃষ্ঠপটযুক্ত ফলকে বা খণ্ডে উৎকীর্ণ হতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে ফলক-উৎকীর্ণ ভাস্কর্য ক্রমেই পৃষ্ঠপট-নিরপেক্ষ হতে থাকে। কিন্তু মজার ব্যাপারটি লক্ষ করার মতো হচ্ছে ভাস্কর্যগুলির চোখ। মূর্তিগুলো কখনো একান্তভাবে সমতলবদ্ধ দৃষ্টি থেকে যুক্ত হতে পারেনি। ইংরেজরা এই উপহমাদেশে ছাপার কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কাঠ ব্যবহার করতে শেখায়। এমনকি শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে উড কাঠের ব্যবহারও এ সময়েই শুরু হয়। ১৯শ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় প্রথম সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য একটি প্রেস স্থাপন করা হয়। সেখানে মূলত কাঠের ব্লক কেটে সেগুলো দিয়েই ছাপানোর কাজ চালানো হতো। পরবর্তীতে কাপড়ের নকশা করার ক্ষেত্রে কাঠের ব্লকের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯শ শতকের পুরো ভাগটা জুড়ে ছিল দারুশিল্পের জয়জয়কার। তখন এদেশে আসা বহির্বিশ্বের সবাই উপমহাদেশের এই শিল্পের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করে। মূলত এ কারণেই এই শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে তখন। তাছাড়া কাঠ কাটা ও সংরক্ষণের আধুনিক সব পদ্ধতি ও উপাদানের আবিষ্কারের কারণে সকলকেই অধিক পরিমাণে কাঠের তৈরি জিনিসের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু আরো পরে, বিংশ শতকের শুরুর ভাগে ধাতব পদার্থের প্রচুর ব্যবহার ও সহজলভ্যতা দারুশিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, যার কবল থেকে আজও বের হয়ে আসতে পারেনি এই শিল্প। বর্তমানে বাংলাদেশে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও দারুশিল্প শিক্ষা দেওয়া হয়। চারুকলা অনুষদে ভাস্কর্য বিভাগ ও কারুশিল্প বিভাগে এই শিল্পের চর্চা করা হলেও বাস্তবিক এর প্রয়োগ খুবই কম। ১৯৮১ সালে দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে কাঠের ভাস্কর্যের মাধ্যমে স্বর্ণ জিতে তরুণ শিল্পী রাসা সবাইকে চমকে দিলেও বর্তমানে হাতে-গোনা কয়েকজন শিল্পী ব্যতীত তরুণ প্রজন্মের কাউকেই এ ধারায় উৎসাহী হতে দেখা যায় না। অলোক রায়, রাসা, এনামুল হক এনাম- এমন হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পী ব্যতীত সবাইকেই দেখা যায় পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী দারুশিল্পের বদলে তারা আধুনিক মেটাল বা প্লাস্টারে কাজ করতেই বেশি আগ্রহী। এমনকি ছাপাখানা বা কাপড়ের নকশার ক্ষেত্রেও এখন কাঠের ব্লকের বদলে মেটালের ব্যবহার হচ্ছে, যা এই শিল্পের ভবিষ্যৎ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। ভাস্কর রাসার মতে, সংরক্ষণের বাড়তি কষ্ট, সময়সাপেক্ষ কাজ এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশের প্রাচীন কাঠের ভাস্কর্যের ঐতিহ্যকে রক্ষা করে আধুনিক কাঠের সাম্প্রতিক ভাস্কর্যের গতি লক্ষ করলে দেখা যায় যে, আগের কাঠের ভাস্কর্যের মতো শুধু ধর্মকে কেন্দ্র করে ভাস্করদের চিন্তা, চেতনা, অনুভূতির প্রকাশ হয়ে উঠতে শুরু করেছে ভাস্কর্য মাধ্যম। কিন্তু দারুশিল্পের বর্তমান গতি এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদেরকে সন্দিহান করে তোলে। ভবিষ্যতে কি জাদুঘরের সজ্জাতেই ব্যবহৃত হবে বাংলার প্রাচীন শিল্পের এই নিদর্শন!
0 comments:
Post a Comment