Monday, May 24, 2010

জামালপুরের নকশি কাঁথা

0 comments

আবহমানকাল থেকেই বাংলার বধূরা স্বভাবগতভাবেই বাংলার ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃশ্যগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সুই-সুতোর ফোঁড়ে কাপড়ে তৈরি করত অপূর্ব সব চিত্রাবলী। গ্রামের বউ থেকে শুরু করে ঝিরা পর্যন্ত সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে শৌখিনতাবশত নকশি কাঁথা বানাত। চারদিকে অঝরে বৃষ্টি পড়ছে। আর গ্রামের গৃহবধূরা সবাই গল্পে মশগুল হয়ে মনোনিবেশ করছে নকশি কাঁথা তৈরিতে। গল্প-উপন্যাসের সেসব কথাই বাস্তবে এখনো ধরা পড়ে গ্রামে। মেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা, নানী-দাদিরা মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর সময় বাহারি রঙের নকশি কাঁথা সঙ্গে দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না। এ যেন চিরচেনা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়িতে মেহমান এলেই নানা রঙের হাতের কাজ করা বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের কভার, দস্তরখানা ইত্যাদি ব্যবহার করতে দেয়া হতো।জামালপুরের নকশি কাঁথা ও হাতের কাজ করা রকমারি পোশাক সারাদেশে আগে থেকেই প্রশংসিত ছিল। বর্তমানে তার কদর বিন্দুমাত্র না কমে আরো উন্নত হয়ে দেশ ও দেশের বাইরে সমাদৃত হচ্ছে। জামালপুর, বকশীগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ এবং সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে নকশি কাঁথা কম-বেশি তৈরি করা হয়। তবে নানামুখী সুযোগ-সুবিধার কারণে এর উৎপাদন এখন সদর উপজেলাতেই বেশি হয়। বিশেষ করে জামালপুর শহরে এর আধিক্য সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এখানকার স্থানীয় পোশাকের গুণগতমান উন্নত এবং দাম তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান জামালপুরের জেলা প্রশাসক সিরাজ উদ্দিন আহমেদ।কিন্তু আমরা যদি একটু অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, এই ঐতিহ্যবাহী মনোমুঙ্কর সূচি শিল্পটি এক সময় প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। সত্তরের দশকের শেষভাগে সম্ভাবনাময় এই শিল্পের চিহ্ন অনেকটা বিলুপ্ত হতে থাকে। অবশেষে আশির দশকের প্রথমাংশে হারাতে বসা নকশি শিল্পটি পুনরুদ্ধার করে বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় গতি যোগ করে ব্র্যাক নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ব্র্যাক জামালপুরের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সূচি শিল্পীদের খুঁজে বের করে তাদের দিয়ে নকশি কাঁথা শিল্পটির নব উত্থান ঘটায়। ১৯৮৭ সালে বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন সংঘ এক হাজার গ্রামীণ মহিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশি কাঁথার কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ নারীরা গড়ে তোলে নিজ নিজ নকশি কাঁথার প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটে। বর্তমানে জামালপুরের সব উপজেলায়ই নকশি শিল্পের ব্যাপক হারে কাজ হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ৩০০টি প্রতিষ্ঠান। যাতে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_ আয়োজন, রওজা কারু পল্লী, কারু নীড়, কারু পল্লী, দোলনচাঁপা, নিঝুক, সূচিতা, তরঙ্গ, দিপ্ত কুটির, বুনন, অনিকা, মিম, মামিম ইত্যাদি। এ শিল্পটির সঙ্গে জামালপুরের প্রায় ৭৫ হাজার নারী-পুরুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তবে নানা প্রতিকূলতার কারণে শিল্পটির তেমন প্রসার ঘটেনি।এখানকার উৎপাদিত নকশি কাঁথা ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের প্রায় সব জেলা শহরে কমবেশি বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে পণ্যটি রপ্তানি হচ্ছে।স্থানীয় উদ্যোক্তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে নকশি কাঁথা বিক্রি করে থাকে। দেশের বিভিন্ন নামকরা মেলাগুলোতে নকশি কাঁথা অতি গুরুত্বসহকারে স্থান পায়। জামালপুরের নকশি শিল্পের মধ্যে আরো রয়েছে_ বেড কভার, থ্রি-পিস, ওয়াল মেট, কুশন কভার, শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, ফতুয়া, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ির পাড়, ওড়না, কলমদানি, মানিব্যাগ অন্যতম। এসবের দাম ২৫ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত মৌসুমভেদে উঠানামা করে।তবে এ শিল্পের বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। নকশি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা খুব স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করেন। ফলে তাদের পড়তে হয় নানা সমস্যায়। তার মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো_ পুঁজি সংকট, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধি, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, নিখুঁত পণ্য উৎপাদন হ্রাস, বাজারের তুলনায় উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্দ্য, বকেয়া টাকা পরিশোধ না করা, ডিজাইনে বৈচিত্র্যের ছাপ না পাওয়া, ব্যাংক ও অর্থলগি্নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সহজশর্তে ঋণ না পাওয়া, যথাযথ সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়া, সরাসরি বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার সুযোগ না পাওয়া ইত্যাদি। এ শিল্পের সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে এবং সরকারের হাত আরো প্রসারিত করলে এটিও হতে পারে অন্যতম একটি আয়ের উৎস।

0 comments:

Post a Comment