Saturday, May 22, 2010

গঙ্গাসাগর ঢাকার একমাত্র দিঘি

0 comments
কথিত আছে মোগল সম্রাট আকবর ষোল শতকের শেষের দিকে বাংলা বিজয়ের উদ্দেশ্যে সেনাপতি মানসিংহকে এ এলাকায় পাঠান। রাজা মানসিংহ ঢাকা এসে এ এলাকায় তাঁবু ফেলেন এবং ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তখন এ এলাকায় পানীয়জলের খুব অভাব ছিল। মানসিংহ তাঁর সৈন্যসামন্ত দিয়ে বিরাট একটি দিঘি খনন করেন। নাম দেন গঙ্গাসাগর।
ঢাকায় কি কোনো দিঘি আছে_কাউকে এমন প্রশ্ন করলে কপালে ভাঁজ তুলে বলবে, ঢাকায় অসংখ্য খাল, ডোবা, পুকুর থাকার কথা শুনেছি; কিন্তু দিঘি থাকার কথা এখনো শুনিনি। হ্যাঁ, ঢাকার অতি প্রাচীন একটি দিঘি আছে। দিঘিটির নাম গঙ্গাসাগর। বাসাবোর পূর্ব প্রান্তে রয়েছে দিঘিটি। এর বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য গত রবিবার পা বাড়াই পথে। গুলিস্তান এসে চেপে বসি রাইডার নামের বিচিত্র পরিবহনে। ডিজিটাল যুগে রাজধানীর পথে আজও এসব বাহন যাতায়াত করে ভেবে অবাক হই।
বাসাবো এসে আবার রিকশা ধরি। আঁকাবাঁকা-ভাঙাচোরা সরু রাস্তা মাড়িয়ে একসময় একটি মন্দিরের গেটে এসে রিকশা থামে। জায়গাটির নাম বড় বিচিত্র। মন্দিরের ফটকের ওপর লেখা 'রাজারবাগ শ্রীশ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির'। পাশের দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা বাসাবো, কদমতলী, সবুজবাগ। তবে জায়গাটি আদিতে রাজারবাগ মৌজার অধীনে ছিল। এ কারণে মন্দিরের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজারবাগ কথাটি। বর্তমানে স্থানটি সবুজবাগ থানার অন্তর্গত।
মন্দিরের ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। চোখের সামনেই বিশাল এক দিঘি। নানা ধরনের গাছগাছালিতে আকীর্ণ দিঘিটির পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে আছে ছোট-বড় অনেক মন্দির। দিঘিটিতে অনেকেই গোসল করছে। বৈশাখের শরীর-পোড়া গরমে কেউ কেউ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। এ দিঘি নিয়ে আছে বহু কাহিনী, কিংবদন্তি।
কথিত আছে মোগল সম্রাট আকবর ষোল শতকের শেষের দিকে বাংলা বিজয়ের উদ্দেশ্যে সেনাপতি মানসিংহকে এ এলাকায় পাঠান। রাজা মানসিংহ ঢাকা এসে এ এলাকায় তাঁবু ফেলেন এবং ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তখন এ এলাকায় পানীয়জলের খুব অভাব ছিল। মানসিংহ তাঁর সৈন্যসামন্ত দিয়ে বিরাট একটি দিঘি খনন করেন। নাম দেন গঙ্গাসাগর। এটি খনন হওয়ার পর এ এলাকার সাধারণ মানুষের পানীয়জলের সমস্যা দূর হয়। শুধু তাই নয়, দিঘিটি ক্রমেই হয়ে ওঠে তীর্থক্ষেত্র। ধর্মপ্রাণ মানুষ অষ্টমী স্নান, বারুণী স্নান উপলক্ষে এখানে এসে স্নানপর্ব শেষ করে পুণ্যি লাভের আশায়। তা ছাড়া প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে এ দিঘিতে স্নান করে মনস্কামনা ব্যক্ত করে। পরবর্তী সময়ে দিঘিটিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় বেশ কিছু মন্দির। এসব মন্দিরের মধ্যে আছে শ্রীশ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির, শিব মন্দির, শীতলা মন্দির, বিশ্বকর্মা মন্দির, লোকনাথ মন্দির ইত্যাদি। দিঘির উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে একটি শ্মশান এবং শ্মশান কালীমন্দির।
দিঘিটির পরিমাপ প্রায় ৪ দশমিক ৫০ একর। উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি এ দিঘির তিনটি ঘাট রয়েছে। দুটি পূর্ব দিকে, একটি উত্তর দিকে। এর সীমানাপ্রাচীর রয়েছে তিন দিকে। পূর্ব দিকে কোনো প্রাচীর নেই। এতে সারা বছর পানি থাকে। একসময় এর পানি ছিল স্বচ্ছ ও সুপেয়। এখন অবশ্য নেই। এই দিঘির আশপাশ এলাকার কয়েক লাখ লোক এর ওপর নির্ভরশীল। যখন ওয়াসার পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে তখন দক্ষিণগাঁও, নন্দীপাড়া, মানিকদী, বাসাবো, মাণ্ডা, মাদারটেক, গোড়ান প্রভৃতি এলাকার মানুষ এর পানি ব্যবহার করে। তারা রান্নাবান্না থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সব কাজে এর পানি ব্যবহার করে।
দিঘিটি জীববৈচিত্র্যের অফুরন্ত আধার। এতে নানা ধরনের মাছ ছাড়া অন্যান্য জলজ প্রাণীও রয়েছে। আগে শীতকালে এখানে পরিযায়ী পাখি এসে আশ্রয় নিত। এখন আর দেখা যায় না। দিঘিটি স্থানীয়ভাবে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন বিকেলে অসংখ্য মানুষ এসে এর পাড়ে বসে আড্ডা দেয়, গল্প-গুজব করে। এ জন্য এর পাশে কয়েকটি পাকা বেঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এর দক্ষিণ দিকে অসংখ্য রিকশা আর উত্তর পাড়ে বস্তি থাকায় সৌন্দর্যহানি হচ্ছে। দিঘিটিকে কেন্দ্র করে আরো আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায়।
মোগল সেনাপতি মানসিংহের স্মৃতিবিজড়িত প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন এ গঙ্গাসাগর ঢাকার একমাত্র দিঘি। প্রজাহিতৈষী মানসিংহ এ দিঘির মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে আছেন। দেবোত্তর সম্পত্তির অধীন এ দিঘির আশপাশের বেশ কিছু জমি এরই মধ্যে ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে। আরো জমি আত্দসাতের জন্য তারা তৎপর। খনন করার পর আজ পর্যন্ত এটি সংস্কার করা হয়নি। দিঘিটি সংস্কারের মাধ্যমে পাড় বাঁধাই করে একটি আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে।
স্বপন কুমার দাস

0 comments:

Post a Comment