Wednesday, May 19, 2010

ঝাপান খেলা

0 comments
                                                               ০০ মোঃ মেহেদী তানজির ০০
মূলত মাগুরা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে বিশেষত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আয়োজিত হয় ঝাপান খেলা। একাধারে এটি একটি কৃত্য এবং সাপুড়েদের প্রতিপত্তি প্রদর্শনের লড়াই। স্থানীয় ভাষায় ঝাপাঝাপি থেকেই ঝাপান শব্দটির উৎপত্তি। ঝাপাঝাপি অর্থাৎ নৃত্য-গীত সহকারে জীবন্ত সাপের সহায়তায় ঝাপান খেলা পরিবেশিত হয়ে থাকে। আর এই গীত সংগ্রহ করা হয় পদ্মাপুরাণ বা মনসামঙ্গল থেকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাধানাথ রচিত পদ্মপুরাণ হতে গান সংগ্রহ করা হয় বলে জানা যায়। সুতরাং বলা যেতে পারে জীবন্ত সাপের উপস্থিতিতে নৃত্য ও গীতের সহায়তায় মনসার জীবনকাহিনীনির্ভর একটি ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা হলো ঝাপান খেলা।

নদীবিধৌত এ বনাঞ্চল পরিপূর্ণ এই বাংলায় সাপ একটি ভয়ানক প্রাণী। গ্রামে প্রায়ই সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর কথা জানা যায়। এরই ফলশ্রুতিতে সাপকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রচলিত হয় বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ। আর দেবী মনসা হলেন সাপের দেবী, তাই তাকে সন্তুষ্ট রাখা অপরিহার্য। তাই মনসাকে সন্তুষ্টির জন্যই মূলত কৃত্যানুষ্ঠান হিসেবে ঝাপান খেলা প্রদর্শিত হয়। আর এই পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করনে সাপুড়েরা। যেখানে তাদের সামনে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণের বিশাল একটি পথ হলো ঝাপান। কারণ ঝাপান খেলায় মনসার উদ্দেশ্যে গান-নাচের পাশাপাশি প্রদর্শিত হয় সাপকে নিয়ে বিভিন্ন বিপদজনক খেলা। যে সাপুড়ে যত বেশি বিপদজনক খেলা প্রদর্শন করতে পারে সে তত বেশি সাফল্যের দাবিদার। তাই আত্মমর্যাদার লড়াইয়ে উপনীত হয় সাপুড়েরা। তৈরি করা হয় দুইটি পক্ষ। একটি মনসাকেন্দ্রিক অপরটি চাঁদবণিক। পালাগানের মতো দুই দল উপস্থাপন করে মনসামঙ্গল ভিত্তিক নানা প্রশ্ন এবং একই সাথে দিয়ে চলে প্রতিপক্ষের প্রশ্নের উত্তর। মূলতভোর বেলায় কোনো বাগানে বা গাছের ছায়ায় চারিদিকে দড়িদিয়ে নির্দিষ্ট করা হয় আসর এবং আসরের মাঝখানে কাঠের চকি দিয়ে উঁচু করে তৈরি করা হয় সাপ খেলার স্থান। সাপকে নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থেই মূলত সকালে এবং উঁচু স্থানের ব্যবস্থা করা হয়। খেলাটির শুরু থেকেই পৃথক দুই দল নিজস্ব ঢঙে স্বপক্ষে গানের মাধ্যমে যুক্তি উপস্থাপন করে তার মতামতের সঠিকতা প্রদর্শনে লিপ্ত থাকে। এখানে মনসার জন্ম, দেবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। চাঁদের বিরোধিতা, বেহুলা-লখিন্দরের জন্ম, বাসরঘরে সাপের দংশন, ভাসানো এবং জিয়ানসহ মনসামঙ্গলের সকল বিষয়ই উঠে আসে। সাপুড়েরা পরিস্থিতি এবং প্রতিপক্ষের প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে তার জানা প্রচুর সুরের ভাণ্ডার হতে উপযুক্ত সুর নির্বাচন করে তাৎক্ষণিক গান শুরু করে দেন। অবশেষে গাওয়া হয় জোড়-পাল্লার গান। যেখানে দুই দলই নিজেদের আপসহীন অবস্থা হতে সরে এসে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে ভ্রাতৃত্বমূলক অবস্থা তৈরি করে। এরই পর শুরু হয় সবচাইতে আকর্ষণীয় সাপের খেলা। যেখানে প্রত্যেক ওঝা তাদের মাহাত্ম্য প্রচারে উন্মুখ হয়ে ওঠে। অনেক সময় দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী জীবন্ত সাপকে কামড়ে খেতে পর্যন্ত দেখা যায় সাপুড়েদের। একই সঙ্গে খেলা এবং নাট্যিক ক্রিয়ার সংমিশ্রণ ঘটানো হয় ঝাপান খেলায়, যেখানে আগে থেকেই ফলাফল জানা থাকে যে, দুই দলা জোড়া-পাল্লার গানের মাধ্যমে একত্রিত হবে। তথাপি সাপের খেলা প্রদর্শনের মাধ্যমে এবং একই সাথে পাল্টা গানের মাধ্যমে তৈরি করা হয় থিয়েটারের এক নতুন মাত্রা। নাটক বা থিয়েটারকে যে নতুনভাবে দেখা সম্ভব, তার আদর্শ আইকন হলো ঝাপান খেলা। খেলার মাধ্যমে পেশাগত উৎকৃষ্টতা প্রচার এবং একই সাথে মনসার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে কৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে ঝাপান খেলায় তৈরি করা হয় বহু মাত্রা, যা কিনা আমাদের লোকজ সংস্কৃতিরই রন্ধ্রে অবস্থান করছে।

0 comments:

Post a Comment