skip to main |
skip to sidebar
'সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুল ডোরে বাধা দোলনা...' দোলনায় দোল খাওয়ার সেই স্মৃতি, বৃক্ষছায়ায় হৃদয় শীতল করা সেই আবহ এখনো খানিকটা খুঁজে পাওয়া যায় ঢাকার রমনায় গেলে। নগরের যান্ত্রিক জীবনের রকমারি ব্যস্ততার মধ্যে গাঢ় সবুজের হাতছানি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত পার্কের পরিবেশ। এখানে এলেই মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। লেকের পাড়ে ঝিরি ঝির বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। এখানে প্রাতঃভ্রমণে আসেন হাজারও মানুষ। এ পার্ক শতাব্দীকাল ধরে ঢাকার ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। রমনা জাতীয় উদ্যান, লন্ডনের 'কিউই গার্ডেনের' আদলে তৈরি বাংলাদেশের একমাত্র পরিকল্পিত উদ্যান। যা বাস্তবায়নে সময় লেগেছিল ২০ বছর। ব্রিটেনের গার্ডেন বিশেষজ্ঞ আরএল প্রাউড লক রমনার এই নিসর্গ পরিকল্পনা করেছিলেন। ঢাকা শহরে রমনার নিসর্গ পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯০৮ সালে। এ কাজে লকের সহকর্মী ছিলেন কলকাতার 'ইডেন গার্ডেন'-এর কর্মী অখিল। ইট-পাথরের জঞ্জালে ঘেরা এ নগরীর মানুষ খরতাপ থেকে একটু স্বস্তি পেতে ছুটে যান পার্কের ছায়া-সুনিবিড় পরিবেশে। খুঁজে ফেরেন প্রশান্তির ছোঁয়া। কিন্তু ঢাকায় পার্ক কোথায়? রমনা উদ্যান ও পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ওসমানী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, তারপর...। ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ঢাকায় আর উদ্যান বা পার্ক কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ঢাকায় ঢাকা সিটি করপোরেশন বা ডিসিসির অধীনে পার্ক আছে ৫৪টি। এর মধ্যে গুলশান পার্ক (ওয়ান্ডারল্যান্ড শিশুপার্ক), শ্যামলী শিশুপার্ক, বনানী শিশুপার্ক, সোহরাওয়ার্দী সংলগ্ন শিশুপার্কসহ ১০টি হলো শিশুপার্ক। ওসমানী উদ্যানসহ তার আওতাভুক্ত পার্ক আছে আরও ৪৩টি। আর এসব কাগুজে পার্কের নামে বরাদ্দ আছে রাজধানীর প্রায় ১০২ একর ভূমি। বাকি পার্কগুলো জাতীয় উদ্যান। এসব উদ্যানও নানা সমস্যায় জর্জরিত। এক সময়ের রেসকোর্স ময়দান আমাদের ইতিহাসের অংশ। এই ময়দান থেকেই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল স্বাধীনতার অমোঘ বাণী_ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম...।' এই ময়দানেই আত্দসমর্পণ করেছিল পরাজিত পাক হানাদার বাহিনী। এটি এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এই উদ্যানে স্থাপিত হচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শন 'স্বাধীনতা স্তম্ভ'। রমনা উদ্যানের সৌন্দর্য ও ছায়া-সুনিবিড় পরিবেশ এখন মেগাসিটি ঢাকার শ্বাসনালি। ওসমানী উদ্যানেও এখন আর বেড়ানোর মতো পরিবেশ নেই। মাদকসেবী আর ভাসমান মানুষের আশ্রয়স্থল উদ্যানটি। রমনা পার্ক রমনা বটমূলের পহেলা বৈশাখ এখন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের কবিতা ও সাহিত্য বার বার এসেছে এ পার্কের প্রসঙ্গ। লেখিকা যোবায়দা মীর্জা 'সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি' বইতে লিখেছেন, এখনকার মৎস্য ভবন, সড়ক ভবন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, রমনা পার্ক, টেনিস কমপ্লেঙ্, পিজি হাসপাতাল, হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) তৎকালীন সময়ে ছিল বাগান ও কিছু জঙ্গল। হাতিরপুল পর্যন্ত এ জঙ্গল বিস্তৃত ছিল। তৎকালীন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারের (বর্তমান হাইকোর্টের ভেতরে) রমনা পার্কের দিকে সীমানায় কাঁটা মেহেদির বেড়া ডিঙিয়ে রমনায় যেতে হতো। বেড়ার এপারে দুই ধাপ আর ওপারে দুই ধাপ সিঁড়ি ছিল রমনার বাগানে যাওয়ার পথ। ছিল পায়ে চলার সরু পথ। মাঝে- মধ্যে লাল রংয়ের সুদৃশ্য ইমারত। রমনার সীমানার শেষ প্রান্তের (পূর্বে) বাড়িটি ছিল সত্যেন বসুর। উত্তরে এখনকার মন্ত্রিপাড়ার দু'চারটি বাড়ি, পশ্চিমে নীলক্ষেতের শেষ প্রান্তে ছিল কবি মোহিতলাল মজুমদারের বাড়ি। দক্ষিণে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে মেডিকেল কলেজ)। এ সীমানার মধ্যেই ছিল রমনা হাউস (বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), এক সময় সলিমুল্লাহ ছাত্রাবাস, চামেলী হাউস (বর্তমানে সিরডাপ কার্যালয়), ভুল করে যে বাড়ির নাম বলা হচ্ছে চামেলী হাউস (তা ছিল এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাস), লাট ভবন (পুরনো হাইকোর্ট ভবন) এক সময়ের ঢাকা কলেজ 'কার্জন হল (টাউন হল হিসেবে যা নির্মিত হয়েছিল)। বাড়িগুলো ছিল ছিমছাম, ফুলে-ফলে ঢাকা। এখনকার রমনা পার্কের লেকটা হাইকোর্টের ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছিল, এর কিছু অংশ রেসকোর্সের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মধ্যেও ছিল। খুব সম্ভব এ লেকটি মোগল আমলে তৈরি করা জলপথের একটি অংশ, যা এখন রমনা পার্কেই সীমাবদ্ধ।' যোবায়দা মীর্জার এই উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, রমনা পার্কের বিশালত্ব। নাজির হোসেন তার 'কিংবদন্তির ঢাকা' বইতে লিখেছেন, 'ব্রিটিশ যুগে রমনা ময়দানটি ছিল ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত। এটি ছিল ঢাকার সর্বস্তরের মানুষের চিত্তবিনোদনের স্থান। প্রতি শনিবার ঘোড়দৌড় হতো। আর সপ্তাহব্যাপী চলত তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা।' এখন মাঠে রেসের কাঠের রেসলিং নেই। উদ্যান তৈরি করে যে গাছপালা লাগানো হয়েছিল তা বড় হতে চলেছে। অনেক তরুণ-তরুণী, সেসব গাছের নিচে বসে নিসর্গের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়া করেন। অনেকে নগর জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে সুন্দর সময় উপভোগ করার জন্য উদ্যানে যান। সেই ঢাকা আর এই ঢাকায় এখন অনেক পার্থক্য। ঢাকা এখন পোস্তাগোলা থেকে উত্তরার সীমানা ছুঁয়েছে। পশ্চিমে সদরঘাট থেকে পূর্বদিকে যাত্রাবাড়ী ছাড়িয়ে ঢাকা শহর এখন দনিয়া, শনিরআখড়া, মাতুয়াইল ছাড়িয়ে ডেমরা, কাঁচপুর ছুঁই ছুঁই করছে। গাবতলী, বসিলা, মিরপুর ১৪ থেকে বনানী বারিধারা, বসুন্ধরা, বাড্ডা, সাঁতারকূল পর্যন্ত এখন ঢাকার সীমানা। আবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে ভাষানটেক, মাটিকাটা, বালুঘাট এখন ঢাকার নগর জনপদ। এই বিশাল বিস্তৃত নগর জনপদে জাতীয় উদ্যান আছে মাত্র পাঁচটি।
এর মধ্যে পরিকল্পিত উদ্যান রমনা। এ ছাড়া বোটানিক্যাল গার্ডেন বাস্তবায়নে উদ্যানের পরিকল্পনা ছিল কিন্তু তা সফল হয়নি। নতুন কোনো উদ্যান বা পার্ক করারও কোনো পরিকল্পনা ঘোষিত হয়নি। তা ছাড়া সরকারের দখলে ঢাকায় উদ্যান বা পার্ক করার মতো খাস খতিয়ানভুক্ত জমিও আর নেই। অধিকাংশ খাস জমি সিএনজি স্টেশন, কাঁচাবাজার, মার্কেট, সরকারি ভবন ও আবাসনের জন্য বরাদ্দ বা বেদখল হয়ে গেছে। একই ভাবে এরশাদ আমলে খেলার মাঠ ও স্টেডিয়াম করার জন্য যাত্রাবাড়ীর ঢালের নিম্নভূমি (বর্তমানে কাঁচপুর রোড ও ডেমরা রোডের মাঝখানের জায়গা ভরাট করা হয়েছিল। সেটিও নানাভাবে বেদখল হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি ভবন, সিএনজি স্টেশন, পাইকারি কাঁচাবাজার ও মাছের আড়ত। একইভাবে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন বা ডিসিসির কাগুজে পার্কগুলোর মধ্যে কিছু চলছে লিজে কিছু হয়েছে বেদখল, বাকিগুলো পরিত্যক্ত। পরিকল্পনার অভাব, পার্কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ না থাকা ও পরিবেশের অভাবে ডিসিসির পার্কগুলো কাগুজে পার্কে পরিণত হয়েছে বলে জানান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিসিসির একাধিক কর্মকর্তা। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন বা ডিসিসির তালিকায় পার্ক রয়েছে ৫৪টি। এর মধ্যে ২২.১০ একর আয়তনের ওসমানী উদ্যানও রয়েছে। আবার ০.০৩ একর জায়গার সড়ক দ্বীপকে 'বংশাল ট্রায়াঙ্গাল পার্ক' নামে তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। কথিত এই পার্কটি এখন সিটি গার্ভেজ টিলায় পরিণত হয়েছে। ০.০৫ একরের মিরপুর এক নাম্বার গোল চক্করের সড়ক দ্বীপ, 'ফার্মগেট ত্রিকোন পার্ক' নামে একই আয়তনের আনন্দ সিনেমা হলের সামনের সড়ক দ্বীপ, কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ পার্কসহ এ তালিকায় অনেকগুলো সড়ক দ্বীপ, পাম্প হাউস সংলগ্ন একটুকরো জমি ও বা রাস্তার পাশের সরকারি জমি দখলমুক্ত রাখতে একটি বাউন্ডারি দিয়ে 'পার্ক' সাইনবোর্ড বসিয়ে দেয়া হয়েছে। যার জন্য ডিসিসির পার্ক তালিকার ৩০টির আয়তন এক কাঠার কম। তারপর তালিকায় উল্লেখিত যাত্রাবাড়ি পার্ক এখন ফ্লাইওবার কর্তৃপক্ষের মালখানা ও মাদক সেবা কেন্দ্র। সায়েদাবাদ পার্ক বেদখল হয়েছে লিজ সূত্রে। এটি এখন মাদক ও অসামাজিক কাজের আখড়া। শ্যামলী শিশু পার্কও বেদখল লিজ সূত্রে। গুলশান পার্ক ওয়ান্ডার ল্যান্ড পার্ক নামে এতো বেদখল থাকলেও সম্প্রতি ডিসিসি তা উদ্ধার করেছে।
আহমদ সেলিম রেজা
'রমনা গ্রীন পার্ক'যা আমরা রমনা পার্ক নামে চিনি। ১৬১০ সালে মোঘলরা রমনা পার্কের গোড়া পত্তন হয়। ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হওয়ার পর রমনা পার্ক একটি জঙ্গলে পরিণত হয়। ১৮২৫ সালে তদানিন্তন ঢাকার ম্যাজিষ্ট্রেট চার্লস ড‘চ ঢাকা কারাগাররে কয়েদীদের দিয়ে অযত্নে গড়ে উঠা জঙ্গল পরিস্কার করনে। আরো পরে ১৯০৮ সালে লন্ডন “কিউই” গার্ডেনের অন্যতম বাগান কর্মী আর.এল. প্রাউডলকের সহয়তায় নতুন ভাবে রমনা পার্কের নির্মান কাজ শুরু করেন। এ ব্যাপারে প্রাউডলককে প্রধান সহকারী হিসাবে বাঙ্গালী অখিল বাবু সর্বাত্বক বাগান কর্মে সহযোগীতা করেন। তাদের দুজনের ২০ বৎসরের প্রচষ্টোয় অযত্নে বেড়ে উঠা জঙ্গটিকে মোটামুটি একটি বাগনের রূপ দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সালে নতুন ভাবে এটিকে জনগনের জন্য পার্ক হিসাবে উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তবে বর্তমান রমনা পার্কের এই রূপটি সম্পূর্ণ হয় ১৯৫২ সালে । রমনা পার্কের মোট আয়তন ৬৮.৫০ একর। লেকের পরিমান ৮.৭৬ একর। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির দুষ্পাপ্য গাছ রয়েছে। তারমধ্যে- নাগলিঙ্গম, অর্জূন, মহূয়া, তেলসূর, অশোক, কপূর, রিটা, নাগেশ্বর, স্বর্ণচাপা ইত্যাদি। রমনা পার্কের প্রারম্ভিক অবস্থায় মোট ৭১ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল, বর্তমানে প্রায় ২২০ প্রজাতির ফুল,ফলজ, বনজ, ঔষধি,লতা-গুল্ম গাছ রয়েছে।
0 comments:
Post a Comment