Sunday, May 16, 2010

বাংলায় জাদুঘর

0 comments
বাংলায় জাদুঘরের ধারণা এসছে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। শুধু বাংলায় কেন, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে জাদুঘরের ইতিহাসের সূচনা ১৭৯৬ সালের দিকে। ভারতীয় এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যগণ এই উদ্যোগ প্রসারের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তারা জাতিতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্তিক, ভূ-তাত্ত্বিক এবং প্রাণী বিষয়ক নমুনা সংগ্রহ এবং সেগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং প্রদশনের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস, যিনি এশিয়াটিক সোসাইটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তিনি কলকাতার পার্কস্ট্রিটে একখণ্ড জমির ব্যবস্থা করেন এবং ১৮০৮ সালে এই ভবন নির্মাণ শেষ হয়। এই প্রক্রিয়ায় ১৮১৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম জাদুঘর ‘এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়াম’-এর জন্ম ও প্রতিষ্ঠা হয়। এ তো গেল ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরগুলোর গোড়াপত্তনের কথা, কিন্তু বাংলাদেশে কখন এবং কীভাবে, কোথায় সর্বপ্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠা লাভ করে সে কথা বলা দরকার এখন।

১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় শরৎকুমার রায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। সে মতে চলতি বছর বাংলাদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় শতবর্ষ পূরণের বছর। সরকার বা সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরসমূহে এই লক্ষে শতবর্ষ উদ্যাপনের কোনো কর্মসূচির খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অথচ আমরা জানি- ইতিহাস চর্চা একটি জাতির এগিয়ে চলার পরিচায়ক। ইতিহাস অতীতকে তুলে ধরে। ইতিহাস তো মানুষেরই ইতিহাস। এর নেপথ্য সঞ্চালক তো মানুষই। মহাকালের মানুষ জীবন্ত হয়ে ওঠে তার রেখে যাওয়া বস্তু সংস্কৃতির ভেতর থেকে। অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধুন জাদুঘর। বিভিন্ন ক্যাটাগরির জাদুঘর রয়েছে আমাদের দেশেও। জাতি-তাত্ত্বিক, প্রাকৃতিক, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি সংরক্ষণে জাদুঘর ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও এসব জাদুঘরের লক্ষ্য কিন্তু অভিন্ন তা হলো- ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতির গৌরব বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবহিত করা এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে জনগণকে সমন্বিত করা। কীর্তিমানদের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্মের উজ্জ্বল স্মৃতি ধরে রাখার জন্য যেসব জাদুঘর গড়ে উঠেছে এগুলোর বিশেষ এক ঐতিহাসিক এবং সংস্কৃতিক মূল্য থাকে। বাংলাদেশে এই বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি জাদুঘর সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। যেমন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরু, চট্টগ্রামে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, সিলেটে ওসমাননি স্মৃতি জাদুঘর, ময়মনসিংহে নজরুল স্মৃতি জাদুঘর, শিলাইদহের রবীন্দ্র জাদুঘর। সবচেয়ে আশার কথাটি হচ্ছে- ওই অঞ্চলে জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় শতবর্ষে ঢাকা শহরে সমস্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু উল্লেখযোগ্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গত এক দশকে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য- বঙ্গবন্ধু জাদুঘর (ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত) মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর (ঢাকার সেগুন বাগিচা এলাকায় ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত), ভাষা আন্দোলন জাদুঘর মূলত ১৯৮৯ সালে কাজ শুরু করলেও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয় ২০০৭ সালে। ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকায় বর্তমান শোভা পাচ্ছে। এই জাদুঘরটির সমস্ত কার্যক্রম স্থাপিত আছে। বাঙালি সমগ্র জাদুঘর (ঢাকার এলিফ্যান্ড রোড এলাকায় ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত), জাহানারা ইমাম স্মৃতি সংগ্রহখানা (২০০৭ সালে এলিফ্যান্ট রোডে শহীদ জননীর বাড়ির একটি ফ্লোরে স্থাপিত)। যাই হোক, আজকে পাঠকদের বলতে চাই- ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থিত ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি সমগ্র জাদুঘরের কথা।

২০০৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা আন্দোলনে বায়ান্নতম বছরে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারাকে সমৃদ্ধ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যথাযথভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীর্তিমান বাঙালির অবদান, তাদের সৃষ্টি ও কর্ম স্থায়ী সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যে ২৩৫/২, এলিফ্যান্ট রোডস্থ খায়ের ম্যানসন ভবনে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠায় এই জাদুঘর তার যাত্রা শুরু করে। এ বছর সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করেছে বাঙালি সমগ্র জাদুঘর। ঢাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত অন্য সব জাদুঘরের চেয়ে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর কোথায় আলাদা সে কথাই আজ সুপ্রিয় পাঠকদের জানাব। ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোড বাটা সিগন্যাল মোড় শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ততম জায়গা। এই স্থানে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাঙালি সমগ্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তারিক রহমান সৌরভের কাছে। তিনি বললেন, মূলত এই ভবনটি আমাদের পৈতৃক বাড়ি। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি ভাড়াটে কোনো বাড়িতে পরিচালনা করা দুরূহ হতো। আর তাছাড়া, ঢাকায় অত্যন্ত সুপরিচিত এই স্থানটি আমাদের প্রতিষ্ঠানের দ্রুত পরিচিতির জন্যও সহায়ক হয়েছে। সর্বোপরি পরিবারের সকলের আর্থিকসহ অন্যান্য সহযোগিতাতেই এই জাদুঘর তার যাত্রা শুরু করতে পেরেছে। বলতে পারেন বিগত ছয়টি বছর ছিল বাঙালি সমগ্র জাদুঘরের প্রাথমিক পর্যায়ে এগিয়ে চলা ও পরিচিতির বিস্তার ঘটানোর সময়। অবশ্য এই ছয় বছরে দুই বাঙালি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্যসেন এবং মোহাম্মদ ইউনূস এই প্রতিষ্ঠানে এসেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানটির প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে তাদের মতামতও তুলে ধরেছেন। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিসেবীর ঔপদেষ্টা হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি পর্যায় থেকেই জড়িত।

উপদেষ্টা পরিষদের বিশিষ্ট জনদের সম্পর্কে পাঠকদের জানানো দরকার। একেবারে গোড়াতে নাট্যব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাঙালিসমগ্র জাদুঘরের সাথে সম্পৃক্ত। পরবর্তীতে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হলে আরো যুক্ত হন সাঈদ আহমদ, সেলিনা বাহার জামান, চলচ্চিত্রকার এম, আবদুস সামাদ (এরা তিনজনেই প্রয়াত), মোবারক হোসেন খান, অধ্যাপক আবদুল কাইউম, সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক বিশ্বজিত ঘোষ প্রমুখ। তারিক বললেন- আমরা বাঙালি সমগ্র জাদুঘরের উপদেষ্টা হিসেবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বমূলক বিশিষ্টজনদের এক জায়গায় করতে চেয়েছি। উপদেষ্টারা তাদের নিজস্ব কর্মব্যস্ততার মাঝেও আমাদের সবসময় বিভিন্নরকম পরামর্শ, এগিয়ে চলার দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। বাঙালি সমগ্র জাদুঘরে যা রয়েছে- সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়াত ষাট বিশিষ্ট বাঙালির প্রোর্ট্রটে বা প্রতিকৃতি রয়েছে এ জাদুঘরে। মোট ৪টি বিভাগে পোর্ট্রটেগুলোকে ভাগ করা হয়েছে তা হলো- (১) ভাষা-শিক্ষা-সাহিত্য (২) সংগীত-নাটক-চলচ্চিত্র-ক্রীড়া (৩) সমাজ-রাজনীতি-সর্বনীতি (৪) বিজ্ঞান-স্থাপত্য-শিল্পকলা। চারুকলা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক শেখ আফজাল পোর্ট্রটেগুলো এঁকেছেন। মাত্র বিশটি মূল স্মারক নিয়ে ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করা এই জাদুঘরের স্মারক সংখ্যা এখন পঞ্চান্নটি। প্রতিদিন আসা দর্শনার্থীরা অবাক হয়ে দেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কবিতার মূল কপি, কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ধূমকেতু (১৯২২) পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত, বেগম রোকেয়ার হাতের লেখা চিঠি (১৯২৬ সালের), সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর গানের স্বরলিপি শিল্পী আবদুল লতিফের ব্যবহৃত দোতারা, চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের মুভি ক্যামেরা, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রচনার পাণ্ডুলিপি, শিল্পী কাজী আবুল কাশেমের আঁকা তৈলচিত্র, পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা স্কেচ। মোট ৪টি বিভাগের আওতায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়াত ও জীবিত বিশিষ্ট বাঙালির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে ‘প্রতিকৃতি’ নামে শতাধিক জীবনী সংবলিত হয়েছে। ২০০৪ সালের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট বাঙালির জীবন ও কর্মভিত্তিক সাক্ষাৎকারমূলক তথ্যচিত্র। সচল প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছে। এ পর্যায়ে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়েদ উল হক, প্রথম বাঙালি মুসলমান চিত্রকর কাজী আবুল কাশেম, কলিস শরাফী, ফিরোজা বেগম, কবি আবুল হোসেন, কবি শামসুর রহমান, নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, ‘বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগসের দর্শক বিনামূল্যে এসব জীবনীচিত্র দেখতে পারেন। প্রায় দুই হাজার স্থানীয় গড়ে উঠেছে একটি গ্রন্থাগার, যা এই জাদুঘরে আসা মনস্ক দর্শকদের বিভিন্ন অনুসন্ধিৎসার খোরাক হয়। www.bangladeshamagra.org প্রতিষ্ঠার দুই বছর পূর্তিতে ওয়েব সাইট উদ্বোধন করে বাঙালি সমগ্র জাদুঘর। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা শেকড়সন্ধ্যানী, সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালি প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ও মতামত পাঠাচ্ছেন উদ্যোক্তাদের কাছে। বিগত ছয় বছরে বাঙালি সমগ্র জাদুঘর চারটি প্রকাশনা নিয়ে এসেছে। চলতি বছরে আরো তিনটি প্রকাশনার প্রস্তুতি চলছে। বইগুলো হচ্ছে- ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, প্রথম বাঙালি মুসলিম চিত্রকর কাজী আবুল কাশেমের আত্মকথা- ‘পূর্বের জানালা’ বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘ঢাকার কয়েকটি জাদুঘর’- ঢাকার বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত জাদুঘরগুলোর দ্রষ্টব্য স্মারক ঠিকানাসহ এনজর পরিচিতি সংবলিত পুস্তিকা। এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী কীর্তিমান বাঙালির আবাসগৃহ ও কর্মস্থলগুলোকে ‘ঐতিহ্য আবাস’ বা ‘হেরিটেজ হোমস’ ‘ঘোষণা করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ, যথা চাকমা, গারো, সাঁওতালসহ এই দেশে প্রচলিত অধিবাসীর ভাষাগুলো যা এখন আর্থ-সামাজিক কারণে চর্চার অভাবে বিলুপ্ত হতে চলেছে সেগুলো সংরক্ষণ, বাংলা সাহিত্যের যশস্বী কবি ও সাহিত্যকদের সেরা রচনাগুলো ইংরেজি ফরাসি ও ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদসহ বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য সহায়তা প্রদান। বাঙালি সমগ্র জাদুঘরের এ সময়ের কাজসমূহের মধ্যে অন্যতম। ঢাকা এলিফ্যান্ট রোডে দুই হাজার বর্গফুট স্থানে বাঙালিসমগ্র জাদুঘর তার কাজকর্মের পূর্ণতাকালে সক্ষম নয়। সরকারি উদ্যোগে বাঙালি সমগ্র জাদুঘর তার স্থায়ী ঠিকানা এবং নিয়মিত সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান লাভ করে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে এগিয়ে যাবে- সকলের সাথে এই প্রত্যাশা আমাদেরও।

0 comments:

Post a Comment