Wednesday, May 12, 2010

রাখাইনদের অবাক করা আদি সামগ্রী

42 comments
উত্তম কুমার হাওলাদার, কলাপাড়া
উপকূলীয় আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের ভাষায় তালপাতার ওপরে লেখা পুঁথি। বৌদ্ধভিক্ষুকে খাবার সরবরাহ করা কাঠের পাত্র। শূকর শিকার করা লেজা। ভারি ছেনি। গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি। সাগরপাড়ের জনপদ কলাপাড়া উপজেলার আদিবাসিন্দা রাখাইনদের ব্যবহৃত পুরনো জিনিসপত্র মানুষ এখনো খুঁজে বেড়ায়। এসব জিনিসপত্র এখন ব্যবহার না লাগলেও রাখাইনদের অনেকের বাড়িতে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। যা দেখে কলাপাড়ায় আগত লোকজন জানতে পারে এ জনপদের অনেক অজানা কাহিনী। শুনতে চায় আদিবাসীদের সেকালের জীবনযাত্রা। হিংস্র শ্বাপদসংকুল জনপদ কিভাবে হয়েছে বাসযোগ্য। কুয়াকাটায় আসা পর্যটকরা এসব দেখা ও জানার জন্য ভিড় জমায় রাখাইন পল্লীতে।রাখাইনদের হারানো ওইসব ঐতিহ্যসামগ্রী এখন পড়ে আছে প্রবীণদের কাছে অযত্নে-অবহেলায়। রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, ব্যবহারের জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা তো দূরের কথা এখন তাদের জীবন-জীবিকাই চলে না। তারা জানান, আদিবাসীদের চরম দুর্দশার কথা। কীভাবে রাখাইনদের এ দেশে আগমন। কীভাবে বসতি স্থাপন শুরু হয় গহিন অরণ্য ও শ্বাপদসংকুল জনপদে। এদের ভিন্নমাত্রার জীবনযাপন সম্পর্কে জানা যায় বহু অজানা তথ্য। একসময়ের দাপটের সঙ্গে এই আদিবাসীদের বসবাসের কথা শুনলে মনে হয় যেন রূপকথার গল্প। অনেক পরিবার টং ঘর তুলে একেক জায়গায় বসতি গড়ে তোলে। প্রত্যেক পাড়ায় পুকুর ছিল নিজেদের ব্যবহারের। যে পুকুরের পানিতে ফুটে থাকত লালপদ্ম। স্বচ্ছ টলমল পানিতে পা ধোয়া ছিল বড় ধরনের অপরাধ। যে কেউ এই নিয়ম অমান্য করলে তাকে জরিমানা করা হতো। রাতেরবেলা রাখাইন পল্লীতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। রাখাইন পল্লীর মাদবরের নির্দেশ অমান্যকারীর তো এলাকায় বসবাস করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। এসব কথা শোনার জন্যে এখনো রাখাইন পল্লীতে ভিড় জমায় দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক-দর্শনার্থী। মানুষ শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বয়োবৃদ্ধ রাখাইনদের দিকে। প্রত্যেক রাখাইন পরিবারের টং ঘরের নিচে থাকত একটি করে তাঁত। নিজেদের পরিধেয় লুঙ্গি, চাদর, মেয়েদের টুপার্টের জামা-কাপড় তৈরি করা হতো ওই তাঁতে। তাঁত বোনার ঠকঠক শব্দ শোনা যেত রাখাইন পল্লীতে হাঁটতে গেলে। এখন কালের বিবর্তনে, আর্থিক চরম দৈন্যদশায় তাঁতসামগ্রী হারিয়ে গেছে। আর জীবিকার প্রয়োজনে অনেকে এখনো কোনোমতে উল বুননের কাজে নেমেছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পর্যন্ত ঠিকভাবে পালন করা হয় না অধিকাংশ রাখাইন পল্লীতে। রাখাইন শিশুদের নিজেদের ভাষা শেখার স্কুল ছিল প্রত্যেক রাখাইন পাড়ায়। যেখানে একজন করে রাখাইন ধর্মীয় শিক্ষক ছিল। এখন নতুন প্রজন্মের কাছে এসব গল্পের মতো মনে হয়। এমনকি খোদ রাখাইন শিশুদের কাছেই এসব অবিশ্বাস্য মনে হয় বলে অধিকাংশ শিশুর মন্তব্য। যেন নিজের সংস্কৃতি নিজের কাছে অচেনা মনে হয়। প্রবীণ রাখাইন নেতা উসুয়ে হাওলাদার (৬৫) জানান, রাখাইনদের প্রত্যেক পল্লীতে নিজেদের ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী অনেক কিছু ছিল। যেমন চিড়া বানানোর জন্য ঢেঁকির আদলে কুড়িয়া ছিল। স্বচ্ছ টলমলে পানি থাকত রাখাইন পাড়ার পুকুরে। যেখানে পা ভিজানো ছিল নিষিদ্ধ। কাকডাকা ভোরে রাখাইন যুবরা পানি সংগ্রহ করত। কাকে গোসল করে গেলে ওই পয়েন্টের ঘোলা পানি সংগ্রহ করত রোগ-বালাই দূর করার আশায়। সাগরপাড়ের জনপদের আদিবাসী রাখাইনদের নিজস্ব পুরনো জিনিসপত্র সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে কলাপাড়া পৌরশহরের রাখাইন পল্লীতে বৌদ্ধবিহার এলাকায় একটি মিউজিয়াম করা যেতে পারে বলে রাখাইনদের অভিমত।

42 comments:

Post a Comment