ঢাকা থেকে সড়কপথে ২১০ কিলোমিটার দূরে খুলনা বিভাগের জেলা ঝিনাইদহ। উত্তরে কুষ্টিয়া জেলা, দক্ষিণে যশোর ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে রাজবাড়ী ও মাগুরা জেলা এবং পশ্চিমে চুয়াডাঙ্গা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। গড়াই, কুমার, ভৈরব, চিত্রা, কপোতাক্ষ, কালীগঙ্গা, ইছামতি, নবগঙ্গা প্রভৃতি এ জেলার উলেস্নখযোগ্য নদ-নদী।
মিয়ার দালান : জেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নবগঙ্গা নদীর তীরে মুরারীদহ গ্রামে প্রাচীন জমিদার বাড়ি মিয়ার দালান অবস্থিত। বাড়িটির প্রধান প্রবেশপথে এখনো কাব্যিক ভাষায় খোদাই করা আছে_'শ্রী শ্রী রাম, মুরারীদহ গ্রাম ধাম, বিবি আশরাফুন্নেসা নাম, কি কহিব হুরির বাখান, ইন্দ্রের আরামপুর নবগঙ্গার উত্তর ধার, ৭৫,০০০ টাকায় করিলাম নির্মাণ, এদেশে কাহার সাধ্য বাধিয়া জলমাঝে কমল সমান, কলিকাতার রাজ চন্দ্ররাজ, ১১২৯ সালে শুরু করি কাজ, ১২৩৬ সালে সমাপ্ত দালান'। এ থেকেই জানা যায় নবগঙ্গা নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলা ১২৩৬ সালে এ প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয় তৎকালীন ৭৫,০০০ টাকা ব্যয়ে। সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে বাড়িটি ধ্বংসের পথে।
নলডাঙ্গা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির : জেলার কালিগঞ্জ উপজেলা সদরের দুই কিলোমিটার পশ্চিমে নলডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। বর্গাকারে নির্মিত এ মন্দিরটির প্রত্যেক পাশের দৈঘর্্য প্রায় ৩৯ ফুট। এর ভেতরে একটি মূর্তি কোঠা ও একটি বারান্দা আছে। মন্দিরের সামনের দোয়ার পোড়ামাটির অলঙ্করণসমৃদ্ধ। ১৮৬৫ সালের কিছুকাল আগে নলডাঙ্গা জমিদার পরিবার কর্তৃক মন্দিরটি নির্মিত বলে জানা যায়। জেলা শহর থেকে জায়গাটির দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার।
বারোবাজার : জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার ইউনিয়নে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপনা। ধারণা করা হয়, বহুকাল আগে এখানে সমৃদ্ধ একটি শহরের অস্তিত্ব ছিল। এখানে এর বেশ কিছু সমৃদ্ধ স্থাপনা টিকে আছে এখনো। এসবের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো_গোরাই মসজিদ, গলাকাটা মসজিদ, জোড়বাংলা মসজিদ, সাতগাছিয়া মসজিদ, হাসিলবাগগড় ইত্যাদি।
গোরাই মসজিদ : ১৯৮৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এ মসজিদটির সংস্কার করে। প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া দেয়ালের এ মসজিদে পূর্ব দিকে তিনটি প্রবেশপথ আছে। উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে দুটি বড় ও দুটি ছোট প্রবেশপথ ছিল। বর্তমানে এগুলো জানালা হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে কালো পাথরের স্তম্ভ আর পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মিহরাব। ভেতর এবং বাইরের দেয়াল পোড়ামাটির নকশায় পরিপূর্ণ।
গলাকাটা মসজিদ : বারোবাজার-তাহিরপুর সড়কের পাশে অবস্থিত পোড়ামাটির কারুকাজ-সমৃদ্ধ প্রাচীন মসজিদ। বর্গাকারে নির্মিত প্রায় ২৫ ফুট দীর্ঘ এ মসজিদের দেয়াল পাঁচ ফুট চওড়া। স্তম্ভ দুটির সামনে পেছনে দুই সাড়িতে ছয়টি মাঝারি আকৃতির গম্বুজ আছে। মসজিদে পাওয়া আরবি-ফারসিতে লেখা শিলালিপি অনুযায়ী ৮০০ হিজরিতে সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইনের আমলে মসজিদটি নির্মিত।
জোড়বাংলা মসজিদ : ১৯৯২-৯৩ সালে খননের ফলে বারোবাজারের এ মসজিদটি আবিষ্কৃত হয়। পাতলা ইটে নির্মিত এ মসজিদটি উঁচু একটি বেদির ওপরে নির্মিত। এ মসজিদের প্রধান প্রবেশপথটি উত্তর-পূর্ব কোনে। এখান থেকে একটি পাকা পথ মসজিদের পাশর্্ববতর্ী দিঘির সিঁড়ি হয়ে তলদেশ পর্যন্ত চলে গেছে। মসজিদের পাশের দিঘিটি অন্ধপুকুর নামে পরিচিত।
সাতগাছিয়া মসজিদ : বারোবাজার থেকে এ মসজিদের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। এ মসজিদটি ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম স্থানীয় জনগণ আবিষ্কার করে। এর দশ বছর পরে ১৯৯৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটি খনন করে। বর্তমানে মসজিদটির মূল ছাদ নেই। তবে এতে ৪৮টি স্তম্ভের উপর ৩৫টি গম্বুজ ছিল। বর্তমানে মসজিদটির পূর্ব, উত্তর দক্ষিণ দেয়ালে সতেরটি প্রবেশপথ রয়েছে, পশ্চিম দেয়ালে আছে সাতটি মিহরাব।
কালু ও চম্পাবতীর সমাধি : বারোবাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গাজী-কালু ও চম্পাবতীর সমাধি। গাজী-কালু ও চম্পাবতীর সমাধি নিয়ে নানান লোককাহিনি প্রচলিত আছে। এরকম একটি হলো বিরাট নগরের শাসক দরবেশ সিকান্দারের পুত্র গাজী। কালু ছিলেন সিকান্দারের পোষ্যপুত্র। কালু গাজীকে খুবই ভালোবাসতেন এবং তাকে অনুসরণ করে চলতেন। গাজীর সঙ্গে ছাপাই নগরের সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার মেয়ে চম্পাবতীর সাক্ষাৎ হলে ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে তারা প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। মুকুট রাজা গাজী ও চম্পাবতীর প্রেমে ক্ষুব্ধ হয়ে তার সৈন্যদের হুকুম দেন গাজী ও কালুকে শায়েস্তা করতে। এ যুদ্ধে মুকুট রাজার সেনাপতি দক্ষিণা রায় গাজী-কালুর কাছে পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গাজীর অনুসারী হয়ে যান। এদিকে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুকুট রাজা চম্পাবতীকে নিয়ে অন্যত্র চলে যান। সেখানেও চলে যান গাজী তার সঙ্গী কালুকে নিয়ে। অবশেষে অনেক যুদ্ধের পর মুকুট রাজার কাছ থেকে চম্পাবতীকে উদ্ধার করে বারোবাজার নিয়ে আসেন। কিন্তু শাহ সিকান্দার চম্পাবতীকে মেনে নিতে পারেননি বলে সঙ্গী কালু ও দক্ষিণা রায়কে নিয়ে জঙ্গলে বেরিয়ে পড়েন।
এখানে গাজী-কালু ও চম্পাবতীর সমাধি ছাড়াও দক্ষিণা রায়ের সমাধিও রয়েছে। গাজী-কালু ও চম্পাবতীকে নিয়ে নানান লোক কাহিনির মতোই এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে তাদের নামে বিভিন্ন সমাধিও আছে।
শৈলকুপা শাহী মসজিদ : জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে শৈলকুপা বাজারের পাশেই অবস্থিত প্রাচীন স্থাপনা শৈলকুপা শাহী মসজিদ। ইটের তৈরি এ মসজিদটিতে সুলতানী আমলের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
মলিস্নকপুরের বটবৃক্ষ : জেলার কালিগঞ্জ উপজেলা থেকে দশ কিলোমিটার পূর্বে মলিস্নকপুরে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি বটবৃক্ষ। এশিয়ার সবচেয়ে বড় বট বৃক্ষ বলা হয় এটিকে। প্রায় ১১ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে এ গাছটি। এ জায়গাটির মালিক ছিলেন রায় গ্রামের নগেন সেনের স্ত্রী শৈলবালা সেন। পরবতর্ীতে এটি সরকারি খাস জমি হয়ে যায়।
কিভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সড়কপথে সরাসরি ঝিনাইদহ যাওয়া যায়। গাবতলী বাস স্টেশন থেকে জে আর পরিবহন (০১৭১৯৮১৮৪৮৩), পূর্বাশা পরিবহন (০১৭১৯৮৮৮৪২৪), চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স (০১৭১২০১৭৪৯৬), শ্যামলী পরিবহন, ঈগল পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এসবি পরিবহন, দিগন্ত পরিবহনসহ আরো অনেক বাস ঝিনাইদহ যায়। ভাড়া ২৫০-২৮০ টাকা।
কোথায় থাকবেন : মাওলানা ভাসানী সড়কে হোটেল ঝিনুক (০৪৫১-৬১৪৬০, নন এসি একক ১০০ টাকা, নন এসি দ্বৈত ২৫০ টাকা, এসি দ্বৈত ৪০০ টাকা)। পোস্ট অফিস মোড়ে হোটেল জামান (০১৭১১১৫২৯৫৪, নন এসি একক ৬০ টাকা, নন এসি দ্বৈত ১২০ টাকা)।
0 comments:
Post a Comment