Tuesday, October 19, 2010

জিপসি

0 comments
ফ্রান্সের উদারনীতিক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি জিপসিদের তাড়িয়েই ছাড়লেন। কয়েক মাস আগেই ফরাসি বিপস্নবের তিন মহান আদর্শ সাম্য, স্বাধীনতা ও সৌভ্রাত্বের দোহাই দিয়ে তিনি জন্মস্থানে মুসলিম নারীদের বোরকা পরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। বোরকার মতো আনখশির ঘেরাটোপকে তার মনে হয়েছে মুসলিম নারীর বন্দিশালা, যা থেকে তাদের মুক্ত করতেই এমন ফরমান। অথচ কী অবলীলায় সেই সাম্য-স্বাধীনতা-সৌভ্রাত্বের ভূমি থেকে ইউরোপের একমাত্র 'অপর' জিপসিদের উচ্ছেদ করতে অনমনীয় হলেন তিনি। একদা ইহুদিদের সঙ্গে ইউরোপীয় ভদ্রসমাজ যে আচরণ করত, জিপসিরাও তার চেয়ে ভাল ব্যবহার পায়নি। ইহুদিদের 'অপরাধ' ছিল যিশুকে হত্যা। আর জিপসিদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ ছিল তারা নাকি যিশুকে বিদ্ধ করে ক্রুশের পেরেক তৈরি করেছিল। অথচ যিশুর মৃতু্যর অনেক পরে উত্তর ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা অঞ্চল থেকে আজকের জিপসিদের পূর্বপুরুষরা মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেয়। অষ্টম-নবম শতাব্দী নাগাদই বেশি সংখ্যায় ভারতীয় যাযাবররা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে বসত করে। এতকাল ধরে তাদের খ্রিস্টীয় মূল সে াতে লীন করার যাবতীয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই মাঝেমধ্যেই তাদের উপর নেমে এসেছে অত্যাচার।

ওরা চোর, গৃহস্তের বিশ্বাস অর্জন করে তাকে সর্বস্বান্ত করে, অভিজাত পরিবারের শিশুদের চুরি করে ভবঘুরে বানায়, নিজেরা অপরিচ্ছন্ন থেকে সমাজে রোগজীবাণু ছড়ায় ইত্যাদি রকমারি অভিযোগ এনে সমাজপতিরা ওদের একঘরে করেছে। তারপর রাতের অন্ধকারে ওদের তাঁবুতে বা ক্যারাভানে আগুন লাগিয়েছে, সেই আগুনে ঘুমন্ত জিপসি শিশুদের ছুড়ে দিয়েছে, ওদের নারীদের ধর্ষণ করেছে, পুরুষদের হত্যা করেছে কিংবা কোমরে-গলায় দড়ি বেঁধে ক্রীতদাস বানিয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে ইউরোপীয় সমাজের জিপসি নিগ্রহের ধরন বদলেছে, প্রকরণ আধুনিক হয়েছে, কিন্তু সেই নির্যাতনের অমানবিক নির্মমতা কমেনি। নাৎসিরা অবশ্য ইহুদিদের মতোই জিপসিদেরও ক্ষতিকর পোকামাকড়ের চেয়ে বেশি কিছু গণ্য করত না। তাই ছয় লক্ষ জিপসিকে (একটি হিসাব অনুযায়ী ১০ লক্ষ) হিটলার গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেন।

ইউরোপের অন্য 'অপর' ইহুদিদের থেকে জিপসিদের সমস্যাটা একটু ভিন্ন। ইহুদিরা সর্বদাই তাদের 'প্রতিশ্রুত ভূমি'তে প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল ফিরবার স্বপ্ন দেখে দিন কাটাত। নাৎসি হোলোকাস্ট একদিন সে স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনাও মূর্ত করে তুলল, গড়ে উঠল ইজরায়েল। কিন্তু জিপসিদের তো তেমন কোনও ঘরে ফেরার স্বপ্ন নেই। তাদের তো ঘরই নেই। ঘর মানেই যে বন্ধন। সেই বন্ধন থেকে মুক্তি পেতেই তো তারা তাদের আদি বাসস্থান ভারতীয় ভূখণ্ড ছেড়ে যাযাবর হয়েছিল।

সহানুভূতিশীল রাজারা, সমাজপতিরা কেউ কেউ তাদের স্থায়ী বাসস্থান ও রুজির সংস্থান করতে চেয়েছেন। কেউ কেউ তাদের জমি দিয়েছেন, চাষ করার সাজসরঞ্জামও, আর বসবাসের নিজস্ব ভিটে। কিন্তু থিতু হওয়ার কোনও ইচ্ছেই যে তাদের নেই। রক্তে তাদের চলার ছন্দ, থেমে যেতে তারা ভয় পায়। সেই অনন্ত চলিষ্ণুতার মধ্যেই তাদের বন্ধনমুক্তি। তাই তারা সর্বদাই ক্যারাভানে সওয়ার। উদার আকাশের নিচে আর ব্যাপ্ত চরাচরে তারা কিছুদিনের ডেরা বাঁধে। কোনও পাকাপাকি ভদ্রাসন গড়ায় তাদের মন নেই। ভারত বা তৃতীয় বিশ্বের অসংগঠিত, এলোমেলো, নড়বড়ে সমাজের আনাচে-কানাচে এমন মুক্ত বিহঙ্গরা যদি বা অন্তরাল খুঁজে নেয়, ইউরোপের সংগঠিত, সুশৃঙ্খল, পরিকল্পিত সমাজে তাদের সৃষ্টিছাড়া অসামাজিকতা বরদাস্ত করা হবে কেন? তাই নিকোলাস সারকোজিরা বরাবর জিপসিদের নিয়ে বিড়ম্বিত থেকেছেন।

ইংল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্পেন, চেক ও সেস্নাভাক প্রজাতন্ত্র, বুলগেরিয়া, ইতালি - কোথাও জিপসি বসতিগুলোকে স্বস্তি দেয়নি ওইসব দেশের শাসক, অভিজাত, বিত্তবানরা। সাম্যপ্রেমী ফরাসি প্রেসিডেন্টের চেয়েও অবশ্য জিপসি দমনে এগিয়ে থেকেছেন ইতালির পেস্নবয় প্রধানমন্ত্রী বারলুসকোনি। তার আমলেই ইতালির দেড় লক্ষ জিপসির আঙুলের ছাপ নেওয়া শুরু হয়। ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে এবং বাবা-মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই নাকি জিপসি শিশুদের আঙুলের ছাপ নেওয়া। আলাদা করে তাদের নাম-পরিচয় নথিভুক্ত করাও সে কারণেই। কেননা ইতালির সর্বোচ্চ আপিল আদালতেরই রায় হল- 'জিপসিদের প্রতি এ ধরনের জাতিগত বৈষম্য অনুশীলন সম্পূর্ণ বৈধ, যেহেতু জিপসি মাত্রেই চোর'। ইতালিতে জিপসিদের এই পরিকল্পিত দানবায়ন অবমানব হিসাবে নাৎসি মৃতু্যশিবিরে তাদের গণহত্যার কথাই মনে পড়ায়। বারলুসকোনির গুরু বেনিতো মুসোলিনি ১৯২৬ সালেই জিপসিদের প্রথম দলটিকে হিটলারের গ্যাস-চেম্বারের খাদ্য হওয়ার জন্য বহিষ্কার করেন। এখন ইতালিতে উগ্র জাত্যাভিমান ও বর্ণবিদ্বেষী বৈষম্যভাবনাকে উস্কে দিতে জিপসি নিগ্রহ একটি নিরাপদ অবসরযাপন। উৎসাহিত হয়ে মাফিয়ারাও জিপসি বস্তিগুলোতে তাদের টার্গেট প্রাকটিস সেরে নিচ্ছে। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে এই জিপসিরা অনেক কিছু দিয়েছে। দক্ষ ঘোড়সওয়ার এরা গোটা ইউরোপেই 'রোমা' নামে পরিচিত। দীর্ঘকাল ধরে ইউরোপের সার্কাসগুলোয় এরাই জন্তু-জানোয়ারের খেলা, বিপজ্জনক ভারসাম্যের খেলা ও তরোয়ালবাজি দেখিয়ে বেড়িয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় কার্নিভাল মানেই জিপসিদের উৎসব। ধাতুর কারিগরি, বাঁশ-বেতের জিনিস বোনায় এদের দক্ষতা পরম্পরাগত। খনিতে-খাদানে, কারখানার বিপজ্জনক কাজে অনেক কম বেতনে এরা কাজ করে গেছে, ইউরোপীয় পুঁজির জন্য সঞ্চয় করেছে সমৃদ্ধ সম্পদ। সঙ্গীত ও নৃত্যে জিপসিদের দক্ষতা জন্মগত। আমরা আন্দালুসীয় ফ্ল্যামেংকো নৃত্যের কথা জানি, জিপসি নাচের যা এক অনুপম উদ্ভাস। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বেলি-ড্যান্সও জিপসিদেরই অবদান। ব্রাহ্ম্স, ফ্রান্জ লিৎজ্ট, বেলা বার্তোক, ভের্দি, রাখমানিকভ-এর মতো দিকপাল সঙ্গীতকাররা জিপসি সঙ্গীত থেকেই আহরণ করেছেন তাদের সিম্ফনি ও হার্মানি। হাঙ্গেরির জ্যাজও এদেরই সঙ্গীত। ইউরোপীয় জ্যাজ তো প্রবাদপ্রতিম জিপসি গিটারশিল্পী জাঙ্গো রাইনহার্টের কাছে ঋণী। চ্যাপলিন, মাইকেল কেন, ইয়ুল ব্রায়নার বা বব হস্কিন্সরা তাদের ধমনীতে প্রবাহিত জিপসি রক্ত নিয়ে রীতিমত গর্বিত ছিলেন। তবু সমাজের চেনা ছকের বাইরে চলতে চায় বলে জিপসিদের উপর সমাজ-সভ্যতা এত খড়গহস্ত।

জিপসিদের বোহেমিয়ান জীবনযাপন, কোথাও শিকড় গেড়ে বসতে না পারার চঞ্চলতা, 'অন্য কোথা-অন্য কোনখানে'র জন্য তাদের ব্যাকুলতা সংগঠিত ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সভ্যতা চায় শৃঙ্খলা, চায় নিয়মের নিগড়, বিধির বিধান। কিন্তু চির-অস্থির জিপসি সেই নিয়মের পিঞ্জরে বাধা পড়তে চায় না। যে শৃঙ্খলা বা রেজিমেন্টেশন যূথবদ্ধতার সমস্বর ঐকতানকে ছকবন্দি করে রাখে, যূথ বা তার প্রতিনিধির সামাজিক অনুমোদনসাপেক্ষে ব্যক্তির স্ফূর্তি ও বুদ্ধির মুক্তিকে প্রশ্রয় দেয়, জিপসির বেপরোয়া, বেয়াড়া, 'নিয়মহারা হিসাবহীন' সৃষ্টি ছাড়া জীবনধর্ম সেই শৃঙ্খলার নৈতিকতা ও বৈধতাকে প্রশ্ন জর্জরিত করে। তাই সুশৃঙ্খল, সংগঠিত ইউরোপীয় সমাজ-সভ্যতার গায়ে গায়ে জিপসিদের লেগে থাকা বিষম অস্বস্তি সৃষ্টি করে। ইউরোপ তাদের শনাক্ত, নথিভুক্ত করতে চায়, তাদের আঙুলের ছাপ, চোখের মণির রঙ হিসেবে রাখতে চায় যাতে প্রয়োজনে সহজে তাদের ঝেড়ে ফেলা যায়। এজন্য প্রথমে তাদের দানবায়ন ঘটাতে হয়, তাদের জাতিগতভাবে, এমনকি জিনগতভাবেও অপকৃষ্ট, হিংসাশ্রয়ী, অপরাধপ্রবণ তক্মা দেগে দিতে হয়। তা হলে আর তাদের হয়ে কেউ চট করে প্রতিবাদমুখর হবে না। জিপসিদের ক্ষেত্রেও সভ্যতাভিমানী ইউরোপীয়রা একই পদ্ধতি অবলম্বন করে চলেছে।

0 comments:

Post a Comment