Friday, October 22, 2010

অ্যাটম বোমার পিছনের নারী

0 comments
জাপানের 'হিরোসিমা' ও 'নাগাসাকি' শহরের ধ্বংসের কথা কে না শুনেছে। যেখানে ফেলা হয়েছিল অ্যাটম বোমা। আর বিস্ময়কর শক্তিশালী এই অ্যাটম বোমার ধ্বংসাত্মক রূপ দেখে শিউরে উঠে সবার হৃদয়। যা অবাক করেছে পুরো বিশ্বকে। আর এই অ্যাটম বোমা তৈরিতে যার অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি একজন নারী। অস্ট্রিয়ার ইহুদি লিজে মাইটনারের জন্ম ১৮৭৮ সালে। বাবা ছিলেন ভিয়েনিজ আইনজীবী, সংস্কৃতিমনা। লিজে মাইটনারের আদর্শ ছিলেন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী মেরী ক্যুরি। ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ এই মহিলা বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে এসে তার অধীনে গবেষণা করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এরপর লিজে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এর কাছে পড়াশোনা করার উদ্দেশে বার্লিনে যাওয়ার অনুমতি চাইলে বাবা অনুমতি দিলেন। বার্লিনে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কাছে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে বার্লিনে যাওয়ার অনুমতি চাইলে বাবা অনুমতি দিলেন। বার্লিনে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কাছে অধ্যয়ন করে তিনি যথেষ্ট জ্ঞানার্জন করলে। এরপর সহকর্মী অটোহান্ এর সঙ্গে যুগ্মভাবে গবেষণা চালালেন প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা সম্বন্ধে। এ গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত হলো 'প্রটোঅ্যাকটিনিয়াম' নামক এক তেজস্ক্রিয়া মৌলের। এরপর লিজে রেডিয়াম, থোরিয়াম এবং তাদের তেজস্ক্রিয় বিভাজনজাত পদার্থ নিয়ে গবেষণা চালালেন। বিটা রশ্মির প্রকৃতি এবং পরমাণু নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত পদার্থ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার গবেষণা সমসাময়িক গবেষকদের প্রেরণা জোগাল। ১৯৩০ সালের পর বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলের দৃষ্টি নিবন্ধ হলো ইউরেনিয়াম মৌলটির ওপর। ১৯৩৪ সালে এনরিকো ফার্সি ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আঘাত হানলেন নিউট্রন কণার দ্বারা। এ ফলে জন্ম নিল নতুন মৌল 'নেপচুনিয়াম'। অতি সামান্য ভর থেকে অসম শক্তি আহরণের তাত্তি্বক পথ দেখিয়েছেন মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন। পরমাণু বিভাজনের দ্বারাই অসম শক্তি আহরণ করা সম্ভব এটা বুঝতে পেরে বিজ্ঞানীরা চালিয়ে যাচ্ছেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বার্লিনে লিজে মাইটনার ও এ বিষয়ে মনোনিবেশ করেছেন। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে তার কাজ। এক মুহূর্তও নষ্ট করার মতো সময় নেই। সহকর্মী অটোহান্ এবং ফ্রেডারিক স্টাসম্যানের সহযোগিতায় লিজে মাইটনার উদ্ভাবন করলেন অতি সংবেদনশীল 'পরিমাণবিক মাইক্রোসকোপ' যন্ত্র। এ যন্ত্রের সাহায্যে সূক্ষ্ম রাসায়নিক ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হলো। এরপর ধীরগতি সম্পন্ন নিউট্রন কণার সাহায্যে ইউনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে আঘাত হেনে তারা এক নতুন মৌল বেরিয়ামের সন্ধান পেলেন।

এ গবেষণা আরো চালিয়ে যাওয়া কিছুকাল বন্ধ রাখতে হলো। কেননা জার্মানদের ইহুদি বিদ্বেষ তখন চরমে উঠেছে। ইহুদি লিজে মাইটনার তখন বার্লিনের 'কাইজার উইলহেল্ম ইনস্টিটিউট-এর পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধানরূপে কাজ করছিলেন। জার্মানির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে অসুবিধা হলো না এ প্রতিভাময়ী মহিলার। তিনি বুঝতে পারলেন তার গ্রেফতার আসন্ন। আসলে নাজি পুলিশ বাহিনী তখন তাকে খুঁজছে গ্রেফতারের জন্য। আর গ্রেফতার হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এটা অনুমান করে লিজে তার জামাকাপড় সুটকেশে ভরে এক সপ্তার ছুটি কাটাবার নাম করে ট্রেন যোগে হল্যান্ড অভিমুখে রওনা হলেন। সেখান থেকে গোপনে পালিয়ে গেলেন স্টকহোমে। এই মহিলা বিজ্ঞানীরা জার্মানি থেকে পশ্চিমা দেশে অন্তর্ধান, পশ্চিমী দেশগুলোরর পক্ষে শাপে বর হল; কেননা তার পরবর্তী জীবনের গবেষণা এনরিকো ফার্মির পরমাণু তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করলো। আর পরমাণু বোমা বানানোর দুরন্ত প্রতিযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিকে পরাস্ত করতে সক্ষম হলো।

এরপর লিজে কোপেনহেগেনে তার ভাইপো অটো ফ্রিশের কাছে গেলেন। অটো ফ্রিশ তখন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী নীল্স বোরের সঙ্গে গবেষণা করছেন। এদিকে হানও স্ট্রাসম্যান লিজের অসমাপ্ত গবেষণা সম্পন্ন করতে লাগলেন। আর তার ফলাফল নিয়মিত জানাতে লাগলেন লিজকে।

২৩৮ এর বিশিষ্ট ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসে এই দুই জার্মান বিজ্ঞানী পারমাণবিক গুরুত্ব সম্পন্ন দুটি মৌলের সন্ধান-পেলেন। ইউরেনিয়াম পরমাণু বিভাজন হলেও হান ও স্টাসম্যান তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ঠিকমতো দিতে পারলেন না। তখন লিজে মাইটনার আবার শুরু করলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এ পরীক্ষায় লিজে দেখলেন ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস তৈরি হয়েছে বেরিয়াম ও ক্রিমট্রন মৌলের দুটি নিউক্লিয়াস এবং এই সময় মুক্তি পেয়েছে প্রচণ্ড শক্তি।

১৯৩৯ সালে লিজে মাইটনার ব্রিটিশ বিজ্ঞান পত্রিকা 'নেচার'-এ এই পরীক্ষার বিবরণ প্রকাশ করলেন। এভাবে শক্তির উদ্ভব ঘটানোর এ প্রক্রিয়ার নাম দিলেন তিনি 'ফিসন'। এ প্রবন্ধ পড়ামাত্রই বিখ্যাত ভ্যানিস পদার্থবিজ্ঞানী নীলস্ বোর ছুটে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে আলবার্ট আইনস্টাইন ও এনরিকো ফার্সির সঙ্গে পরামর্শ করতে। আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টকে লিজে মাইটনারের গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল সম্পর্কে জানানো হলো। রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের আদেশে আমেরিকায় 'ম্যানহাট্রান প্রজেক্ট' গড়ে তোলা হলো পরমাণু বোমা তৈরির জন্য। তৈরি হলো 'অ্যাটম বোম'। জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহর দু'টির উপর যখন সেই অ্যাটম বোমা ফেলা হলো তখন মানুষ জানতে পারল এই বোমা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী লিজে মাইটারের অবদান কতটুকু। লিজে মাইটনার এমন এক মারাত্মক অস্ত্র প্রস্তুতের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত হওয়ায় দারুণ অস্বস্তিবোধ করলেন।

তিনি বললেন, 'অ্যাটম বোম প্রস্তুতির মধ্য দিয়েই হয়তো ভবিষ্যতে বিশ্বে ভয়াবহ যুদ্ধ বন্ধের সূচনা ঘটবে এবং মানবকল্যাণে পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েই মানুষ হয়তো অ্যাটম বোমার মতো মারাত্মক অস্ত্র তৈরির মতো পাপ কাজের প্রায়শ্চিত্ত করবে।



-লায়লা হাসিনা

0 comments:

Post a Comment