Monday, May 17, 2010

বিজ্ঞান জাদুঘর

39 comments
দেশের একমাত্র বিজ্ঞানভিত্তিক জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে। ছিল অল্প কিছু সংগ্রহ। কিন্তু আজ আগারগাঁওয়ের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে রয়েছে বেশ সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। তবে তা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের তৃষ্ণার কাছে নগণ্য। বিশ্ব জাদুঘর দিবস উপলক্ষে সেই জাদুঘর নিয়ে বিস্তারিত লিখছেন সমুদ্র সৈকতজাদুঘর প্রাঙ্গণে ঢুকেই দেখি ইয়া বড় এক ডাইনোসর হা করে আছে। ১৯৯০ সালে শিল্পী তপন কুমার দাসের তৈরি এই ডাইনোসর এতটাই জীবন্ত যে দেখামাত্রই ৬০০ কোটি বছর আগের ভয়ঙ্কর পৃথিবীর চিত্রকল্প ভেসে উঠে। পাশেই মো. শাহজাহান মৃধার নির্মিত 'এ আর খান সূর্যঘড়ি'। ঘড়িতে সকাল ১০টার কাঁটা ছুই ছুই করছে। পাঁচ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম জাদুঘরে। ছয় কোনাকার কাচের ঘরে ছাদ থেকে ঝুলছে ৬১ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২৭ কেজি ভরের 'ফুকোর দোলক'। ভর ও দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় এটি সঠিক মান দেয়। একপাশে অ্যাকুরিয়ামে জীবন্ত হরেক রকম রঙিন মাছ। সমুদ্রের তলদেশের পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষুদ্র প্রয়াস।
ভৌত বিজ্ঞান গ্যালারিতে বিজ্ঞানের নানা সূত্রের প্রমাণ দেখানো হয়। নিউটনের প্রথম সূত্রের পরীক্ষা করে দেখাচ্ছিলেন গ্যালারির তত্ত্বাবধায়ক। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে আসা উৎসুক ছাত্ররা। পাশে থাকা পেরিস্কোপে চোখ লাগিয়ে কেউ দেখছে বাইরের বাগানটাকে।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু কর্নারে সংরক্ষিত তাঁর ব্যবহৃত এক্সরে টিউবের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বিপরীত পাশেই কুদরাত-ই-খুদা কর্নার। সেখানে 'কেটো ল্যাকটম টটোমারিজম'-এর জন্য বিখ্যাত এই বিজ্ঞানীর ব্যবহৃত চশমা, ঘড়ি, কলম, সিল, সিলের প্যাড, পেপার ওয়েট প্রভৃতি রাখা।
এরপরই আছে 'নিজের সঙ্গে ভোজন' নামের একটি বিশেষ কক্ষ। সেখানে এমনভাবে আয়না বসানো আছে যে, চেয়ারে কেউ বসলে তার মনে হবে তিনি তার ছায়াকে সঙ্গে নিয়ে বুঝি খেতে বসেছেন। তার পরের গ্যালারিতে হাঁটতে গিয়ে দেখি আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব চলে যাচ্ছে বিপরীত দিকে। আয়নার কারসাজির নাম দেওয়া হয়েছে 'ভৌতিক হাঁটা'। তার পাশে আরেকটি আয়নাঘর। সেখানে প্রতিফলন ব্যবহার করে গোলক ধাঁধার মতো তৈরি করা হয়েছে।
চন্দ্র মানচিত্রের পাশে আনুশেহ আনসারি কর্নার। আনসারিই প্রথম নারী, যিনি সম্পূর্ণ নিজের খরচে ২০০৬ সালের ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে ঘুরে এসেছেন। এ কর্নারে তাঁর ২টি ব্যাজ, পিন ও স্বাক্ষরিত একটি ছবি আছে।
শিল্পপ্রযুক্তি গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে ১৯৬৫ সালে বিটিভি-র ব্যবহৃত প্রথম ক্যামেরা। আছে একটি পুরনো ইলেক্ট্রনিক মাইক্রোস্কোপও। পুরনো হলেও এর সাহায্যে বস্তুর দশ লাখ গুণ বড় প্রতিবিম্ব দেখা সম্ভব। তবে এ জন্য প্রয়োজন হয় টাংস্টেন ফিলামেন্টের সাহায্যে উৎপন্ন পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ ভোল্ট বিদ্যুৎ।
জাদুঘরে আছে চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানা, চিনির কল, কর্ণফুলী কাগজ কল এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মডেল। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রদানকৃত মিসাইল বোটের মডেল, জাইরোস্কোপচালিত দিক নির্দেশক যন্ত্র জাদুঘরের ব্যতিক্রমী সংযোজন। আছে ৬০০ কেজি ওজনের বলাকা বিমানের একটি ইঞ্জিন। এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উপহার দেওয়া হয়েছিল।
প্রযুক্তি গ্যালারির একটি কক্ষে দেখা যাবে কম্পিউটারের বিবর্তন। এখানে আছে ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে আনা প্রথম এনালগ কম্পিউটার আইবিএম ১৬২০। পরমাণু শক্তি কমিশন যেটা ব্যবহার করত। একটু দূরেই আইবিএম ১৪০১, দেখতে অতিকায় আলমিরার সমান।
এই গ্যালারিতে নতুন সংযোজন করা হয়েছে আধুনিক 'টাচ স্ক্রিন কম্পিউটার'। যাতে আঙুলের স্পর্শে নিমিষেই দর্শনার্থীরা দেখতে পাবেন জাদুঘরের সব তথ্য।
হাঁটতে হাঁটতে দোতলায়। এখানে আছে মজার বিজ্ঞান গ্যালারি। ক্যালিডোস্কোপ নামের একটি যন্ত্রে তিনটি সমতল আয়নাকে সমবাহু ত্রিভুজের তিনবাহুর আদলে বসিয়ে রঙিন তরলের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে মনোরম দৃশ্য। 'বহুরূপী ছবি' অংশে দেখলাম ময়ূরের নানা রূপ। 'ছিন্ন মস্তক' প্রজেক্ট যে কাউকে আনন্দ দেবে। ঊর্ধ্বমুখী বৈদ্যুতিক আর্কটি চমৎকার। পরিবাহী দুটি দণ্ডের মধ্য দিয়ে ২৫ হাজার ভোল্ট বিভব পার্থক্য যুক্ত করলে বিশেষ তড়িৎক্ষরণ সৃষ্টি হয়। তখন তার পাশের তিনটি রিংয়ের ঘূর্ণন দেখে যে কারও দৃষ্টিভ্রম হতে পারে।
মজার বিজ্ঞান গ্যালারির অন্য কক্ষের একপাশজুড়ে আছে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের ছবিসহ নাম, জন্ম-মৃত্যু সাল ও অবদানের কথা। গ্যালারিতে রোবট, লাভা ল্যাম্প, সৌরজগত এবং ভাসমান বলের মডেল আছে। দেওয়ালে কারুকার্যমণ্ডিত বিশাল এক গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের পেন্ডুলামও দোল খাচ্ছে অবিরাম।
জীববিজ্ঞান গ্যালারিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। ৪০ ফুট দীর্ঘ একটি তিমি কি না শুয়ে আছে খটখটে ডাঙ্গায়! না, এটা তিমির কঙ্কাল, বঙ্গোপসাগর থেকে সংগৃহীত। পাশেই রাখা ১৯৯৬ সালের প্যানজেটিক ডলফিন। গ্যালারির একটা অংশে মাতৃগর্ভে ভ্রূণ থেকে ৯ মাস বয়স পর্যন্ত মানুষের বিকাশ দেখানো হয়েছে। পাশে ডিএনএ এবং আরএনএ-এর মডেল। করাত মাছের তিন হাত লম্বা সাদা কাঁটাযুক্ত করাতটি দুর্লভ সংগ্রহ। স্টাফিং এবং অ্যালকোহলের দ্রবণে সংরক্ষিত আছে নানা ধরনের পশু, পাখি, সাপ, ব্যাঙ। অক্টোপাস, সামুদ্রিক শামুক, বাজপাখি, বাদুড়, হনুমান, বনরুই, ঘড়িয়ালের নমুনাগুলো দৃষ্টিনন্দন। আলো ছড়াচ্ছে ১৯৯৮ সালের ২৭ নভেম্বর জাপানের আসিমা দ্বীপপুঞ্জ থেকে সংগৃহীত লাভার অংশবিশেষ। গ্যালারির একদিকের দেয়ালে সংযুক্ত ডাইনোসরের বিবর্তন ও বিলুপ্তির সচিত্র বর্ণনা। পতঙ্গভূক ড্রসেরা বা সূর্যশিশির, ইউট্রিকুলারিয়া বা ঝাঁঝি, ডায়োনিয়া এবং কলসী গাছও যে কাউকে বিস্মিত করবে।
বিজ্ঞান জাদুঘরের পক্ষ থেকে প্রতি শনি ও রবিবার সন্ধ্যার পর দুই ঘণ্টা মহাকাশ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। আকাশ পরিষ্কার থাকা সাপেক্ষে আধুনিক টেলিস্কোপ দ্বারা যে কেউ দেখতে পারেন বলয়সহ শনি, পৃথিবীর নিকটবর্তী শুক্র কিংবা রহস্যময় লালচে মঙ্গল গ্রহ। সময় ধরে জাদুঘরে এলে দেখা পাওয়া যেতে পারে চাঁদের ভেতরের শুষ্ক সাগর, গর্ত কিংবা চাঁদের পাহাড়।
কথা হলো জাদুঘরের প্রধান কিউরেটর সুকল্ল্যান বাছাড়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমরা খুব শিগগির ১৭টি নতুন নমুনা জাদুঘরে সংযোজন করতে যাচ্ছি। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ বিজ্ঞান জাদুঘরের কাজও অনেকখানি এগিয়ে গেছে।'

39 comments:

Post a Comment