Wednesday, May 12, 2010

মূকাভিনয়

0 comments
মূকাভিনয় শিল্পকলার একটি পুরনো শাখা হলেও বাংলাদেশে এর আধুনিক পঠন, পাঠন ও চর্চা খুব বেশি দিনের নয়। অসাধারণ এবং অপূর্ব এই শিল্প মাধ্যমটি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তেমন বিকাশ লাভ করেনি বরং অবহেলিতই হয়েছে বারংবার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূকাভিনয় যথেষ্ট সমাদৃত হলেও এদেশে নিয়মিত চর্চা ও প্রদর্শনীর স্বল্পতার কারণে ভাষাহীন ভাষার এই শিল্প কৌশলটি মার্জিত শিল্প মাধ্যম হিসেবে স্থান করে নিতে পারেনি আমাদের সংস্কৃতির সৃজনে। মূকাভিনয় শুধু বিনোদন নয় বরং ভাষার প্রাচীর ভেঙে সকল জাতির নানাভাষী মানুষের আপনজন হয়ে ওঠার এক মুগ্ধ প্রক্রিয়া। সংলাপকে তুড়ি মেরে শরীর ও মেধার অসাধারণ সমন্বয়ের এই অভিনয় কৌশল ও বাংলাদেশে এর চর্চা নিয়ে লিখেছেন রুদ্র মাহফুজ
মূকাভিনয় শব্দটির উৎপত্তি মূক ও অভিনয় শব্দ দুটোকে কেন্দ্র করে। বাংলায় মূকাভিনয় শব্দটির ব্যবহার সাম্প্রতিককালে হলেও পূর্বে এর পরিচিতি ছিল আঙ্গিক অভিনয় শিরোনামে। অঙ্গ সম্বধীয় সঞ্চালনই কেবল নয় এখানে রয়েছে ভাব, অভিব্যক্তি, রস ও অনুভূতির এক মিশ্রণ। যে রীতি অবলম্বন করে এক বা একাধিক অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রী নির্দিষ্ট মঞ্চে দর্শকের সম্মুখে বাচিক অর্থাৎ সংলাপ ব্যতিরেকে আঙ্গিক, আহার্য ও সাত্ত্বিক বালা ব্যবহার করে মোহ সৃষ্টির মাধ্যমে গতিশীল জীবনের কোনো চিত্র শিল্পসম্মতরূপে অর্থপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন, তখনই তাকে মূকাভিনয় বলা হয়। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে মাইম, প্যান্টোমাইম কিংবা মূকাভিনয় শব্দটির সঙ্গে এদেশের সাধারণ দর্শকের পরিচিতি ছিল না বললেই চলে। তখনকার সময়ে গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন পালা-পার্বণ, ধর্মীয় উৎসব, লোকাচার, ও মেলাগুলোতে সম্পূর্ণ অপরিশীলিত অবস্থায় অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে আনন্দদানের বিষয়টি প্রচলিত ছিল, যা হালের মূকাভিনয়ের পর্যায়ে না পড়লেও অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে অভিনয় করার রীতিকে প্রদেশে মাইমের অস্পষ্ট উৎস হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল হবে না। মুক্তিযুদ্ধের পর একদল খ্যাপা তারুণ্যের হাত ধরে যে নব উদ্দীপনা নিয়ে এদেশে নাট্যচর্চা শুরু হয় তার প্রভাবে শিল্পের এই মাধ্যমটি সম্পর্কে শিল্পানুরাগীদের মাঝে আগ্রহ জাগে। তবে দু’একজন শিল্পী নিজস্ব তাগিদ থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মূকাভিনয়কে পরিচয় করলেও দলগতভাবে এর কার্যক্রম শুরু হতে লেগে যায় আরো বেশকিছু দিন। বাংলাদেশের মঞ্চে স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে মূকাভিনয় পরিচিতি লাভ করে ১৯৭৫ সালে আমেরিকার শিল্পী অ্যাডাম ডেরিয়াসের অভিনয়ের মাধ্যমে। এরপর অবশ্য বেশকিছু বিদেশি মূকাভিনেতা শিল্পকলা একাডেমী, ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজ মঞ্চে মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইংল্যান্ডের নোলারে ও জার্মানির মিলান াদেক। ১৯৮৯ সালে জিল্লুর রহমান জনের পরিচালনায় ‘ঢাকা প্যান্টোমাইম’ দলটি আত্মপ্রকাশ করে। এ কথা বললে বোধকরি অত্যুক্তি হবে না যে ঢাকা প্যান্টোমাইম’ই এদেশে মূকাভিনয়কে পরিচিত করে তোলে। আত্মপ্রকাশের পর বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই দল বেশ ঈর্ষাণীয় সাফল্য করতলগত করে। প্রথম দলগত মূকাভিনয় প্রদর্শনীই নয়, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সাথে যৌথভাবে প্রথম মূকাভিনয় উৎসবের আয়োজনও করে তারা, যাতে অন্তর্ভূক্ত ছিল মূকাভিনয় বিষয়ে একটি সেমিনারও। ১৯৯২’র মে মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলাদেশ-ভারত মূকাভিনয় উৎসবে অংশগ্রহণ ছাড়াও ১৯৯৩’-এর জানুয়ারিতে কলকাতায় প্রথম ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভল অব নন-ভারবাল আর্টস’ শীর্ষক উৎসবে ঢাকা প্যান্টোমাইম শ্রেষ্ঠ দলগত পরিবেশনার গৌরব অর্জন করে। এছাড়া বঙ্গাব্দ ১৪০০ সালকে স্মরণীয় করে রাখার প্রত্যয়ে ভারত-বাংলাদেশ মূকাভিনয় উৎসব, যা কলকাতা ও শ্রীরামপুরে অনুষ্ঠিত হয় সেখানে অংশগ্রহণ, নৈহাটিকে ১৪০১’-এর উৎসবে অংশগ্রহণ ছাড়াও দলটি দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে পারফর্ম করার গৌরব অর্জন করে। তবে দলটির কর্ণধার জিল্লুর রহমান জনের উদ্যোগ ও পরিচালনায় শিল্পকলা একাডেমীতে ক’বার কর্মশালা হয়, যা অনেককেই ভীষণ অনুপ্রাণিত করে তোলে এই মাধ্যমটি সম্পর্কে। বাংলাদেশে মূকাভিনয় শিল্পের বিকাশ, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন যাদের হাত ধরে হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন পার্থপ্রতিম মজুমদার ও কাজী মশহুরুল হুদা। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মূকাভিনয় শিল্প বেশ কিছুদুর এগিয়ে গেলেও একপর্যায়ে তারা দু’জনই বিদেশ বিভূঁয়ে পাড়ি জমান। একদিকে অগ্রজ এই শিল্পীদ্বয়ের অনুপস্থিতি, অন্যদিকে ঢাকা প্যান্টোমাইমের স্থবিরতা, এ সবকিছু মিলিয়ে অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে মূকাভিনয় শিল্প। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর একাডেমিক সিলেবাসে মূকাভিনয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা পরবর্তীতে অনুসরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সংগীত বিভাগেও। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন মাঝে মাঝে তাদের শীতল ঘুম থেকে জেগে দু’একটা কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। হালে এমনই এক কর্মশালা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন নাট্যদলের মূকাভিনেতারা তাদের সৃজন চেতনাকে বিকশিত করতে পেরেছেন। দুনিয়াজুড়ে অনেক প্রথিতযশা মূকাভিনয় শিল্পী এদেশের মাইম অনুরাগীদের অজান্তেই অনুপ্রাণিত করেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন চেকোে াভাকিয়ার বংশোদ্ভূত জ্যাঁ ব্যাপতিস্ত গ্যাসপার্ড ডুবরো, যিনি ফ্রান্সের মূকাভিনয় শিল্পের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ১৮৮৯ সালে ১৬ এপ্রিল লন্ডন শহরে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বখ্যাত নির্বাক ছবির প্রণেতা কিংবদন্তী চার্লি চ্যাপলিন। তার অভিনয়শৈলী মূকাভিনয়কে আধুনিক এক জ্যামিতিক রেখাচিত্রের সন্ধান দেয়। পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক মূকাভিনেতা যার ছাত্র সেই এতিয়েঁ ডেক্রু ফ্রান্সে মূকাভিনয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতিভাবান এই অভিনেতার ছাত্র মার্সেল মার্সো ১৯৪৭’-এ ইউরোপজুড়ে সাড়া জাগাতে সক্ষম হন তার বিখ্যাত চরিত্র ‘ব্রিপ’র মাধ্যমে। এছাড়া আরও রয়েছেন জ্যাঁ লুই বারো, লাডিস লাভ ফিয়ালকা, টমাস জিওস্কি, পল জে কার্টিস, মানি ইয়াকিম, স্যামুয়েল এভিটাল, মানাকো ইওনিয়ামা, থিও লেজোলাস, রলফসারে, মিলান াদেক, নোলারে, যোগেশ দত্ত, নিরঞ্জন গোস্বামী, অশোক চ্যাটার্জি প্রমুখ। বাংলাদেশের কিংবন্তি মূকাভিনেতা পার্থপ্রতিম মজুমদার এদেশে মাইমের অনুশীলন নিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার ভাবতে খুব কষ্ট হয় যে, এদেশে মূকাভিনয় চর্চা তেমন একটা বিকশিত হয় না। প্রচুর মেধাবী ও মাইম অনুরাগী নাট্যকর্মী রয়েছেন, যারা মূকাভিনয়কে জানতে ও শিখতে চান, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার দারুণ অভাব রয়েছে এখানে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এ বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন বলা যায়। তবে সম্প্রতি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কিছু কিছু কাজ হচ্ছে, যা মূকাভিনয়কে আরও প্রসার করবে বলে বিশ্বাস করি। এই শিল্প মাধ্যমটিকে বিকশিত করতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’

0 comments:

Post a Comment