Tuesday, October 19, 2010

হিন্দু দর্শন ও দেবী দুর্গা

37 comments
(হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ, বেদের পর উপনিষদ এবং তারপর পুরাণ। বেদ, উপনিষদ ও পুরাণের ভিত্তিতে হিন্দুদের যে দর্শন, তারই আলোকে রচিত হলো 'হিন্দু দর্শন ও দেবী দুর্গা' শীর্ষক প্রবন্ধ)
বেদে বলা হয়েছে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে তো এক বটেই, তিনি ব্যতীত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে দ্বিতীয় কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই। গাছপালা থেকে শুরু করে পশু-পাখি, পাহাড়-পর্বত, ঘরবাড়ি, কল-কারখানা থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রী, এমনকি গ্রহ-নক্ষত্র, আকাশ-বাতাস সবই আসলে তিনি বা তার বিভিন্ন রূপ।_ বেদে তিনি আরো বলেছেন যে, তার কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই। তবে সর্বশক্তিমান বিধায় ইচ্ছে করলে তিনি সাকার হতে পারেন আবার ইচ্ছে করলে নিরাকার। সাকার রূপটিও আবার নির্দিষ্ট নয়। এটি তার নিজের ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল। অবশ্য ভক্তদের ইচ্ছের উপরও নির্ভরশীল অনেকাংশে। কারণ ঈশ্বরের নির্দিষ্ট কোনো রূপ না থাকায় একেক ভক্ত, একেক রূপে তাকে কামনা করে। তিনি ভক্তদের কল্পিত সেই রূপকেও মর্যাদা দান করেন। এ কারণে গীতায় তিনি বলেছেন_

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম্।

মর্মবর্তানুবর্তেন্ত মনুষ্যা: পার্থ সর্বশ : (৪র্থ অধ্যায় ১১ নং শ্লোক) অর্থাৎ, যে যে রূপে বা ভাবে আমাকে উপাসনা করে, আমি তাকে সেই রূপে বা ভাবেই তুষ্ট করি। মানুষ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সব পথেই আমাতে পৌঁছুতে পারে।

যেহেতু ভক্তদের রুচি ভিন্ন, তাই দেবতাদের রূপও ভিন্ন ভিন্ন। দেবতা তাই অসংখ্য কিন্তু ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। উল্লেখ্য, ঈশ্বরের নিরাকার রূপের নাম ব্রহ্ম, আর সাকার রূপের নাম দেবতা। দেবতা ও ব্রহ্মের সম্মিলিত রূপই ঈশ্বর।

উলি্লখিত হয়েছে, এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই। তাই ঈশ্বর কোনো কিছু সৃষ্টি করেন না, আবার ধ্বংসও করেন না। সবই এক অবস্থায় থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয় মাত্র। আমাদের জন্য যা প্রয়োজনীয়, বস্তুর এমন রূপ লাভকে আমরা বলি সৃষ্টি; আর আমাদের জন্য যখন তা অপ্রয়োজনীয়, তখন তাকে (বস্তুর সেই পরিবর্তিত রূপকে) বলি নষ্ট বা মৃত। কিন্তু মৃত বা নষ্ট বস্তুটিও অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকতে পারে না দীর্ঘদিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারও ঘটতে থাকে পরিবর্তন। আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় মানুষের এমন রূপ যিনি সৃষ্টি করেন, তার নাম ব্রহ্মা। এই রূপটিকে যিনি সংরক্ষণ করেন তিনি বিষ্ণু; আর উক্ত রূপের যিনি ঘটনা পরিবর্তন তাকে আমরা বলি শিব বা মহেশ্বর। কাজেই ঈশ্বরের সাকার অবস্থার রূপ প্রধানত ৩টি।

১. স ষ্টা-ব্রহ্মা, ২. পালক-বিষ্ণু এবং ৩. সংহারক মহেশ্বর। এই দেবতারাও আবার একা নন। মানুষের মতো তাদেরও আছেন স্ত্রী সঙ্গী এবং উভয় মিলেই করেন কর্ম সম্পাদন। যেমন_ ব্রহ্মা মানুষ সৃষ্টি করার পর তাকে সংস্কৃতিবান হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্ত্রী সরস্বতী। বিষ্ণুতে প্রেমের সঙ্গে লক্ষ্মীর ধন জীবকে লালন-পালনে সহায়তা করে। আর শিব বা মহেশ্বর মানুষের দেহের যেমন পরিবর্তন ঘটান, তেমনি তার স্ত্রী পরিবর্তন করেন সমাজের। অশুভ শক্তিতে পরাভূত করে তিনি সামাজিক বিশৃক্সখলা দূর করেন এবং জীবকে দান করেন শান্তি। দুর্গতি নাশিনী এই দেবীই শ্রী শ্রী দুর্গা। শক্তির এই দেবী দুর্গ নামক অসুর বধ করেছিলেন বলে দুর্গা, আবার দুর্গতি নাশ করেন বলেও দুর্গা। তবে তার আরো অনেক নাম আছে। চন্ডি, মহামায়া, কালী, মহিষাসুর মন্দিনী প্রভৃতি তার ভিন্ন ভিন্ন নাম।

মানুষ বৈচিত্র্যের পূজারি। বৈচিত্র্য তার খুব পছন্দ। আর তাই ঈশ্বরকেও সে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রত্যক্ষ করতে চায়। আমরা মানুষ বলেই তার প্রতিটি রূপ হয় মানুষের মতো। তবে জ্ঞান ও বীর্যে আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকার কারণে কখনো তাকে একাধিক হাত, আবার কখনো একাধিক মাথার রূপকে করি পূজা।

বাঙালি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি কর্তৃক আক্রান্ত, শোষিত ও শাসিত হয়েছে। আর এ জন্যই শক্তির দেবী দুর্গাকে তারা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেছে। অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে শুভ শক্তিকে জয়ী করার জন্য বারবার তাই তারা উপনীত হয়েছে মায়ের কাছে, দুর্গার কাছে। আর এ জন্যই দশভুজা দেবী দুর্গা বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় দেবী; আর এ জন্যই দুর্গাপূজা বাঙালির সবচেয়ে বড় পূজা। আমরা প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সব অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে সুখ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করছি।

লেখক : ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য; শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

37 comments:

Post a Comment