Monday, October 18, 2010

মাহলে সম্প্রদায়

0 comments
মাহলে সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের উৎসবের ধরনই আলাদা। এ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কৃষ্টি-কালচার যে এত সমৃদ্ধ নিজ চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। মাহলে সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম 'জিতিয়া'।

রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের (গোদাগাড়ী উপজেলার বাগানপাড়া সিঞ্জাঘুটু গ্রামে) এই নিভৃত পল্লীতে পা রাখতেই কানে ভেসে আসে গান_ 'ডাল ভাত ঝিঙার তরকারি/জিতিয়া পার্বণ ভারি'। গানের সঙ্গে ঢোল আর মাদলের তালে তালে মাহলে তরুণীদের ঝুমের নাচ পুরো উৎসবকে করে তোলে প্রাণবন্ত। ঝুমের নাচ মাহলেদের একটি ঐহিত্যবাহী নৃত্য। যুগ যুগ ধরে এই ব্যতিক্রমী ধরনের নাচকে জিইয়ে রেখেছে এরা। বাংলাদেশে মাহলেদের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার।

রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা ও সিলেটের প্রায় ১১০ গ্রামে এদের বসবাস। অভাব-অনটন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল মাহলেদের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এই উৎসবটি।

তবে শত প্রতিকূলতার মাঝেও ৩ বছর ধরে এটি উদ্যাপন করছে রাজশাহীর মাহলে আদিবাসীরা। জিতিয়া উৎসব ফিরে আসায় আনন্দে উদ্বেলিত এ সম্প্রদায়ের মানুষ। উৎসবের দিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাস ও অন্য যানবাহনে করে অনুষ্ঠানে যোগ দেয় মাহলেরা। নাচে, গানে আর গোত্রীয় রীতিনীতি উপস্থাপনের মাধ্যমে জিতিয়া হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত এক মহামিলনের কেন্দ্রবিন্দু। জিতিয়া মূলত সামাজিক উৎসব। এই উৎসব যে বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিন আগ থেকে সে বাড়ির নারীরা উপবাস করে থাকেন। নিয়ম অনুযায়ী জিতিয়ার দিন দুপুরে মাহলে পুরোহিত সিষ্টি বারে উপবাসীদের গান্ধারি শাক দিয়ে রান্না করা খিচুরি (মাহলে ভাষায় 'সুরে দাকা') খাওয়ানোর মাধ্যমে উপবাস ভঙ্গ করান।

জিতিয়ার আগের রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নারীরা তেলপিঠাসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না করেন। জিতিয়ার দিন সকালে গোসল করে ছোট শিশু থেকে শুরু করে সবাই নতুন জামাকাপড় পরে। সকালে ঢাকঢোল পিটিয়ে ও হারমোনিয়াম বাজিয়ে নেচে-গেয়ে অদ্ভুত এক ছাতার ছায়া দিয়ে পুরোহিতকে জিতিয়াস্থলে নিয়ে আসা হয়। নারীরা নতুন বাটিতে করে পিঠা সাজিয়ে বিচিত্র ঢঙে সমবেত নৃত্যের মাধ্যমে পুরোহিতের হাতে তুলে দেন। মাহলে পুরোহিত সিষ্টি বারে তাদের পিঠা গ্রহণ করে এবং ঈশ্বরের কাছে সবার মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন। এ সময় দাঁড়িয়ে সবাই তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা ও সম্মান প্রদর্শন করে। এভাবে এক সময় পুরোহিতের চারপাশে পিঠার স্তূপ হয়ে যায়। এরপর পিঠাগুলো বিতরণ করা হয় দর্শনার্থী ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মাহলেদের মধ্যে। মধ্যাহ্নভোজ করানো হয় গান্ধারি শাকের খিচুরি দিয়ে।

মাহলেদের অতিথি বরণও দেখার মতো। রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী আসছেন শুনেই হলুদ শাড়ি, রং-বেরংয়ের চুড়ি, পায়ে নূপুর পরা তরুণীরা হাতে ফুলের ডালা নিয়ে দৌড় দেয় পথের দিকে। সঙ্গে যোগ দেয় বাদ্যযন্ত্রের দলও। অজপাড়াগাঁয়ে এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা সত্যিই অকল্পনীয়। এ সবকিছুই নাকি জিতিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

মাহলে সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো জিতিয়া উৎসব। জিতিয়া মাহলে ভাষার শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ 'বিজয়'।

মাহলেদের বিশ্বাস, কোনো এক সময় তাদের জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিল ফুটফুটে সুন্দর এক কন্যাশিশু। শিশুটি বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তার জ্ঞান-গরিমার কথা। দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করল তার কথা শোনার জন্য। এক সময় ওই শিশুটি পূর্ণ যুবতি হলো। এমন মহীয়সী ও সুন্দরী নারীর জন্য উপযুক্ত পাত্র না পাওয়ায় তার বিয়ে হলো না। তবে তার জ্ঞান-গরিমা ও পাণ্ডিত্যের কথা স্বয়ং ঈশ্বর জানতে পারলেন। তিনি স্থির করলেন নারীটিকে তিনি পরীক্ষা করবেন। পৃথিবীতে ভিক্ষুক বেশে আবির্ভূত হলেন ঈশ্বর। ভিক্ষুক বেশ ধারণ করে তিনি পরীক্ষা করতে চাইলেন সেই মহীয়সী নারী কতটুকু অহঙ্কারী, তার মধ্যে শ্রদ্ধাবোধের মাত্রা কতটুকু এবং তার ভালোবাসা আছে কিনা।

ঈশ্বর ভিক্ষুকবেশে বাড়িতে এসে ভিক্ষা চাইলেন। মহীয়সী নারীটি মাহলে পোশাকে শালীনভাবে এলেন এবং ভক্তিভরে প্রণাম করে ভিক্ষুকের কথা শুনলেন। অতঃপর তিনি ভিক্ষুকবেশী ঈশ্বরকে ভিক্ষা দিলেন। নারীটির আচরণ ও সম্মানবোধ দেখে ঈশ্বর তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হলেন এবং চলে যাওয়ার সময় আশীর্বাদ করলেন, তোমার গর্ভে একটি পুত্রসন্তান জন্ম নিবে। এ কথা শুনে নারীটি বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তো অবিবাহিত, কেমন করে আমার সন্তান হবে? ঈশ্বর চলে যাওয়ার সময় তার জানালার পাশে কিছু গান্ধারি শাকের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে অদৃশ্য হলেন। প্রতিদিনের মতো সাত সকালে ওই মহীয়সী যুবতি নারী জানালার ধারে এসে উপাসনার জন্য দাঁড়িয়েছেন। ঠিক তখনই দেখতে পেলেন লক লক করে বেড়ে ওঠা সেই গান্ধারী শাকের গাছ। সূর্যের উপাসনা শেষে শাক তুলে রান্না করে তৃপ্তিসহকারে খেয়ে ফেলেন তিনি। মাহলে সম্প্রদায়ের এই লোক-কাহিনীর মতে, এই গান্ধারি শাক খাওয়ার পর ওই মাহলে নারী গর্ভবতী হন। এ খবর ত্বরিতগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিন্দা ও ধিক্কারের ঝড় ওঠে। কিন্তু ওই নারী বুঝতে পারেন না কিভাবে তিনি গর্ভবতী হলেন। একদিন জন্ম নিল এক পুত্রসন্তান। যার নাম যুগ যুগ ধরে স্মরণ করে মাহলে জাতি। তিনি হলেন_ জিৎবাহন ঠাকুর। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিৎবাহনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা বিস্তারলাভ করতে থাকল। কিন্তু তার পিতৃ পরিচয় নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুললে তিনি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেন। তার মায়ের কাছে পিতৃ পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সূর্য বলে দিতে পারে তোমার পিতার পরিচয়।

সকাল হওয়ার আগেই জিৎবাহন সূর্যের কাছে গিয়ে তার পিতার কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু সূর্য কিছুতেই বলতে চায় না। জিৎবাহন নাছোড় বান্দার মতো জড়িয়ে ধরতে চান সূর্যকে। সূর্য বলে, আমাকে ধরতে এসো না, পুড়ে যাবে। জিৎবাহন বলেন, আমি সতী মায়ের সন্তান। আমার কথার উত্তর না দিলে তোমাকে আজ পূর্ব আকাশে ওঠতে দেব না। এরপর সূর্য বার বার ওঠার চেষ্টা করে আর জিৎবাহন তার সর্বশক্তি দিয়ে সূর্যকে থামিয়ে দেয়। এভাবে দীর্ঘক্ষণ বাদানুবাদ শেষে সূর্য বলল, আমিই তোমার পিতা। আমি জীবনে কারো কাছে হারিনি। আজ তোমার জিদের কাছে হেরে গেলাম। তোমার হলো জিত বা বিজয়। এই স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তোমার পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রচলন হোক জিতিয়া উৎসবের।

লাকমিনা জেসমিন সোমা, রাবি

0 comments:

Post a Comment