Friday, January 28, 2011

ব্রহ্মপুত্র

0 comments
তিব্বতের কৈলাস পর্বতের হিমশীতল জলপ্রপাত, মানস সরোবরের নীলপদ্ম বিধৌত জলরাশি ও চেমাইয়াং ডং হিমবাহের স্রোতে সৃষ্ট ব্রহ্মপুত্র নদের বাংলাদেশ অংশের পুরনো ব্রহ্মপুত্র এখন মৃত প্রায়। এককালের উত্তাল খরস্রোতা পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ আজ যৌবনহারা, মরা খালে পরিণত হওয়ায় পুরনো ব্রহ্মপুত্রের ৫ হাজার ৪৩১ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা এবং তার শাখা ও উপনদীগুলোর প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার অববাহিকায় বসবাসরত বৃহত্তর ময়মনসিংহের ১ কোটি মানুষ আজ ভুক্তভোগী।

ব্রহ্মপুত্র আসামের ধুবড়ি থেকে নেমে দক্ষিণ-পূর্বমুখী কুড়িগ্রামের চিলমারী হয়ে ফুলছড়ি, হরিচণ্ডি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের খোলাবাড়ি এলাকার যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সেখান থেকে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, জামালপুর সদর, ময়মনসিংহ জেলার ময়মনসিংহ সদর, ঈশ্বরগঞ্জ, ত্রিশাল, নান্দাইল, গফরগাঁও, কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর, কটিয়াদি, কুলিয়ারচর, ভৈরব উপজেলার ২৪০ কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর পুরনো ব্রহ্মপুত্র ভৈরবে মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে। এই ২৪০ কিলোমিটার নদীকে ঘিরে দুই পাড়ের মানুষ হাজার বছর ধরে গড়ে তুলেছিল বসতি ও জীবিকা। প্রকৃতি এঁকেছিল জল আর সবুজে। এখন তা ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পুরনো ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ধরে রাখতে যেখানে প্রয়োজন ৩ হাজার কিউসেক পানি, সেখানে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত পুরনো ব্রহ্মপুত্র পানির প্রবাহ গড়ে মাত্র ৩০ কিউসেক। এ সময় নদের পানির গড় গভীরতা মাত্র ১.৫০ মিটার। বর্ষার সময় গড় গভীরতা ৬.৫০ মিটার। পানি প্রবাহের পাশাপাশি স্রোত না থাকায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ। যতদূর চোখ যায় শুধু ধু ধু বালুচর।

হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টা ব্রহ্মার পুত্র। হিমালয়ের কৈলাস পর্বতের (হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ভগবান শিবের আবাসভূমি) পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত মানস সরোবরে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ ফুট উচ্চতায় এ নদের উৎস হওয়ায় উজানে ব্রহ্মপুত্রের গতি ছিল উচ্ছল ও দুর্বার। সপ্তদশ শতাব্দীতে এর প্রশস্ততা ছিল গঙ্গার তিনগুণ। গত শতাব্দীর প্রথমদিকে শেরপুর থেকে জামালপুর ১০ মাইল এবং ময়মনসিংহের কাওনা-মাওনার পাড়ি ছিল ১২ মাইল। ১৭৮৭ সালের বন্যা এবং ১৭৮৯ সালের ভূমিকম্পে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ঝিনাই খাল থেকে যমুনার উৎপত্তি হয়। ব্রহ্মপুত্র তার বিশালত্ব হারায়। তখন থেকে সে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নামে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

দেওয়ানগঞ্জের ফুলছড়ি, হরিচণ্ডি থেকে ভৈরবের পুরনো ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সঙ্গমস্থল পর্যন্ত এই দীর্ঘ প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে পুরনো ব্রহ্মপুত্র তার গভীরতা হারিয়ে শীর্ণ, কঙ্কালসার। পুরনো ব্রহ্মপুত্রের পানিতে বুক ভিজাতে না পেরে তার শাখা নদী আয়মন, আখিলা, ক্ষীরু, শীলা, সুতিয়া, নরসুন্দাসহ কমপক্ষে ১০টি নদীর অস্তিত্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। শুষ্ক মৌসুমে ক্ষীণ ধারায় সামান্য পানি নিয়ে পুরনো ব্রহ্মপুত্র গফরগাঁওয়ের টোক নগরের কাছে ও নরসিংদীর শিবপুরে শীতলক্ষ্যায় এবং নারায়ণগঞ্জ সদরে ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিশেছে। পুরনো ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ কমে যাওয়ায় ক্ষীণ স্রোতধারা শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী এবং বুড়িগঙ্গাকে আর সজীব রাখতে পারছে না।

একদিন পুরনো ব্রহ্মপুত্র বৃহত্তর ময়মনসিংহকে সমৃদ্ধ করেছিল। পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শত শত ঘাট ও বন্দর। পাকিস্তান, ভারত, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য ব্রহ্মপুত্র-যমুনাই ছিল একমাত্র ভরসা। ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্রিটিশরা গড়ে তুলেছিল বাহাদুরাবাদ ও ফুলছড়ি, চিলমারী নৌ-বন্দর। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে ফেরিঘাট বাহাদুরাবাদ-বালাশীতে যাত্রী ও ওয়াগন ফেরি চলাচল করত। পানি সংকটের কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। কালের স্রোতে নতুন প্রজন্মের কাছে এসব গল্প বলে মনে হবে। নদী যখন উচ্ছল, স্রোতস্বিনী ছিল, দুই পাড়ের হাজার হাজার পরিবার যারা এই নদীকে ঘিরে গড়ে তুলেছিল বসতি ও জীবন, পুরনো ব্রহ্মপুত্রের এ করুণ পরিণতিতে তারা আজ পুরোপুরি বেকার। নদীপাড়ের স্থানীয়রা জানায়, নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বর্ষা হলেই দুই কূল ছাপিয়ে ফুঁসে উঠে পুরনো ব্রহ্মপুত্র। প্রতিশোধ নেয় সে মানুষের ওপর। ঘরবাড়ি, ফসল সবকিছু উজাড় করে ফেলে। এভাবে বারবার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। গফরগাঁও উপজেলার ব্রহ্মপুত্র পাড়ের চরআলগী মীরাপাড়া গ্রামের মজিবুর (৪০) জানান, গত বর্ষার আগেও তার দুই একর জমি ছিল। জমিতে ইরি-বোরো ও শাকসবজি চাষ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই চলছিল তাদের সাজানো-গোছানো সংসার। কিন্তু গত বর্ষায় ১ মাসের ব্যবধানে সব ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় আজ সে ভূমিহীন। মজিবুরের স্ত্রী আমেনা খাতুন (৩৫) জানান, দিনমজুরি আর ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর তাদের কোনো উপায় নেই।

আজহারুল হক, গফরগাঁও

0 comments:

Post a Comment