Saturday, January 29, 2011

টেগর লজ, কুষ্টিয়া

0 comments
সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়ায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজ হাতে নির্মিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান 'টেগর লজ' তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। ১৮৯০ সালের শেষ ভাগে রবীন্দ্রনাথ ও কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কুষ্টিয়া রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। জায়গার পরিমাণ তখন আরও বেশি ছিল। ভুসিমাল ও পাটের কারবারের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'টেগর অ্যান্ড কোম্পানি'। এর একাংশে কিছুকাল থাকার প্রয়োজনে তৈরি করেছিলেন টেগর লজ নামের দোতলা বাড়িটি।
পাঁচ লাখ টাকায় এক অমূল্য স্থাবর সম্পদ এখন কিনে নিয়েছে কুষ্টিয়া পৌরসভা। বাড়িটি শহরের মিলপাড়ায়। জায়গা খুব বেশি নয়, সাকুল্যে নয় কাঠা। তার উপরে ছোট্ট দোতলা বাড়ি। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। উত্তর-দক্ষিণ দুই পাশেই বারান্দা। পশ্চিম পাশের কুঠুরির কোণে দোতলায় ওঠার পেঁচানো লোহার সিঁড়ি। বাড়িতে প্রবেশের পথ অবশ্য উত্তর দিকে। একেবারে মিলপাড়ার সড়কের সঙ্গে লাগোয়া। বাড়িটির নাম 'টেগর লজ'। ছোট্ট বাড়িটি মাপে ছোট হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য হওয়ার কারণে মর্যাদা ও গৌরবে এক বিশালতা জুড়ে থাকলেও কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ির যেমন বিপুল খ্যাতি ও পরিচিতি, সে তুলনায় শহরের ভেতরের এ বাড়িটি এখনও প্রায় অপরিচিতই বলা যায়।

ভুসিমালের কারবারের সঙ্গে এখানে কবি আখ মাড়াইকল ও পাটের গাঁট তৈরির কলও স্থাপন করেছিলেন। পরে স্বদেশি আন্দোলনের চেতনায় টেগর লজকে কেন্দ্র করে একটি বড় তাঁতশালাও গড়ে তোলেন। কবিকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করতেন তার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমদিকে ব্যবসা ভালো চললেও পরে টেগর অ্যান্ড কোম্পানি ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকে। পাটের কারবার করতে এসে কবি লাখ টাকার ওপরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে তিনি শ্বশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহির উদ্যমী যুবক যজ্ঞেশ্বরকে ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব দেন। যজ্ঞেশ্বর বহু খেটেখুটে ডুবতে বসা টেগর অ্যান্ড কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে কবি তিন হাজার টাকায় যজ্ঞেশ্বরকে কোম্পানির সমুদয় যন্ত্রপাতি ও মালামাল দান করে দেন এবং 'টেগর লজ'সহ এখানকার দুই বিঘা জমি বছরে ৫০ টাকা খাজনার বিনিময়ে বন্দোবস্ত করে দেন। পরে যজ্ঞেশ্বর এখানে 'যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস' নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন (কারখানা ভবনটি এখনো আছে)। তারপর তো কেটে গেছে বহু দিন। একপর্যায়ে টেগর লজ বেদখল হয়ে যায়। বহু হাত বদল হয়ে অবশেষে এর মালিকানা এসে পেঁৗছায় স্থানীয় আবদুল গফুরের স্ত্রী ছালিমা খাতুনের নামে। আশপাশের জমিও চলে গেছে বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে। তারা নিজেদের নামে কাগজপত্র করে নিয়েছেন। এর মধ্যে বাড়িটি আরও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ২০০৪ সালে পৌরসভার পক্ষে পাঁচ লাখ টাকায় বাড়িটি কিনে নেওয়া হয়। নিচের তলায় একটি বড় হলঘর ও একটি ছোট ঘর রয়েছে। ওপরে রয়েছে তিনটি ঘর। মাঝের ঘরটি একটু বড়। এখানে একটি আলমারিতে রাখা আছে কবির রচিত গ্রন্থমালা। দেয়ালে ঝুলানো কবির আঁকা ১২টি ছবির অনুকৃতি। দক্ষিণে সবুজ ঘাসে ঢাকা একচিলতে আঙিনা। সেখানে ছোট্ট একটি মঞ্চও আছে। উত্তরের প্রবেশপথের সামনেই কবির আবক্ষ মূর্তি। এ মূর্তি ও ছবির অনুকৃতিগুলো ভারতীয় দূতাবাস দান করেছে বলে জানিয়েছেন টেগর লজের তত্ত্বাবধায়ক এসএম নূরুদ্দিন। উপর তলায় আসবাবের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি চেয়ার ও হেলান দিয়ে বসার একটি লম্বা বেঞ্চ। এগুলো শিলাইদহের আসবাবের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে। জরাজীর্ণ দেয়াল ছাড়া আর কিছুই ছিল না বাড়িটিতে। কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী বলেন, 'শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সুপরিচিত হলেও টেগর লজকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের সঙ্গে কবির যে সম্পর্ক, তা অনেকেরই অজানা। ফলে টেগর লজ আজও উপেক্ষিত। টেগর লজকে অনতিবিলম্বে রবীন্দ্র জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় পরিণত করতে তিনি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে ঘিরে কুষ্টিয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পাদপীঠ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

কবি যখন ট্রেনে কলকাতা থেকে আসতেন বা কলকাতা যেতেন, তখন শিলাইদহ যাতায়াতের সময় টেগর লজে বিশ্রাম নিতেন। অনেক সময় রাতযাপনও করেছেন। ব্যবসায়িক কাজের তদারক করেছেন এখানে থেকেই। তিনি কুষ্টিয়া রেলস্টেশন সংলগ্ন বসন্তের ফুলে ভরা একটি কুরচি গাছ নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। '১০ বৈশাখ ১৩৩৪-এ লেখা 'কুরচি' নামে এ কবিতা পরে বনবাণী বইয়ে গ্রথিত হয়।' পদ্মা-গড়াই-হিশনার শীতল স্রোতে প্লাবিত এই অঞ্চল। এখানকার জনপদের ইতিহাস এক নদীর মতোই উদার, মহান ও বিশালতাই পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন প্রথমে জমিদারি ও ব্যবসা দেখাশোনা করার কাজে। পরে মিশে গিয়েছিলেন এখানকার প্রতিটি মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে। তার প্রতিটি লেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের কথা। হয়ত কুষ্টিয়ার অকৃত্রিমতাই মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়ে উঠেছিলেন 'আকাশ ভরা সূর্যতারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ/তাহারি মাঝখানে, আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান'। শুধু জমিদারিত্বই নয়, এ স্থানটি ছিল রবি ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টির এক অপূর্ব প্রেরণা। এখানে বসেই তিনি রচনা করেন মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, বলাকা, ক্ষণিকা, নৈবদ্য প্রভৃতি কবিতা। তার অনবদ্য সৃষ্টি গল্পগুচ্ছের অধিকাংশ গল্প রচিত হয়েছিল এখানেই। এমনকি গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গান সৃষ্টি হয় এ কুষ্টিয়ায়। ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান টেগর লজে। জমিদারির কাজে কিংবা ব্যবসার কাজে কখনো স্বল্প-কখনো দীর্ঘ সময় থেকেছেন এখানেই। এসেছেন একাকী কিংবা সপরিবারে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বোটে, পালকিতে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়াকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছিলেন তার লেখাতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। শিল্প-সাহিত্য, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এখানে সে সময় আবির্ভাব ঘটেছিল বড় বড় প্রভাবশালী মহৎ সব ব্যক্তিত্বের। তাই তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন_ 'ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী আমারই সোনার ধানে গিয়াছে যে ভরি'। বাঙালি চিরকাল যাদের নিয়ে গর্ব করবে, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। তাই তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।

সিরাজ প্রামাণিক, খোকসা (কুষ্টিয়া)

0 comments:

Post a Comment