Friday, January 28, 2011

ডেলফি মন্দির

0 comments
গ্রিসে অবস্থিত ডেলফির মন্দির বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন হিসেবে ইতিহাসে স্থান দখল করে আছে। দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির বলে খ্যাত এ স্থানটির সঙ্গে দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটসহ বহু ইতিহাস খ্যাত মানুষের নাম জড়িয়ে আছে। ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতাসহ নানা কারণে এ মন্দিরটি আজো কোটি কোটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

গ্রিক মিথোলোজি অনুসারে ডেলফি ছিল একটি দৈববাণী প্রকাশের মাধ্যম বা জায়গা। ক্ল্যাসিক্যাল গ্রিক বিশ্বে এই স্থানটির রহস্যময়তা ও গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির হিসেবে তৎকালীন মানুষের কাছে এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। গ্রিসে এ মন্দিরটি স্থাপন করা হয় যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও বহুকাল আগে। ডেলফি নামে এই পাহাড়ি-পাথুরে এলাকায় আধ্যাত্মিক শক্তির বিশেষ প্রভাব আছে বলে ওই সময়কার লোকেদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। এ মন্দিরের দেবতা হলেন অ্যাপোলোর। মজার ব্যাপার হলো_ এ মন্দিরে কোনো যাজক ছিল না। কেবল বিশেষ মতাদর্শের নারীরাই মন্দিরটির যাজিকার পদ পেত। তাদের ডাকা হতো 'পিথিয়া' নামে। এ পিথিয়ারা মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। নিখুঁতভাবে ভাগ্য গণনা করতেন। কেউ সমস্যায় পড়লে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। পিথিয়াদের সাহায্য নিতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ডেলফির মন্দিরে ভিড় জমাত। কিন্তু এ মন্দিরটির অস্তিত্ব ঠিক কোথায় ছিল তা বহুকাল অজ্ঞাত ছিল। মন্দিরটির পুনরাবিষ্কার সম্পর্কে দারুন একটি গল্পের প্রচলন রয়েছে।

বহুকাল আগে ডিমোসরাস নামে এক ব্যক্তির একপাল ছাগল ছিল। একপাল বললে ভুল হবে। বরং বলা চলে একপালের চেয়েও বেশিসংখ্যক ছাগল ছিল তার। তার একার পক্ষে এতগুলো ছাগল চরানো ছিল বেশ কঠিন। সেজন্য ডিমোসরাসকে প্রচুর কষ্ট করতে হতো। পাহাড়ের পাদদেশে তাজা ঘাস খাওয়াতে প্রতিদিনই ছাগলের পাল নিয়ে যেত সে। এভাবেই চলছিল সবকিছু। এরইমধ্যে একদিন দুপুরে ঘটল বিচিত্র এক ঘটনা। একটি বিশেষ জায়গার ঘাস খেয়ে আধা ডজন ছাগল অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল। প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারেননি ডিমোসরাস। এগিয়ে এসে জায়গাটি ভালো করে পরখ করতে পাহাড়ের গায়ে চওড়া এক ফাটল খুঁজে পেলেন ডিমোসরাস। এখন কী করণীয়? ভাবতে ভাবতেই বেশ চওড়া ফাটলটির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। কিন্তু তার মধ্যেও দেখা দিল অস্বাভাবিকতা। একসময় তাকে খুঁজতে অন্য রাখালরা সেখানে এসে পেঁৗছল। সঙ্গীদের দেখে তাদের ভবিষ্যৎ বলতে শুরু করলেন ডিমোসরাস। ঘটনাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। অনেকে জায়গাটি দেখতে চলে এলো। অবশেষে জানা গেল, এখানেই ছিল ভবিষ্যদ্বক্তা যাজিকা 'পিথিয়া'দের রহস্যময় ডেলফির মন্দির। একসময় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির যাতায়াত ছিল ডেলফির মন্দিরে। পরবর্তী সময়ে ফাটলকে কেন্দ্র করে মাটি খুঁড়ে মন্দিরটির বর্তমান আকার খুঁজে পাওয়া যায়। পবিত্রতা এবং ভবিষ্যৎ জানার অন্য এক ভুবন ছাড়াও পাথুরে পিলার আর দেয়ালের সৌন্দর্যমণ্ডিত মন্দিরটির প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্বও কম নয়।

এক সময় পিথিয়াদের সাহায্য নেওয়ার জন্য ওই সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিরাও ডেলফির মন্দিরে এসে ভিড় জমাতেন। ডেলফির মন্দিরের সাহায্যপ্রত্যাশী বিখ্যাত ব্যক্তিদের তালিকায় আছেন সম্রাট আলেকজান্ডার, সম্রাট নিরো ও মহাকবি হোমারের মতো ইতিহাসখ্যাত মানুষজন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্লুটার্ক ডেলফির মন্দির সম্পর্কে বলেন, প্রথমদিকে মন্দিরের পিথিয়া ছিল একজন। কিন্তু খুব অল্প দিনেই মন্দিরের প্রচার ও প্রসার বাড়তে থাকে। সাহায্যপ্রত্যাশী লোকজনের চাপ বাড়ার পর আরও দুইজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সম্রাট আলেকজান্ডার ডেলফির মন্দিরে এসে তার ভবিষ্যৎ জানতে চেয়েছিলেন। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে বিরক্ত হয়ে তখনকার পিথিয়া বলেছিলেন, এখন ভবিষ্যৎ বলার উপযুক্ত সময় নয়, আপনি চলে যান। আলেকজান্ডার এ কথা শুনে রেগে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সম্রাটের জন্য কোনো সময়-অসময় নেই। এখনই বল আমার ভাগ্যে কী আছে? অবশেষে বলপ্রয়োগ করলে পিথিয়া বলেন_ বেশ, শুনতে যখন চান তখন বলি। অনেক বড় বীর হিসেবে পৃথিবী আপনাকে মনে রাখবে, শত্রুরাও আপনার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। কিন্তু আপনার মৃত্যু হবে বিদেশের মাটিতে, শোচনীয় অবস্থায়। পিথিয়ার এ রকম ভবিষ্যদ্বাণী হুবহু ফলে গিয়েছিল। আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয় মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, মারাত্মক জখম হয়ে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৮ অব্দে ডেলফির মন্দির একবার আগুনে পুড়ে যায়। সেটি পুনঃনির্মাণ কাজে মিসরীয় সম্রাট অ্যামেসিসের ব্যাপক অবদান ছিল। সময়ের আবর্তনে ডেলফির মন্দির একসময় পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। তবে এ মন্দিরের প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্ব অনুধাবন করে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ এখন বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এখনো বছরের বিশেষ সময়ে আধুনিক পিথিয়ারা মানুষের ভবিষ্যৎ বলার কাজে এখানে ভিড় জমান। কিন্তু ডেলফির মন্দির আর একে ঘিরে সব গল্প এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।

-রণক ইকরাম

0 comments:

Post a Comment