মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নাম লিখিয়েছিলেন পরিবেশ আইনবিদদের খাতায়। বিষাক্ত পণ্যবাহী জাহাজ প্রবেশে বাধা, বাতিল জাহাজ ভাঙার সময় পরিবেশদূষণ বন্ধ, নির্বাচনী প্রচারণার নামে পরিবেশদূষণসহ বহু জনস্বার্থ মামলার পেছনের মানুষ তিনি। পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্যই তিনি পেয়েছেন গোল্ডম্যান পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকী তাঁকে দিয়েছে ‘হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট খেতাব’। তাঁকে নিয়ে এবারের মূল রচনা।
ভারি অন্যরকম একটা ব্যাপার হলো সেবারের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার। যেখানে-সেখানে যেমন-খুশি দেয়াললিখন। বিকট শব্দে মাইক বাজিয়ে প্রচার-প্রচারণা। রাস্তা আটকে যখন-তখন মিছিল-শোভাযাত্রা। নির্বাচনের আগে এসব একরকম অলিখিত নিয়ম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রাজধানীতে। কিন্তু সেবার, মানে ১৯৯৪ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঠিক আগে আগে এমন ধারার প্রচারণা যেন একদম মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, পুরান ঢাকার কিছু অলি-গলি সেবার সত্যিকার অর্থেই পুরোপুরি ছেয়ে গিয়েছিল কেবল পোস্টার আর পোস্টারে। এমনকি দিনের বেলায়ও কিছু গলিতে ঢোকার আগে হারিকেন বা টর্চলাইট জরুরি হয়ে পড়েছিল। চারপাশের মানুষের কান ঝালাপালা করে প্রচার-প্রচারণা সেটাও চলছিল পুরোদমে। রাজধানীর একটি দেয়ালও সম্ভবত নিস্তার পাচ্ছিল না দেয়াললিখনের হাত থেকে। প্রতিবারের মতো হয়তো এভাবেই ঘনিয়ে আসত নির্বাচনের চূড়ান্ত দিন। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই হয়তো কোনো একজন পদপ্রার্থী নির্বাচিত হতেন রাজধানীর মেয়র। কিন্তু বাদ সাধল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)। এককথায় মোটামুটি বিস্ময়কর একটি কাজ করল বেলা। নির্বাচনের হপ্তাখানেক আগে আদালতে জনস্বার্থে একটি মামলা ঠুকে দিল তারা। তাদের দাবি, নির্বাচনী প্রচারণার নামে এই পরিবেশন দূষণ—আমজনতার দুর্ভোগ বাড়ানো চলবে না কিছুতেই। ঘটনা শুনে নড়েচড়ে বসলেন রাজনীতিবিদেরা। বিস্ময় চেপে রাখতে পারলেন না এমনকি মাননীয় বিচারকও। বিস্ময়কর তো বটেই! সেই ১৮৬০ সালের আইনেই পরিষ্কার বলা আছে এ সবকিছু। অথচ এই আইন নিয়ে এত দিন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। যুগের পর যুগ ধরে চলে এসেছে এই অনাচার। আইন পুরোপুরি সাধারণ জনগণের পক্ষে। আদালতের রায়ও হলো তাই। নির্বাচনী প্রচারণার নামে পরিবেশ দূষণ চলবে না। অবস্থা বেগতিক দেখে পদপ্রার্থীরাও এবার শামিল হলেন সুস্থ নির্বাচনী প্রচারণার পক্ষের মানুষদের কাতারে।
এই মামলার পেছনের মানুষটি ছিলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পরিবেশ আইনজীবী সমিতির হয়ে এটিই ছিল তাঁর প্রথম আইনি লড়াই। সেই আইনি লড়াইয়ে জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু এতটুকুকেই এখনো যথেষ্ট মনে করেন না তিনি। ‘আদালতের রায় আমাদের পক্ষে গিয়েছিল। এখন আগেকার মতো ভোটের আগে যথেচ্ছা প্রচারণা কমেছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটের আগেই এসব বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে প্রার্থীদের। কিন্তু তারপরও আমি মনে করি না আমরা পুরোপুরি সফল হতে পেরেছি।’ বলছিলেন রিজওয়ানা হাসান।
জনস্বার্থে নির্বাচনী প্রচারণার নামে পরিবেশ দূষণ বন্ধের জন্য মামলা। এটি ছিল সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নামের অসম সাহসী এক তরুণ আইনবিদের লড়াইয়ের শুরু মাত্র। এরপর আইনবিদ হিসেবে তাঁকে নামতে হবে আরও অনেক ঘোরতর কঠিন সমরে। এমনকি হুমকি আসবে তাঁর জীবনের ওপরও। সেসব কথার আগে আমরা একটুখানি দেখে নিই রিজওয়ানার শুরুটা।
ঢাকার ধানমন্ডির পুরোনো বাসিন্দা তাঁরা। বাবা সৈয়দ মহিবুল হাসান ও মা সুরাইয়া হাসানের একমাত্র কন্যা তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছিলেন। কিন্তু প্রচলিত ধারার আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার তৈরি করবেন এমন ইচ্ছা ছিল না কোনোকালেই। আইনের সঙ্গে থেকেই যদি করা যায় সমাজের মানুষের জন্য একটা কিছু—এমন একটা কাজই তিনি খুঁজছিলেন মনে মনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার বছরখানেকের মাথায় মিলে গেল তেমনই একটা কাজের সুযোগ। তখন সবেমাত্র মহিউদ্দীন ফারুকের নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছে পরিবেশ আইবজীবী সমিতি। ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে রিজওয়ানা হাসান যোগ দিলেন বেলায়। রিজওয়ানা মোটামুটি ভালোবেসে ফেলেছিলেন তাঁর কাজকে।
সোজা কথায়, আইনের সহায়তা নিয়ে পরিবেশের সুরক্ষা আর জনমানুষের হয়ে কাজ করার লক্ষ্য নিয়েই চলছিল মহিউদ্দীন ফারুকের গড়া এই সংগঠন। কিন্তু ১৯৯৭ সালে হঠাত্ মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিল তাঁকে। রিজওয়ানা হাসানের সামনে তখন একদিকে কাণ্ডারি হারা এক সংগঠন, অন্যদিকে কমনওয়েলথ বৃত্তির লোভনীয় হাতছানি। ভেবেচিন্তে প্রিয় সংগঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়াটাই ঠিক করলেন তিনি।
মৃত্যুর পরোয়ানা
পেটে ভাত নেই। পরনে কাপড় নেই। অভাব আর অভাব। সইতে না পেরে শেষে একদিন ঘর ছাড়ে সাজু। কাজের খোঁজে এখানে-ওখানে ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ এসে কাজ পায় চট্টগ্রামের একটি জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডে। খালি হাতে জাহাজ ভাঙার কাজ। দৈনিক ১৬ ঘণ্টা গাধার খাটুনি। তবুও সাজু নামের ১৯ কি ২০ বছর বয়সী এই তরুণ মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল সব। শুধু দুই বেলা খাবার মিলবে এই আশাতেই হয়তো। কিন্তু সাজুর খুব ছোট্ট এই স্বপ্নের দুনিয়াটাই ভেঙে চুরমার হয়ে যায় একদিন। জাহাজ ভাঙার কাজ করার সময় ওপর থেকে আচমকা ভারী একটা লোহার পাত এসে পড়ে সাজুর ওপরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যায় সাজুর সঙ্গী শ্রমিকটি। ভারী পাতের আঘাতে পুরোপুরি আটকে যায় সাজুর চোয়াল। গুরুতর আঘাত নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে সাজু। কিন্তু টনক নড়ে না সাজুর মালিকপক্ষের। এমনকি সাজুর চিকিত্সার ব্যয় বহনেও কোনো গরজ দেখায় না তারা। খবর পেয়ে এগিয়ে আসে বেলা। সাজুকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য মামলা হয়। বাধ্য হয়ে শেষমেশ রাজি হয় তারা। দীর্ঘ সময় জীবন্মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যায় সাজু। কিন্তু ভারী কাজ করার ক্ষমতা চিরতরে হারিয়ে ফেলে বগুড়ার এই তরুণ।
সাজুর হতভাগ্য সেই সঙ্গীর মতো ভারী বস্তুর আঘাতে প্রতিবছর গড়ে কতজন করে মানুষ মারা যায় জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডগুলোয়? কতজন মানুষ মেনে নেয় পঙ্গুত্ব? বিষাক্ত বর্জ্যে পূর্ণ জাহাজগুলো যখন ভাঙা হয়, তখন কেমন ভয়াবহ পরিবেশগত দুর্যোগ নেমে আসে সৈকতে? বাতিল জাহাজের বিষময় পরিবেশে দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে যে মানুষগুলো, তারা বাকিটা জীবন কেমন করে বাঁচে? এসব প্রশ্ন হয়তো তেমন করে ভাবায়নি এ দেশের কাউকে। অথচ সারা বিশ্বের সচেতন মানুষ জানে বিষাক্ত বর্জ্যে পূর্ণ জাহাজ নিজেদের দেশের ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি। এমনকি জাতিসংঘের একাধিক প্রতিবেদনেও বলা হয়ে গেছে, গ্রিন পিসের তালিকাভুক্ত পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক জাহাজ ভাঙতে দেওয়ার বিপদের কথা। কিন্তু এই অন্যায় বন্ধ করার কায়দা কী? ২০০৩ সালে পরিবেশ দূষণের দায়ে জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এরপর শ্রমিকদের যথাযথ অধিকার আদায়, বিষাক্ত পণ্যবাহী জাহাজের প্রবেশ বন্ধ—এসব কারণে তাঁর দায়ের করতে হয়েছে আরও তিনটি মামলা। তাঁদের ব্যবসার ওপর এমন আঘাত মোটেও সহজে নিতে পারেনি কেউ কেউ। অচেনা জায়গা থেকে একের পর এক হুমকি-ধামকি পাওয়াটা হয়ে ওঠে নিত্যকার ঘটনা। কিন্তু রিজওয়ানা হাসান থেকে গেছেন অবিচল। অবশেষে এ বছরের মার্চ মাসে আসে সাফল্য। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজ ভাঙার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত।
‘লোহা সরবরাহ করে এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। শুধু এই যুক্তিতে বারবার পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু আমি সরকারকে বলব, যদি এই বিধিবহির্ভূতভাবে জাহাজ ভাঙার কাজ চালু থাকে তাহলে আপনারা দাস প্রথাকেও বৈধ করে দিন। আর মাদকব্যবসাও তো কর্মসংস্থান করে। তার মানে কি এই যে আমরা সেটাকেও বৈধ বলে রায় দেব? বিশ্বের পাঁচটা কি সাতটা মাত্র দেশে জাহাজ ভাঙার শিল্প আছে। আর বাকিরা কীভাবে লোহার চাহিদা মেটায়?’ রিজওয়ানা হাসানের এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি সত্যিই সহজ নয়।
বন্ধুর পথে
শুধু জাহাজ ভাঙার শিল্প নয়। জলাশয় ভরাট করে আবাসন তৈরি কিংবা পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার, পাহাড় কাটা, বন ধ্বংস, চিংড়ির ঘের—পরিবেশ আর জনস্বার্থ যেখানেই হুমকির মুখে পড়েছে, তখন সেখানে দেখা মিলেছে রিজওয়ানা হাসান এবং তাঁর সংগঠনের। পরিবেশ আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যই পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা। পরিবেশ আইন বিষয়ে সচেতনতা তৈরির সুবাদে পেয়েছেন পরিবেশ পুরস্কার-২০০৭। পেয়েছেন জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক পুরস্কার। সবশেষে এ বছর তাঁর হাতে উঠে এসেছে ‘পরিবেশের নোবেল’ হিসেবে পরিচিত গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ।
সম্মাননা মিলেছে। দীর্ঘ সংগ্রামের ইনাম হিসেবে পেয়েছেন আদালতের রায়। কিন্তু এখানেই থামতে চান না তিনি। চট্টগ্রামে অবাধে পাহাড় কাটা চলছে, সীতাকুণ্ডে জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড নিয়ে বহু কাজ বাকি; আসল দাবিদার গ্রামীণ মানুষের হাতছাড়া হতে চলেছে মধুপুরের বন, একের পর এক অপরিকল্পিত স্থাপনা তৈরির কারণে বিপর্যস্ত সেন্টমার্টিনস দ্বীপের জীববৈচিত্র্য...।
ধানমন্ডিতে তাঁর নিজের অফিসে টাঙানো সাদা বোর্ডটায় লেখা সমস্যার তালিকাটি এরকমই লম্বা। তাঁর আরও একটা পরিচয়, মেয়ে নেহ্লা আর দুই ছেলে যারির ও জিদানের মা তিনি। একসময়ের সহপাঠী আইনবিদ ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিকের ঘরনি। অফিসের শত কাজ সেরে ঘরে ফিরে ছোট্ট ছেলেটিকে ঘুম পাড়িয়ে যখন তাঁর দ্বিতীয় দফায় কথা বলার ফুরসত মেলে, ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১১টা ছুঁই ছুঁই। সংগ্রামময় পথ পাড়ি দিতে গিয়েই হারিয়েছেন সন্তানদের বহু সুখময় সান্নিধ্য। রিজওয়ানা হাসান জানেন তাঁর লড়াইটা অফিসে সাঁঁটা তালিকার চেয়েও অনেক অনেক বেশি লম্বা। কিংবা কে জানে হয়তোবা তাঁর ফেলে আসা জীবনের চেয়েও অনেক বেশি কণ্টকময়। তার পরও পরিবেশের বন্ধু হয়ে পুরো দেশের মানুষের পাশে থেকেই তিনি কাটাতে চান গোটা জীবন।
0 comments:
Post a Comment