কসমোপলিটন সিটি হিসেবে জুরিখ আর জেনেভার জুড়ি নেই।
সিটি দুটিই গড়ে উঠেছে বিশাল দুটি লেকের ধারে। জুরিখ লেকের আয়তন ৮৮ বর্গ কিলোমিটার আর জেনেভা লেকের ৫৮২ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের দিক দিয়ে জেনেভা লেক বড় হলেও নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা সিটি দুটিতে রয়েছে। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে হয়তো জুরিখ ও জেনেভা দুটি লেকই উপভোগ্য। যদিও জেনেভা লেকের বক্ষে ভাসমান রেস্তোরাঁ ও পানির ফোয়ারাটি ইউরোপের উচ্চতম দর্শনীয় ফোয়ারা। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, লেক সিটি হিসেবে লুজার্নের তুলনা মেলা ভার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩৬ মিটার উঁচু, ১১৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের লুজার্ন লেকের শেষ মাথায় লুজার্ন সিটি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখার মতো। অন্য দুটি সিটির মতো লুজার্ন সিটিও গড়ে উঠেছে লেকের ধারেই। তবে লেক থেকে বেরিয়ে যাওয়া নদীর ধারা ও নদীর ওপর চ্যাপেল ব্রিজ শহরটিকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়।
বলা হয়ে থাকে, জুরিখ ব্যবসায়িক কেন্দ্র আর লুজার্ন হলো সুইসদের প্রাণ। লুজার্ন দেখার পর মনে হলো কথাটা শতভাগ সত্যি। লুজার্নে এসে যখন দাঁড়ালাম তখন বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা। জুরিখ থেকে রেলপথে লুজার্ন মাত্র এক ঘণ্টা ১৫ মিনিটের পথ। এই সময়টা জানালার পাশে পাইনের সারি, পাহাড়, পাহাড়ের মাথায় ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ও সবুজ ঘাসের উপত্যকা দেখেই কেটে যাবে। আকাশে চমত্কার সূর্য। স্টেশন থেকে বেরিয়েই লেকের মিষ্টিমধুর হাওয়ায় মনটা ভরে গেল। কিছু শহর আছে প্রথম দেখাতেই খুব আপন করে নেয়। লুজার্নে পা দিয়েই মনে হলো, আহা, এই তো আমার শহর! স্বচ্ছ নীল লেক, লেক থেকে বেরিয়ে যাওয়া নদী, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে জনজীবন, মনটাকে মুহূর্তে ভালো করে দেয়।
সেন্ট্রাল সুইজারল্যান্ডের বড় শহর লুজার্ন।
মধ্যযুগে ছোট একটি জেলেপাড়া থেকে বর্তমান লুজার্নের সৃষ্টি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রুশ নদীর উত্তর পারে মধ্যযুগীয় পুরোনো শহর। পাথরের ছোট ছোট রাস্তা। ছোট ছোট দোকান, ঘরবাড়ি। পুরোনো শহরের পাশেই গড়ে উঠেছে আধুনিক লুজার্ন। নতুন ও পুরোনোর সমন্বয় দৃশ্যতই সুন্দর। নদীর পাড় ধরে হেঁটে গেলেই টাউন হল, শিল্পী পিকাসোর মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে শিল্পকর্ম ছাড়াও রয়েছে পিকাসোর ২০০ ছবি। আরেকটু হেঁটে গেলেই লোয়েন্ডেন মল বা লায়ন মনুমেন্ট। পাথরের কাদা দিয়ে বানানো ডেনিশ স্থপতি বার্টেল থরওয়ালসেনের মুমূর্ষু সিংহের মূর্তিটি খুবই দর্শনীয়। ১৭৯২ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় ৭৫০ জন সুইস সৈন্যকে পাঠানো হয়েছিল প্যারিসে। কেউ আর ফেরেনি, সিংহের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছিল সবাই। সেই বীরদের স্মরণে ১৮২০ সালে তৈরি হয় লায়ন মনুমেন্ট। লেখক মার্ক টোয়েন মনুমেন্টটি দেখে বলেছিলেন, ‘স্যাডেস্ট অ্যান্ড মোস্ট মুভিং পিস অব রক ইন ওয়ার্ল্ড’।
লুজার্নের আধুনিকতম স্থাপনা প্রায় অর্ধেকটা লেকের ওপর স্থাপিত বর্তমান কনসার্ট হল। এ হলেই হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক সংগীতানুষ্ঠান।
লুজার্নের আকর্ষণ বোধহয় শহরের মধ্যে রুশ নদীর ওপর অপূর্ব সুন্দর চ্যাপেল ব্রিজ।
দ্বাদশ শতকে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি ২০৪ মিটার লম্বা ব্রিজটি ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো কাঠের ব্রিজ। ব্রিজটি খোলা নয়, পুরোটা কাঠের ছাউনি দিয়ে ঢাকা। কাঠের ছাদে অসংখ্য খোদাই করা রঙিন ছবি। ছবিগুলোতে শহর রক্ষাকারী সেইন্ট মউরিটাস ও লুজার্নের ইতিহাস তুলে ধরা। ছবিগুলো দ্বাদশ শতকে রং-তুলি দিয়ে আঁকা হলেও এখনো উজ্জ্বল। ব্রিজের পাশেই ১৪০ ফুট লম্বা ইটের তৈরি কয়েকটি ওয়াটার টাওয়ার। এই টাওয়ারগুলো সে যুগে বন্দিশালা, নির্যাতনকক্ষ, টাকশাল ও ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতো।
যদি কখনো মন খারাপ হয় তবে লুজার্ন লেকের পাশে এসে দাঁড়ান, মন আপনা-আপনি ভালো হয়ে যাবে কিংবা যে কথাটি বারবার চেষ্টা করে বলতে পারছেন না, লুজার্ন লেকের নীল জলের পাশে এসে দাঁড়ান—সে কথাটি হূদয় থেকে বেরিয়ে আসবে। লেক সিটি লুজার্নের আকর্ষণ উপেক্ষা করা কঠিন।
জুরিখ: ১৪.০৮.২০০৯
লিখেছেন লিয়াকত হোসেন, স্টকহোম, সুইডেন ।প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলো'য়
0 comments:
Post a Comment