উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে কয়েকজন বড় নেতা ওই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সাংগঠনিক অবস্থানের বাইরে থেকেও বহু বড় ব্যক্তিত্ব অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা জওহরলাল নেহরুর মতো বিরাট রাজনীতিবিদ মহাত্মা গান্ধী ছিলেন না। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের রাজনীতিতে এমন এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব, যাঁকে নেতা না বলে এক বিস্ময়কর ঘটনা বা প্রপঞ্চ বলাই ভালো। যেকোনো সমস্যা বা সংঘাত—রাজনৈতিক হোক, সামাজিক বা ধর্মীয় হোক—তা অহিংস উপায়ে সমাধানের শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। যে সত্যাগ্রহ নীতি তিনি তাঁর জীবনে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন, অবাস্তব মনে হলেও, তাঁর উদ্ভাবিত সেই সত্যাগ্রহ হলো যুদ্ধের বিকল্প।
গান্ধীজির জীবনের মূলমন্ত্র সত্য ও অহিংসা। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘পৃথিবীকে আমার নতুন কিছু শিক্ষা দেওয়ার নেই। সত্য ও অহিংসা পর্বতের মতো অতি পুরোনো জিনিস।’অতি পুরোনো অর্থাত্ শাশ্বত জিনিসকে তিনি জীবনে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন মানুষের সমাজে তার মূল্য কত বেশি।
১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত গান্ধীর কর্মজীবন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তখন সেখানে বাস করত দেড় লাখ ভারতীয় শ্রমিক ও নাগরিক। ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ শাসকদের দ্বারা তারা ছিল নিপীড়িত। তাদের সামান্য উপার্জনের ওপর আরোপ করা হতো নানা রকম কর, রাস্তাঘাটে তারা হতো অপমানিত, বিচিত্র কালাকানুনে তাদের করা হতো নাজেহাল, মানবাধিকার বলে তাদের কিছু ছিল না। একটি মামলার ওকালতি করতে তিনি গিয়েছিলেন প্রেটোরিয়ায়। সেখানে তিনি ভারতীয় শ্রমিকদের দুর্দশা দেখে তাদের পাশে দাঁড়ান। তাতে নিজেও নিপীড়িত হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর যে মানবাধিকার আন্দোলন, এর তুলনা পৃথিবীতে বিরল।
আগেই বলেছি, প্রথাগত রাজনৈতিক নেতা তিনি ছিলেন না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আফ্রিকা থেকে এসে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস সম্মেলনে যোগ দেন। কোনো কংগ্রেস সম্মেলনে সেটিই তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা। তিনি লক্ষ করলেন, সব বড় বড় নেতা দামি পোশাক পরে গরম বক্তৃতা দিতে প্রতিযোগিতা করছেন। তিনি দায়িত্ব নেন স্থায়ী ও অস্থায়ী পায়খানাগুলো পরিষ্কার করার। ঝাড়ু ও বালতিতে পানি নিয়ে তিনি পায়খানা সাফ করতেন।
ভারতবাসীর মুক্তির সংগ্রামে ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেন গান্ধী। ১৯১৪ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি সারা ভারত ঘুরে মানুষের অবস্থা দেখেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী বছর দুই তিনি বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯২০ সালে বালগঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুর পর কংগ্রেস অনেকটা নেতৃত্বে দুর্বল হয়ে পড়ে। গান্ধী এগিয়ে এলেন। এবারও তাঁর হাতিয়ার অহিংসা। ১৯২০ সালে তিনি শুরু করেন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। সে এক অভূতপূর্ব রাজনীতি। এমন এক অসহযোগ আন্দোলন, যার তুলনা উপমহাদেশের দুই হাজার বছরের ইতিহাসে দেখা যায় না।
গান্ধীর অহিংসা ও সত্যাগ্রহ হলো অন্যায়, অবিচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহ। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের স্বভাবে শান্তি ও স্বাধীনতার জন্য সহজাত উপাদান রয়েছে। সেগুলোর সদ্ব্যবহারে বিশ্বে শান্তি স্থাপন ও মানুষের মুক্তি অর্জন সম্ভব।
অসহযোগ আন্দোলনের পরে তাঁর নেতৃত্বে আরেক বড় আন্দোলন ১৯৩০ সালের ‘লবণ সত্যাগ্রহ’। এরপর ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন। এসব গণ-আন্দোলন ব্রিটিশ রাজত্বের ভিত্তি টলিয়ে দেয়। ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভারত ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
১৯৩৩ সালের পর গান্ধীজি কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। কিন্তু তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের পিতৃপ্রতিম শীর্ষনেতা। তবে জীবনের শেষ চার-পাঁচ বছর তিনি তাঁর সহকর্মীদের ক্ষমতার রাজনীতির মোহ লক্ষ করে হতাশ হন। ফলে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে থেকেও তিনি হয়ে পড়েন নিঃসঙ্গ। তখন তাঁর ভূমিকা হয়ে পড়ে মানবতাবাদী দার্শনিকের।
মহাত্মা গান্ধীর জীবনের শেষ বড় কর্মযজ্ঞ নোয়াখালী শান্তি মিশন। নোয়াখালীর দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় তিনি ১৯৪৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৭-এর মার্চ পর্যন্ত চার মাসের বেশি একনাগাড়ে অবস্থান করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭-এর পরও যে কয়েক মাস তিনি জীবিত ছিলেন, সমাজে ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
রাজনীতিবিদ হিসেবে গান্ধী হয়তো ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু মানুষ গান্ধী, মানবতাবাদী গান্ধী, শান্তিবাদী গান্ধী ও সত্যসন্ধানী গান্ধীর কোনো তুলনা উপমহাদেশে নেই। যে সত্য নিজের বিরুদ্ধে যায়, তাও তিনি অসংকোচে প্রকাশ করেছেন। তাঁর ছিল বিজ্ঞের মতো বৈষয়িক বুদ্ধি, কিন্তু শিশুর মতো সরল মন। তিনি ছিলেন অতি বিনয়ী। প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন বন্ধুর আন্তরিকতা নিয়ে। ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি এই মহান রাজনৈতিক সাধকের জীবনাবসান ঘটে আততায়ীর হাতে।
0 comments:
Post a Comment