Wednesday, October 7, 2009

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতলেন তিন আলোকবিজ্ঞানী

0 comments
চার্লস কাউ, উইলার্ড বয়েল ও জর্জ স্মিথকে পদার্থবিজ্ঞানে ২০০৯ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। সুইডেনের 'দ্য রয়েল সুইডিশ একাডেমি' মঙ্গলবার এ ঘোষণা দেয়। ফাইবার অপটিক ক্যাবল এবং কাচের হালকা তার উন্নয়নে যুগানত্দকারী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চার্লস কাউকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। হালকা ও সূক্ষ্ম এ তারের মধ্য দিয়েই ফোন ও নেটডাটা আলোকমাধ্যমে পরিবাহিত হয়। অন্য দুই বিজ্ঞানী বয়েল ও স্মিথকে তাদের উদ্ভাবিত চার্জড কাপলড ডিভাইস বা সিসিডির জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এ সিসিডি বা আলোক নির্দেশকই সব ধরনের ডিজিটাল ক্যামেরার বৈদু্যতিক চোখ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খবর বিবিসি, এএফপি ও এপির।

দ্য রয়েল সুইডিশ একাডেমি জানায়, দুটি বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের জন্য এবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। উদ্ভাবিত এ দুটি উপকরণ বর্তমান পৃথিবীর নেটওয়ার্কভিত্তিক সমাজ গড়ায় গুরম্নত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। উপকরণ দুটির উদ্ভাবক তিন বিজ্ঞানীকে 'মাস্টার অফ লাইট' আখ্যায়িত করে নোবেল কমিটির জুরি বলেন, আজকের পৃথিবীতে তথ্য-প্রযুক্তিতে যে বিপস্নব সাধিত হয়েছে কাউ, বয়েল ও স্মিথ সেই বিপস্নবের সারথী।
একাডেমির ঘোষণায় বলা হয়, পুরস্কারের অর্ধেক অর্থ চার্লস কাউকে দেয়া হবে। চীনের সাংহাইয়ে জন্মগ্রহণকারী কাউ একই সঙ্গে বৃটিশ ও মার্কিন নাগরিক। তবে মূলত হংকংয়েই বসবাস করেন তিনি। পুরস্কারের বাকি অর্ধেক অর্থ অন্য দুই বিজয়ী উইলার্ড বয়েল ও জর্জ স্মিথকে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হবে। তারা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের মারে হিলের বেল ল্যাবরেটরিতে গবেষণারত। বয়েল একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নাগরিক।
একাডেমির ঘোষণায় আরো বলা হয়, ১৯৬০-এর দশকে বৃটেনে গবেষণার সময় কাউয়ের যুগানত্দকারী উদ্ভাবনই বিজ্ঞানীদের সামনে ফাইবার অপটিককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। তার গবেষণালব্ধ ফাইবার অপটিকের মাধ্যমেই আলোকে এক ভগ্নাংশ সেকেন্ডের মধ্যে অনেক দূরে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এ ফাইবার অপটিকের কল্যাণে গড়ে ওঠা যোগাযোগ প্রযুক্তিই আজকের পৃথিবীর অনিবার্য অনুষঙ্গ। চুলের মতো সূক্ষ্ম এ ক্যাবল অত্যনত্দ দ্রম্নতগতিতে বিশ্বজুড়ে তথ্য বহন করছে। এ প্রযুক্তির ওপরই গড়ে উঠেছে টেলিফোন নেটওয়ার্ক। কাউয়ের এ উদ্ভাবন ব্যতীত তীব্র গতিসম্পন্ন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রযুক্তিও সম্ভব হতো না।
দ্য রয়েল সুইডিশ একাডেমির জুরি জানান, উইলার্ড বয়েল ও জর্জ স্মিথের গবেষক দলই সর্বপ্রথম ডিজিটাল সেন্সর- সিসিডি উদ্ভাবন করে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৯ সালে বয়েল ও স্মিথ এ আলোক নির্দেশক যন্ত্রটি তৈরি করেন। ডিজিটাল ক্যামেরা ছাড়াও মানবদেহের রোগ নির্ণয় ও মাইক্রোসার্জারির মতো গুরম্নত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাজে এ সিসিডি ব্যবহার করা হয়।
নোবেল পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। বিজয়ীরা এ অর্থ ছাড়াও একটি করে ডিপেস্নামা সনদ ও মেডেল পাবেন।
প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক যায়যায়দিন" পত্রিকায়।
*********************************************************************************
দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ এখন সবার এগিয়ে যাওয়ার অনিবার্য অনুষঙ্গ। আর দ্রুতগতি সত্যিই দিতে পারে অপটিক্যাল ফাইবার বা আলো প্রবাহী তন্তুর তার।এখন হাতে হাতে দেখা যায় ডিজিটাল ক্যামেরা। এ ক্যামেরার মূল উপাদান চার্জড কাপলড ডিভাইস (সিসিডি)। এই দুই উদ্ভাবন গোটাদুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির (আইসিটি)। তার স্বীকৃতি মিলল ২০০৯ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারে। ৬ অক্টোবর ঘোষণা করা হয় পদার্থবিজ্ঞানে এ বছরের নোবেলপুরস্কার। যুগান্তকারী এই দুই উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী চার্লস কে কাও, উইলার্ড এস বয়েল ও জর্জ ই স্মিথ। আমরা ও আমাদের চারপাশের যা কিছু আছে, সবকিছুকে জানার যে অবিরাম চেষ্টা ও ছোট-বড় বিশাল বিশাল সব আয়োজন—এসব নিয়েই বিজ্ঞান। তাই এখন মানুষ ও সভ্যতা মানেই বিজ্ঞান। মানুষ ও সভ্যতার শুরু থেকেই শুরু হয়েছে বিজ্ঞানের পথচলা। তবে এ পথচলাটা একটু অন্য রকম বাঁক নিয়েছে বিংশ-একবিংশ শতাব্দীতে এসে। কিছুদিন আগেও সবাই ভাবত, বিজ্ঞান মানেই জানার চেষ্টা, নতুন কিছু আবিষ্কারের তাড়না। কিন্তু বর্তমানে মানুষ দেখছে, শুধু জানার চেষ্টাই বিজ্ঞান নয়, জানাটাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেও রয়েছে নতুন এক বিজ্ঞান, নতুন এক সম্ভাবনা। নতুন এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নাম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। রূপকথার গল্পের মতোই আইসিটি দূর-দূরান্তের সব মানুষকে সমানভাবে দিচ্ছে তথ্য, জ্ঞানসহ নানা কিছু। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশাল অর্জন মানুষের অফুরান ভালোবাসার পর এবার পেল নোবেল পুরস্কার ২০০৯।


২০০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী তিন বিজ্ঞানীর তিনজনই এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিপ্লবের অগ্রপথিক।

১৯৫০ থেকে ৬০ সাল। সেই সময়ের কথা। আলো নিয়ন্ত্রিতভাবে কীভাবে দূর-দূরান্তে পাঠানো যায়, সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে।

আলো পাঠানোর জন্য অনেক ধরনের মাধ্যমের মধ্যে একটা ছিল কাচ। তবে বিজ্ঞানীরা বারবার হতাশ হচ্ছিলেন। কারণ, কাচের ভেতর দিয়ে সংকেত বা আলো পাঠানো হচ্ছিল, কিন্তু তা কিছুদূর গিয়েই দুর্বল হয়ে পড়ছিল। ফলে সেটি আর বেশি দূর যেতে পারছিল না। বিজ্ঞানীরা দুর্বলতার অনেক কারণ ভাবলেন—কানেক্টর, কাচের জ্যামিতিক আকার-আকৃতি, আলোর উত্স ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কিছুদিন পর ১৯৬৬ সালে চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী চার্লস কে কাও এসে দেখালেন, কাচের আকার-আকৃতি বা আলোর উত্স নয়, বরং সংকেত দুর্বল হয়ে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে কাচের মধ্যে খাদ বা ভেজাল। তখন কাও ও তাঁর সহকারীরা বিভিন্ন তথ্যপ্রবাহী কাচ বা তন্তু নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে তাদের উত্সাহিত করেন শুদ্ধ কাচ নির্মাণে, যাতে কাচে সংকেত বা আলোর শোষণ সর্বাপেক্ষা কম হয়। তাঁরা নির্মাতাদের জন্য সংকেতের এ ক্ষতির ন্যূনতম মান বেঁধে দিয়েছিলেন ২০ ডেসিবল। পরে ১৯৭০ সালে তৈরি হলো তখনকার সময়ে সর্বনিম্ন ক্ষতিসম্পন্ন আলোকবাহী কাচ, যার নাম দেওয়া হলো অপটিক্যাল ফাইবার বা আলোবাহী তন্তু, যার মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম সম্পন্ন হয়েছিল দূর-দূরান্তে আলো তথা সংকেত তথা তথ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ। এ বছর নোবেল বিজয়ী তিনজনের একজন হলেন চার্লস কে কাও। তবে পুরস্কারের অর্ধেকটাই তাঁর ভাগে।পুরস্কার পাওয়ার মূল কারণ এই অপটিক্যাল ফাইবার, যার সাহায্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবী চলে এসেছে এক ছাতার নিচে।

চার্লস কে কাওয়ের গবেষণা প্রসঙ্গে তাঁর সহকর্মী স্ট্যান্ডার্ড টেলিকমিউনিকেশন ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী রিচার্ড এপওয়ার্থ বলেন, যানবাহনে চাকা যা করছে, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে ঠিক সেটাই করছে অপটিক্যাল ফাইবার। এ ফাইবারের সাহায্যেই অনেক দ্রুতগতিতে অনেক দূরে অনেক কম শক্তি ক্ষয় করে তথ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। আগে যেখানে কিলোবাইট, মেগাবাইট ছিল, সেখানে এখন গিগাবাইট তো বটেই পেটাবাইট, এক্সবাইট গতিও চলে এসেছে। তথ্য বোধহয় এর আগে এত স্বাধীনতা পায়নি।

কাও ১৯৭০ সালে অপটিক্যাল ফাইবারে যে গতিতে সংকেত পাঠিয়েছিলেন, বর্তমানে সংকেত আদান-প্রদানের গতি তার চেয়ে এক লাখ গুণ বেশি।

ক্যামেরা এখন সবার হাতে হাতে। ডিজিটাল ক্যামেরার কল্যাণে কমবেশিসবাই এখন আলোকচিত্রী! খেয়াল করুন, আগেকার দিনের ক্যামেরার দাম কিন্তু ডিজিটাল ক্যামেরার চেয়ে কম ছিল, এর পরও ম্যানুয়াল ক্যামেরা পারেনি পাড়ায় পাড়ায় আলোকচিত্রী তৈরি করতে। কেন? সম্ভবত ছবি তুলে ছবি প্রক্রিয়া করার ঝামেলার কারণে। সেই ক্যামেরাগুলোয় আলো এসে পড়ত ফিল্মের ওপর। পরে সেই ফিল্ম ধোয়ামোছা করে নেগেটিভ বের করে সেটা থেকে ফটো প্রিন্ট করা হলে তবেই দেখা যেত এক দিন বা এক সপ্তাহ বা এক মাস আগে তোলা ছবি। তার ওপর ছিল কয়েক দিন পরপর ফিল্ম বদলানোর ঝামেলা আর খরচ। কিন্তু ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেল কমিউনিকেশন ল্যাবরেটরিজে কর্মরত বিজ্ঞানী উইলার্ড এস বয়েল ও জর্জ ই স্মিথ সিসিডি (চার্জড কাপলড ডিভাইস) নামের একটি সেন্সর উদ্ভাবন করেন, যা আলোকে ফিল্মে বন্দী করার পরিবর্তে বিশাল সংখ্যার পিক্সেলে রূপান্তর করে, যা মূলত রঙিন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দু এবং ডিজিটাল ইমেজের কোষ। তারপর শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে সিসিডি আজ স্থান পেয়েছে ক্যামেরার মধ্যে, আমজনতাকে করে তুলছে আলোকচিত্রী।

১৯৬৯ সালে বেল ল্যাবরেটরিতে বয়েল ও স্মিথের আবিষ্কার ১৯২১ সালে নোবেল বিজয়ী আলবার্ট আইনস্টাইনের আবিষ্কৃত ফটো ইলেকট্রিক এফেক্টের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। শব্দের জন্য ট্রানজিস্টর যেটা করেছে, আলোর জন্য সিসিডি তা-ই করেছে। আর এই সিসিডির কারণে ছবি তোলাটাই যে শুধু সহজ হয়েছে তা নয়, ছবি আদান-প্রদানও হয়েছে অনেক সহজ এবং ব্যবহারোপযোগী।

সিসিডি, ডিজিটাল ছবির পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও নিয়ে এসেছে নতুন নতুন বিপ্লব ও সম্ভাবনা। আগেকার টেলিস্কোপগুলোতে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও মহাকাশচারীদের নিয়মিত ক্যামেরার শাটার চাপা এবং ফিল্ম বদলানোয় ব্যস্ত থাকতে হতো। বর্তমানে আর এই উটকো ঝামেলা নেই। যেমন, হাবল টেলিস্কোপে ছয়টি সিসিডি আছে। বয়েল ও স্মিথ এ সিসিডি আবিষ্কার করেছিলেন মহাকাশ গবেষণাসংক্রান্ত কাজে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে। তাঁদের এই উদ্ভাবন ছাড়া মঙ্গল গ্রহের ছবি সংগ্রহ কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এ দুই বিজ্ঞানীই আলো ও কৃত্রিম উপগ্রহনির্ভর (অপটিক্যাল ও স্যাটেলাইট) যোগাযোগ, ডিজিটাল ও কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটিং ও রেডিও অ্যাস্ট্রোনমিতে কাজ করেছেন।

সভ্যতার শুরু থেকে বিজ্ঞানীরা নানাভাবে জীবন সহজ ও আনন্দময় করে তোলার চেষ্টা করছেন এবং পৃথিবীকে ছোট করে সবাইকে কাছাকাছি করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

তথ্যপ্রযুক্তি বোধহয় এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের তথ্যপ্রযুক্তিকে বিশাল সম্মান জানানোর মাধ্যমে শুধু বিজ্ঞানের নয়; জয় হলো মানবতার, জয় হলো ভালোবাসার।


প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক প্রথম আলো" পত্রিকায়।

0 comments:

Post a Comment