আমাদের দেশে ডেঙ্গুজ্বর হয় সাধারণত জুলাই থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। বৃষ্টির সঙ্গে ডেঙ্গু সম্পৃক্ত। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে সারা বছর বৃষ্টি হয়, ডেঙ্গুও সারা বছর হয়।
উপসর্গ
ডেঙ্গুজ্বর হলে বিশেষ তিনটি উপসর্গ দেখা যায়। প্রচণ্ড জ্বর, শরীরে র্যাশ ওঠা ও রক্তক্ষরণ।
প্রচণ্ড জ্বর
সাধারণত প্রথম দিন থেকেই ভীষণ জ্বর (১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) দিয়ে ডেঙ্গু শুরু হয়। ভীষণ শরীর ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা অনেক ক্ষেত্রেই থাকে। তবে হাঁচি-কাশি থাকে না। ষষ্ঠ দিনে জ্বর নেমে যায়। দিন গোনা ঠিক থাকলে সাত দিনের বেশি জ্বর থাকলে সেটাকে ডেঙ্গু না ভাবাই ভালো। স্যাডল ব্যাক ফিভার (প্রথম দুই দিন জ্বর থাকে, মাঝে দুই দিন না থেকে আবার জ্বর আসা) ডেঙ্গুজ্বরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
শরীরে র্যাশ ওঠা
জ্বরের ষষ্ঠ দিনে ডেঙ্গুর র্যাশ বের হয়। সারা শরীর লাল দানায় ভরে যায়। মাঝেমধ্যে দানাবিহীন পরিষ্কার ত্বক দেখা যায়। দেখতে ভীতিপ্রদ হলে ও এ র্যাশ আসা অর্থ রোগ সেরে যাচ্ছে। অবশ্য জ্বরের সঙ্গে র্যাশ থাকলেই সেটা ডেঙ্গু নয়। জ্বরের দ্বিতীয় দিনে র্যাশ হওয়া মানে স্কারলেট ফিভার। হামের র্যাশ আসে চতুর্থ দিনে।
রক্তক্ষরণ
রক্তক্ষরণ ছাড়াও ডেঙ্গুজ্বর ও ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (রক্তক্ষরণী জ্বর) হতে পারে। রক্তক্ষরণ হলেই সেটা সবক্ষেত্রে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার নয়। শরীরের যেকোনো জায়গা থেকেই রক্তক্ষরণ হতে পারে। দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া, কফ, কাশি, থুতুর সঙ্গে রক্ত পড়া, ত্বকের নিচে, ইনজেকশন যেখানে দেওয়া হয়, সেই জায়গায় রক্তক্ষরণ মারাত্মক নয়।
মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিকের রক্তক্ষরণের পরিমাণ বেশি হয়। এমনকি নিয়মিত মাসিক হওয়ার পরও জ্বরের সময় আবার মাসিক হয়। ডেঙ্গুকে হেমোরেজিক ফিভার না বলে এখন এটাকে ‘লিকিং ডিজিজ’ বলে। রক্তনালির লিকেজের ফলে রক্ত, পানি ও রক্তের অন্যান্য উপাদান রক্তনালির বাইরে চলে যায়। রক্তক্ষরণ, রক্তচাপ কমে যাওয়া, ফুসফুসের থলিতে পানি জমা, এসাইটিস ও অন্য সব মারাত্মক সমস্যার জন্য আসলে লিকিংই দায়ী।
রোগ নির্ণয়
অন্য সব সংক্রামক রোগের মতো প্রাদুর্ভাবের সময় ডেঙ্গুকে সন্দেহজনক (সাসপেক্টেড), সম্ভাব্য (প্রোবাবেবল) ও নিশ্চিত (কনফার্ম) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আমাদের দেশে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত যেকোনো জ্বরকেই সন্দেহজনক ডেঙ্গু হিসেবে চিকিত্সা শুরু করা যায়। এখনো আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ তেমন একটা নেই। বড় শহরের মধ্যে ঢাকায় ডেঙ্গু আশঙ্কাজনক হারে বেশি। ডেঙ্গুজ্বরের অন্যান্য সম্ভাব্য উপসর্গের সঙ্গে অ্যান্টিবডি টেস্ট পজিটিভ হলে ডেঙ্গুজ্বর হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। জ্বরের প্রথম চার-পাঁচ দিন রক্তে ভাইরাস থাকে।
রক্তের যেসব প্রাথমিক পরীক্ষা করতে হবে
কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি), টিসি ডিসি: ডেঙ্গুতে টিসি (স্বাভাবিক চার হাজার থেকে ১১ হাজার) কমে। দুই হাজার বা এক হাজার ৫০০ হাজার হলে সেটা ডেঙ্গু ছাড়া কিছু নয়।
হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা: ডেঙ্গুতে বাড়ে, অন্য কোনো ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।
পিসিভি: ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে বাড়ে।
প্লেটলেট কাউন্ট (স্বাভাবিক দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ)। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে এক লাখের নিচে নামবে। অনেকের ১০ হাজারের নিচে নেমে যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারাত্মক কিছু হয় না।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, উপসর্গের সঙ্গে প্লেটলেট কাউন্ট এক লাখের কম হলে ও পিসিভি ২০ শতাংশের ভ্যারিয়েশন হলে সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলে ধরা হয়।
অন্যান্য পরীক্ষা
সব জ্বরের জন্যই প্রথম সপ্তাহে রক্তের কালচার ও ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করা দরকার। অ্যান্টিবডি পরীক্ষা দ্বিতীয় সপ্তাহে করা উচিত। লিভার ফ্যাংশন টেস্ট: ডেঙ্গুতে এসজিওটি এসজিপিটির চেয়ে বেশি বাড়ে। ফুসফুসের থলিতে পানি জমা (প্লুরাল ইফিউশন), এসাইটিস দেখার জন্য পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি করা যায়। রক্তে চিনির মাত্রা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
চিকিত্সা
জ্বর ১০২ ডিগ্রির বেশি থাকলে প্যারাসিটামল চলবে ছয় ঘণ্টা পরপর। জ্বর ১০১ ডিগ্রির নিচে থাকলেই যথেষ্ট। কোনোভাবেই প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ নয়। রোগীর শরীর নিয়মিত স্পঞ্জিং করতে হবে। গোসল করতে পারে, তবে পানি পরিমিত পরিমাণে নেবে। এতে জ্বর নেমে যায়।
দুই থেকে আড়াই লিটার বিশুদ্ধ পানি পান করা নিশ্চিত করতে হবে। এটাই ডেঙ্গুর মূল চিকিত্সা। রোগী কিছু না খেতে পারলে স্যালাইন দিতে হবে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও সাধারণ ডেঙ্গুজ্বরে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। এমনকি বাসায় থেকেও চিকিত্সা করা যায় জটিলতা না থাকলে। তবে পেটের ব্যথা থাকলে, আলকাতরার মতো কালো পায়খানা হলে, রোগী আবোলতাবোল বকলে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধ কীভাবে
ডেঙ্গুজ্বর ঠেকাতে হলে মশা ঠেকাতে হবে। বিশেষ করে এডিস মশা। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে ফুলহাতা শার্ট পরতে হবে। এডিস মশা বাইরে থাকে না। তাই ঘরের মশা মারতে হবে সবচেয়ে আগে। মশার বংশ বৃদ্ধি ঠেকাতেই হবে।
ঘরে-বাইরে কোনো পাত্রেই (জলকাদা, টায়ার, চৌবাচ্চা, ফুলের টব) চার-পাঁচ দিনের বেশি পানি জমতে দেওয়া যাবে না। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরের টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে মশা ঠেকান।
জ্বর কমিয়ে রাখুন ও রোগীর প্রতিদিন আড়াই লিটার বিশুদ্ধ পানি খাওয়া নিশ্চিত করুন।
লেখক খাজা নাজিম উদ্দীন : অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বারডেম প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক প্রথম আলো"য়
0 comments:
Post a Comment