Friday, October 16, 2009

কেন অহিংস হবে না মানুষ

0 comments
Writer:রেজিনা বেগম

‘I have nothing new

to teach the world
Truth and non-violence are
as old as the hills’
Mahatma Gandhi

২ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস। ২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘ কর্তৃক দিনটি অহিংসা দিবস হিসেবে বেছে নেওয়ার অন্তরালে যে মানুষটি তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং ২ অক্টোবর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্মদিন। যাঁরা ইতিহাসের ছাত্র নন তাঁরাও অবগত রয়েছেন যে ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে মুক্ত হতে ভারতবর্ষ যখন সংগ্রাম করছে, তখন এই সংগ্রামে এক নতুন ধারার জন্ম হয়, যা অহিংস অসহযোগ আন্দোলন হিসেবে পরিচিত এবং এই আন্দোলনের প্রবর্তক মহাত্মা গান্ধীজি। ব্যক্তি মোহনদাস এবং মহাত্মা গান্ধীজি কি পৃথক সত্তা? একজন ব্যক্তি মোহনদাস এবং মহাত্মা গান্ধীজির ব্যবধান কতটুকু? সূক্ষ্ম চিন্তা করলে দেখা যাবে ব্যবধান শুধু মহাত্মা ও গান্ধীজি শব্দ দুটি। এই শব্দ দুটি যদি পরিহার করা যায় তাহলে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এসে পড়েন আমজনতার কাতারে। বহুল প্রচলিত একটি প্রবচন আছে যে ভারতবর্ষ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাঠিয়েছিল আর ফেরত পেয়েছিল মহাত্মাকে। তাহলে বলা যাচ্ছে যে মহাত্মা > মোহন। মহাত্মা শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে মহত্ যে আত্মা। আধ্যাত্মিকতার প্রশ্ন না তুলেও বলা যেতে পারে যে মানুষ মাত্রই জন্মগ্রহণ করে একটি বিশুদ্ধ এবং নির্মল আত্মা নিয়ে, তাহলে মানুষ মাত্রই কেন মহাত্মা নয়? ব্যক্তিকে মহাত্মা হতে হলে অবশ্যই তাকে দেশ-কালের ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলের বাইরে বের হয়ে এসে সর্বকালের সার্বজনীনতার পর্যায়ে উন্নীত হতে হয়। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সর্বকালের সর্বজনীন হওয়ার যে প্রক্রিয়া তা তিনি নিজেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এখানে যে বিষয় লক্ষণীয়, তিনি তাঁর আত্মজীবনীকে অভিহিত করেছেন ‘দি স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ’ নামে। সত্য কি তাহলে এমন কোনো বস্তু যা কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়? বিষয়টি সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না যে ব্যক্তির জীবনে সত্যের অবস্থান তাকে সাধারণত্বের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। যারাই গান্ধীজির ‘আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ’ গ্রন্থটি উপলব্ধি করে অধ্যয়ন করেছেন তাদের মনে অন্তত সত্যের প্রকৃতি ও স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা জন্মেছে। কেবল সত্যকে আঁকড়ে ধরে মানবজীবনের সব সমস্যা সমাধান যে সম্ভব তার প্রামাণ্য দলিল বলা যেতে পারে এই আত্মজীবনী। মোহনদাসের মহাত্মা হওয়ার প্রক্রিয়ায় লক্ষ করা যায় সত্যের প্রাধান্য। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা হচ্ছে, যা সত্য তা যতই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকুক না কেন তা চিরন্তন সত্য হিসেবেই বিরাজমান, অপরপক্ষে একটি ভুল (কিংবা যদি বলা যায় মিথ্যা) যতই বিস্তার ঘটুক না কেন তা সত্যে পরিণত হবে না। তাঁর পুরো জীবনকে যদি এক কথায় বর্ণনা করা যায় তবে বলতে হয় এটি ছিল একটি সরলরেখার মতো, তিনি নিজে যাকে তুলনা করেছেন তরবারির ধারালো দিকের সঙ্গে, যা একই সঙ্গে সরু ও সোজা। এই তীক্ষ� সরল পথে হাঁটতে তিনি আনন্দিত হয়েছেন, বেদনার্ত হয়েছেন যখনই তিনি এই পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, বিশ্বাস করেছেন সৃষ্টিকর্তার সেই আশ্বাস, যে সংগ্রাম করে সে কখনোই বিজিত হয় না। তিনি পা পা করে এগিয়েছেন সত্যের পথ ধরে, একত্র করেছেন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্যেকে এবং জীবনে যখনই উপস্থিত হয়েছে কোনো মহাসংকট তখনই তিনি আশ্রয় নিয়েছেন সত্যের, মুখোমুখি হয়েছেন বাস্তবতার, যে লক্ষ্যটি স্থির করতেন সেখানে পৌঁছার জন্য যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন, যখনই কোনো ভুল করেছেন তার শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছেন। প্রতিটি বিষয়ে পরীক্ষা করা ছিল তাঁর স্বভাবজাত, সেই প্রক্রিয়ায় তিনি পরীক্ষা চালিয়েছেন খাদ্য নিয়ে, স্বাস্থ্য নিয়ে, পরিচ্ছদ নিয়ে, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কার, নীতি, আধ্যাত্মিকতাসহ যা কিছু জীবনের একান্ত অংশ, তার কোনোটিই তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে রাখেননি। তাঁর আত্মজীবনী এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং তা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের দলিলমাত্র। এখানে একটি বড় প্রশ্ন মনে আসে, সত্যকে নিয়ে তিনি কীভাবে পরীক্ষা করেছেন? একটি বিষয় আমাদের কাছে প্রতীয়মান যে সত্যের স্বরূপ সন্ধানে গান্ধীজির পথটি কোনো নির্দিষ্ট সূত্রমতে এগোয়নি, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকাতে যখন তিনি শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদ ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন তখনই উপলব্ধি করেছেন অহিংসা নামক সত্যকে, অর্থাত্ সত্যকে তিনি আবিষ্কার করেছেন নিজস্ব উপলব্ধির জায়গা থেকে। আবার এই নিজস্ব উপলব্ধি তিনি শুধু ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রাখেননি। যখনই তিনি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তখন সেই সমস্যাকে তিনি এককেন্দ্রিক না রেখে দেখেছেন সার্বজনীন ব্যাপ্তিতে এবং সেই প্রেক্ষাপটে সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। এই সমাধান খোঁজার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে সত্যের পরীক্ষা। সত্যকে উপলব্ধি করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন ‘সত্যময় হওয়ার যাত্রাপথে অহিংসা একটি অবলম্বন।’ এখানে এসে তাহলে বলা যায় অহিংসার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সত্য অর্জন কিংবা সত্য হচ্ছে অহিংসার মূলমন্ত্র।
তাহলে বিশ্ব অহিংসা দিবসের অর্থ কি একদিন শান্তি পদযাত্রা? নাকি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক লড়াই করার নামে যারা সন্ত্রাস চালাচ্ছে সেই আমেরিকার সৈন্য, ন্যাটো ফোর্স বা ইসরায়েলি সৈন্যদের একদিন অস্ত্রবিরতি? বোধকরি খুব বেশি প্রয়োজন আমাদের আত্ম-অনুসন্ধান অথবা সত্যের অনুসন্ধান, কারণ বর্তমানে আমরা সত্যের থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছি আর তাই আমাদের জীবনটা চলছে ভুল পথে। আমরা মহাত্মাকে সযতনে তুলে রাখছি বইয়ের র্যাকে অথবা দেয়ালে ফ্রেমবন্দী করে আর নিজেরা ক্রমেই হয়ে যাচ্ছি নথুরাম গডসে। সম্মানিত পাঠক, অনুগ্রহ করে আজ অহিংসা দিবসে সত্যকে একটু খুঁজবেন কি? আমরা একজন মহাত্মাকে খুঁজছি, হয়তো তিনি নিজেই জানেন না, সত্য খুঁজতে খুঁজতে আমরা ঠিকই তাঁকে পেয়ে যাব কোনো একদিন।

0 comments:

Post a Comment