Wednesday, October 7, 2009

মাখনা ফুল

0 comments
লিখেছেন ফারুখ আহমেদ
ছোটবেলায় দেখেছি ঢাকা শহরটা খালবিলে ঘেরা। নৌকা নিয়ে আমরা প্রায়ই বছিলা, যাত্রাবাড়ীতে চলে যেতাম। যাত্রাবাড়ী তখন বিল। প্রায়ই চড়ুইভাতি করতাম এখানে। একদিন আমার এক চাচার সঙ্গে যাত্রাবাড়ীর বিলে যাই। নৌকায় খুব ঘুরছিলাম। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একটি ফুল দেখে চমকে উঠি। পাতার বিশাল আকৃতি দেখে বুঝতে পারি এটা শাপলা ফুল না। চাচা জানালেন এটা মাখনা ফুল।


হালকা বেগুনি রঙের ফুলটির ভেতরের অংশ উজ্জ্বল লাল। পাপড়ি ও পুংকেশর অনেক। কয়েক ভাঁজে পাপড়ি উপরে উঠেছে। ফুলটি শাপলার চেয়ে ছোট। বিশাল গোলাকার পাতার সৌন্দর্যও ফুলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অবাক বিস্ময়ে ফুলটি দেখলাম। কিন্তু এরপর আর ফুলটির দেখা আর পাইনি।
মাখনা ঢাকার আদিবাসীর কাছে পরিচিত ও প্রিয় একটি শব্দ। তবে সেটা মাখনা ফুল নয়, ফল। মাখনা ফল আদি ঢাকাবাসীর একটি প্রিয় খাবার।
মৌসুমে পুরান ঢাকার পথে পথে মাখনা ফল বিক্রি হতে দেখা যায়। কিন্তু ফুল দুষপ্রাপ্য। কারণ খালবিলের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে হারিয়ে গেছে জলজ উদ্ভিদ মাখনাও। এখন ঢাকায় মাখনা ফল আসে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল থেকে। একসময় কুমিল্লা থেকেও ঢাকায় মাখনা ফল আসত। কুমিল্লায়ও এখন মাখনা বিরল। সুনামগঞ্জ বা কুমিল্লায় খুব বেশি যাতায়াত থাকলেও মাখনা ফুল আর দেখা হয়ে ওঠেনি। কিছুদিন আগে ঢাকায় বসেই মাখনা ফুলের দেখা পেলাম। এক ফটোসাংবাদিক বন্ধু খবর দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে মাখনা ফুল ফুটেছে। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। নিজের চেখে দেখতে বৃষ্টির মধ্যেই চলে যাই কার্জন হলের পাশের বাগানটিতে। তার কথামতো পেয়ারা ও রুটিফল গাছের মাঝামাঝি একটি চাড়িতে (মাটির বড় গামলা) মাখনা ফুল দেখে আমার চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া! ছবি তুলে নিলাম ফটাফট!
মাখনার উদ্ভিদবিজ্ঞানীয় নাম Euryale Ferox। পরিবার Nymphaeceae। ফক্সনাট, কাঁটাপদ্ম নামেও এর পরিচিতি রয়েছে দেশে দেশে। চীনে মাখনাকে বলা হয় qian shi। মূলত এশিয়া অঞ্চলের উদ্ভিদ। ভারত ও চীনে এর চাষাবাদ খুব বেশি। রাশিয়ায়ও মাখনা চাষের প্রচলন রয়েছে। ভারতের বিহারে মাখনা ফল খুবই জনপ্রিয়। ওখানে কাঁচা ও ভাজা দুভাবে মাখনা ফল খাওয়া হয়। বিহারে ভুট্টার খইয়ের মতো তাওয়ায় ভেজে মাখনা খাওয়ার প্রচলন আছে। চীনে মাখনার বীজের কাঁচা শাঁস ও শাঁসের স্যুপ পুরুষদের মধ্যে জনপ্রিয়। চীনারা প্রায় তিন হাজার বছর ধরে মাখনার চাষ করে আসছে। আমাদের দেশে মাখনা প্রকৃতি প্রদত্ত, চাষ হয় না কোথাও। খাবার হিসেবে মাখনার প্রচলন শুধু ঢাকায়ই।
প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক প্রথম আলো"য়
҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥҉♥
মাখনা

মাখনা গাছ ঠিক পদ্মগাছের মতো কাঁটাযুক্ত জলজ গাছ । এর পাতা পদ্মের মতো জলে ভেসে থাকে । পাতার উপরের অংশ ঘন সবুজ আর নিচের অংশ লালচে ও বেগুনি রঙের । ফুল ও ফলের বৃদ্ধি হয় জলের নিচে । কখনও ফুল জলের উপরেও ভাসে । একটি ফুলে ২০ থেকে ৩০ টি নীল, বেগুনি বা লাল রঙের পাপড়ি থাকে । এক একটি ফলে ২০ থেকে ৫০ টির মতো বীজ হয় । তার ফলের মধ্যে কালো কালো গুলির মতো যে বীজ হয়, তার ভিতরে সাদা শাঁস থাকে । খোলায় ভাজলে ঐ সাদা শাঁস খইয়ের মতো দেখতে হয় । একে লাবা বলে । মাখনায় প্রচুর পরিমাণে শর্করা, ফ্যাট, প্রোটিন ও খনিজ পদার্থ থাকে । সহজপাচ্য বলে শিশুখাদ্য এবং বয়স্কদের খাবার হিসাবে এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে । মাখনার ঔষধি গুণও রয়েছে । খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এই খইয়ের দেশীয় বাজার তো বটেই আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা রয়েছে ।
আবহাওয়া -
মাখনা সাধারণত উষ্ঞ আবহাওয়ার ফসল । ঝিরঝিরে বৃষ্টির সময়ে মাখনার দ্রুত বৃদ্ধি হয় । তবে শিলাবৃষ্টি ওই গাছের প্রধান শত্রু । শিলাবৃষ্টিতে পাতায় পচন ধরে গাছ নষ্ট হয়ে যেতে পারে । অতিরিক্ত বৃষ্টিতে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ।
মাটি -
যে কোনও জলাশয়ে বা অগভীর পুকুরে মাখনার চাষ হতে পারে । সাধারণত অগভীর কাদাযুক্ত বা পলিযুক্ত পাঁক মাটির জলাভূমি, পুকুর বা জলাশয়ে মাখনা চাষ ভাল হয় । জলের নিচে ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার মতো আঠালো কাদাযুক্ত নরম মাটিতে গাছের বাড় বৃদ্ধি ভাল হয় ।
বোনার সময়-
পৌষমাসের (ডিসেম্বরের মাঝ) মধ্যে মাখনার বীজ ফেলতে হয় । মাঘ (ফেব্রুয়ারীর মাঝ) মাসের দিকে মূল জলাজমিতে মাখনা রোপণ করা হয় । সাধারণত বিঘা প্রতি ৫ কেজি বীজ ছড়িয়ে বা আগের জলাজমিতে থেকে যাওয়া বীজের সাহায্যে চাষের প্রচলন রয়েছে । বীজতলায় চারা তৈরি করে মূল জমিতে রোপণ করলে ফলনও ভাল পাওয়া যায় । আগের বছরের সংগ্রহ করা বীজ থেকে পুষ্ট ও নিরোগ বীজ বেছে নিয়ে এক থেকে দেড় ফুট গভীরতার জলাভূমিতে বীজতলা তৈরী করতে হয় । বীজতলায় আড়াই থেকে ৪ কুইন্টাল পচা জৈব সার ছড়িয়ে ২ থেকে ৩টি চাষ দিতে হবে । তার পরে বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে । বীজ বীজতলাতে ফেলার আগে অঙ্কুর বার করে নিতে পারলে চারার সংখ্যা বেড়ে যায় ।
মূল জমি তৈরি ও চারা রোপণ-
মূল জমিতে চারা রোপণ করার আগে ২-৩টি চাষ দিতে হবে । এই সময়ে জলায় ২ ফুট পরিমাণ জল থাকলে চারার পক্ষে আদর্শ । ২-৩টি পাতাযুক্ত ১ ফুট লম্বা চারা রোপণ করতে হবে । একটি সারি থেকে অন্যটির এবং একটি গাছ থেকে অন্যটির দূরত্ব রাখতে হবে ১ মিটার । চারা ৫-৬ সেমি. গভীর করে রোপণ করতে হবে ।
সার প্রয়োগ-
মাখনা চাষে সচরাচর কোনও সার প্রয়োগ করতে দেখা যায় না । জলাশয়ের চারপাশের সমস্ত আগাছা পচে জৈব সারের কাজ দেয় । জলা ভূমির উর্বরতা বুঝে মূল জমি তৈরির সময়ে বিঘা প্রতি দেড় থেকে ২ টন পচা জৈব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে ।
সেচ ও জল নিষ্কাশন -
গাছ বড় হওয়ার সময়ে ২-৩ ফুট এবং বর্ষার সময়ে জলের গভীরতা ৫-৬ ফুট থাকা দরকার। চৈত্র-বৈশাখ (মার্চ-জুন) মাসে জল কমে গেলে সেচের ব্যবস্হা করতে হবে । বর্ষায় জল বেড়ে গেলে কোনও ক্ষতি হয় না, তবে প্রয়োজন মনে হলে জল বার করে দেওয়ার ব্যবস্হা করতে হবে।
ফুল ফোটা ও ফল আসার সময় -
মাখনা চারা রোপণ করার পরে ৬০ থেকে ৭০ দিন পরে বৈশাখ মাসে (এপ্রিলের মাঝামাঝি) গাছে ফুল আসতে শুরু করে ।
আশ্বিন-কার্তিক (সেপ্টেম্বর - নভেম্বরের মাঝ) মাস পর্যন্ত নাগাড়ে ফুল ফোটে । ফল আসে জৈষ্ঠের (মে মাসের মাঝ) শুরু থেকে ।
ফসল সংগ্রহ -
ফল পরিপক্ক হলে ফল ত্বক পচে বীজগুলি বার হয়ে আসে । প্রথম দিকে বীজগুলি জলে ভাসতে থাকে । পরে বীজ ভারী হয়ে গাছের গোড়ার দিকে কাদামাটির উপরে থাকে । তিনটি ধাপে বীজ সংগ্রহ করা হয় । জুন- জুলাই (আষাঢ় - শ্রাবন) মাসে যে ফলন পাওয়া যায় , তাকে বলে লোসর । দ্বিতীয় দফায় অগাস্ট - সেপ্টেম্বর (ভাদ্র - আশ্বিন) মাসে যে ফলন পাওয়া যায় তাকে বলে মারকাট । তৃতীয় দফায় অক্টোবর মাসে যে ফলন হয়, তাকে বলে মারকাট - ১ । দড়ি ও বাঁশের সরু কাঠি দিয়ে তৈরি এক ধরনের জালের সাহায্যে বীজ সংগ্রহ করা হয় । কাদামাটি -সহ বীজগুলিকে সংগ্রহ করে পরিষ্কার জলে ধুয়ে নেওয়া হয় । এক বিঘা জমিতে ২ থেকে ৩ কুইন্টাল বীজ পাওয়া যায় । তবে এই চাষে উপযুক্ত পরিচর্যা , জৈব সার প্রয়োগ ও রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে চাষি ভাইয়েরা এর ফলন ৪ থেকে ৫ কুইন্টাল পর্যন্ত পেতে পারেন ।
বীজ সংরক্ষণ -
বীজগুলিকে রোদে ভালভাবে শুকিয়ে বেঁধে , পরিষ্কার জায়গায় মজুত করতে হয় । পরের বছর বীজ হিসাবে ব্যবহারের জন্য চিহ্নিত বীজ নাইলনের জালের মধ্যে জড়িয়ে ছোট ডোবা, পুকুর, বা জলাশয়ে ডুবিয়ে রাখতে হবে । বাড়িতে রাখতে হলে চৌবাচ্চা, বড় জালায় চুবিয়ে রাখা যেতে পারে ।
রোগপোকা ও প্রতিকার -
মাখনা গাছ ও ফলে বেশ কিছু পোকার আক্রমণ দেখা যায় । সময়মতো ব্যবস্হা না নিলে ফলন কমে যেতে পারে ।
· পামড়ি পোকা - এই পোকা মাখনা গাছের মূলে আক্রমণ করে । পোকা মূলের বিভিন্ন অংশ খেয়ে গাছের ক্ষতি করে । এ ক্ষেত্রে পোকা নিয়ন্ত্রণে একটি পদ্ধতি হল একই জমিতে বার বার মাখনা চাষ না করা ।
· নলী পোকা - পূর্ণাঙ্গ পোকা পাতায় ডিম পাড়ে । ডিম ফুটে শুককীট গাছের কচি পাতা খেয়ে ফেলে । তাছাড়া পাতা ও ফুলের সবুজ অংশ খেয়ে নেয় । পাতা জালিকায় পরিণত হয় । যেহেতু যেখানে মাখনা চাষ হয়, একই জলাভূমিতে মাছ চাষ করা হয় বলে কীটনাশক প্রয়োগে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় । নলী পোকা পাতার উপরের দিকে দেখা গেলে পাটের দড়ি কেরোসিন তেলে ভিজিয়ে পাতায় হালকা করে ঘষে দিলে উপকার পাওয়া যাবে । পরিমাণে অল্প হলে হাত দিয়ে পোকা পরিষ্কার করে দেওয়া যেতে পারে ।
· জাবপোকা - জাবপোকা পাতা ও গাছের কচি অংশের রস চুষে খায় । ফলে আক্রান্ত অংশ পচে যায় । পাতার উপরে জল স্প্রে করলে উপকার পাওয়া যায় ।
· পচন রোগ - এই রোগে গাছের শিকড় ও ডাঁটায় পচন ধরে । গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। প্রতিকারের জন্য প্রথমেই আক্রান্ত গাছ জমি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে । প্রতি ২-৩ বছর চাষের পরে অন্তপক্ষে এক বছর ওই জমিতে মাখনা চাষ বন্ধ রাখতে হবে । জল পরিষ্কার রাখতে হবে।
মাখনা চাষের খরচ (বিঘা প্রতি )-
১. জমি তৈরী (আগাছা পরিষ্কার, চাষ দেওয়া) ২০০=০০৫ শ্রমিক X ৪০ টাঃ
২. বীজের দাম ( ৫ কেজি X ৩০ টাঃ ) ১৫০=০০
৩. কীটনাশক (জলজ কীট , মাছ নিয়ন্ত্রণ) ৫০=০০
৪. নিড়ানী, গাছ পাতলা করা (৫ শ্রমিক X ৪০ টাঃ) ২০০=০০৫. ফসল তোলা ও অন্যান্য ১৪০০=০০
মোট ২০০০=০০
আয় -
মোট বীজ উত্পাদন বাবদ দাম
৩০০ কে.জি. / বিঘা X ৩০ টাঃ ৯,০০০=০০
লাভ -
বিঘা প্রতি মোট লাভ (৯,০০০=০০ - ২,০০০=০০) ৭,০০০=০০
 · নীচু জলাজমির সদ্ব্যবহারে ও সংরক্ষণে মাখনার চাষ করুন ।
· জৈব সার, জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে মাখনা চাষ করুন ।
· কচুরীপানা ও অন্যান্য পানা পচিয়ে জৈব সার তৈরী করুন ।
· নিমের পাতা, ছাল, বীজ থেকে কীটনাশক তৈরী করুন ।
· নিম গাছের চাষ বাড়ান ।
· জলাজমির চারধারের উঁচু জমিতে সজনে চাষ করে বাড়তি আয় করুন ।

0 comments:

Post a Comment