নাইর ইকবাল
সংকীর্ণতা থেকেই ভারত বিভাগ?
বিতর্কটির বয়স বাষট্টি বছর। এত বছরেও তা একেবারেই পুরোনো হয়নি। কারণ ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগ এই উপমহাদেশে এক বিরাট মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেয়। রাজনৈতিকভাবে যে একটি নির্দিষ্ট স্থানের ভূগোল পাল্টে দেওয়া যায়, তার নমুনা বিশ্ব দেখেছে সেই ’৪৭-এর গ্রীষ্মে। সেই গ্রীষ্ম ভারতবাসীর মনে এনেছে কিছু চিরকালীন প্রশ্ন, যার উত্তর এই বাষট্টি বছর ধরে খুঁজে চলেছে প্রতিটি উপমহাদেশবাসী। কেন সেই ভারত বিভাগ, কেন উপমহাদেশের বড় দুটি জনগোষ্ঠী হিন্দু ও মুসলমান একই সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে পারল না, কোন খলনায়কের কারসাজিতে উপমহাদেশ ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেল, এগুলোর উত্তর ইতিহাসবিদেরা তাঁদের ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এই উপমহাদেশের মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হয়তো এসব প্রশ্নের জবাব নতুনভাবে খুঁজে চলবে।
আজ বাষট্টি বছর পর ভারত উপমহাদেশে নতুন করে বিতর্ক শুরু করেছে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ঘটনাবলি নিয়ে। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির বহিষ্কৃত নেতা যশোবন্ত সিং কিছু দিন আগে জিন্নাহ: ইন্ডিয়া-পার্টিশন-ইনডিপেন্ডেন্স নামের এক বইতে এই বিতর্ক নতুন করে জাগিয়ে তুলেছেন। তিনি তাঁর সদ্যপ্রকাশিত এই বইয়ের একপর্যায়ে একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যত না পাকিস্তান অর্জন করেছেন, তার চেয়ে নেহরু ও প্যাটেল তাঁকে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি উপহার হিসেবে দিয়েছেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ—পাকিস্তানের কায়েদে আজম—জাতির পিতা। ইতিহাস বলে, তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক, অথচ যশোবন্ত সিং কেন ও কোন উপাত্তের ভিত্তিতে বললেন, অবিভক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখা জওহরলাল নেহরু এবং বল্লভ ভাই প্যাটেল তাঁকে পাকিস্তান উপহার দিয়েছেন? যশোবন্ত সিং তাঁর বইয়ে কেবল এই মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি, এর পক্ষে পুরো ৬৭০ পৃষ্ঠার সুবিশাল বইতে এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন এবং এমন কিছু ঘটনার চুম্বক তুলে ধরেছেন, যেগুলো অবশ্যই ইতিহাসবেত্তাদের ভাবনার খোরাক জোগাবে। নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণের আতস কাচের নিচে এনে দিয়েছে সেদিনকার ভারত বিভাগ নাটকের কুশীলদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং স্বাধীন ভারতে তাঁদের ক্ষমতার লিপ্সাকে। ভারতের জনগণ ও ইতিহাসবিদেরা এত দিন যে আবেগ দিয়ে দেশভাগকে দেখতেন, তা থেকে সরে এসে নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে বিচার করার সুযোগ ও সময় এসেছে। এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়া টুডে সাময়িকীতে প্রকাশিত হু পার্টিশনড ইন্ডিয়া? নিবন্ধে ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাস গবেষক এস প্রসন্নরাজনের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘মানবচরিত্রের অন্ধগলিতে ইতিহাসের বিচরণ খুবই সীমিত। অবশ্যই ইতিহাসবিদরা ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার নায়কদের চিন্তাজগত নিয়ে ভাবেন না।’ এই কথাটি তিনি বলেছেন কারণ সাতচল্লিশে ভারতভাগের পেছনে যে তত্কালীন নের্তৃবৃন্দের সংকীর্ণতা দায়ী, সেই সংকীর্ণতার খুব অল্প অংশই ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উঠে এসেছে।
যশোবন্ত সিং তাঁর বইয়ে কিছু মৌলিক ঘটনাপ্রবাহের অবতারণা করেছেন। তিনি ভারতভাগের পেছনে ‘রাজনীতিকদের সংকীর্ণতা ও ঔদ্ধত্য’কেই মূল কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। জিন্নাহকে একজন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। তাঁর ভাষায়, জিন্নাহ দেশভাগ নয়, চেয়েছিলেন সম-অধিকার, মর্যাদা আর সম্মান। যশোবন্ত সিং জওহরলাল নেহরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেলের ওপর ভারতভাগের দায়ভার চাপাতে চেয়েছেন। তাঁর বইয়ের অনেক জায়গায় ভারতভাগের জন্য নেহরু আর প্যাটেলের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার উচ্চাভিলাষকে দায়ী করেছেন।
একজন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ব্যক্তি হয়েও জিন্নাহ কেন শেষ পর্যন্ত তাঁর কুখ্যাত দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করতে বাধ্য করালেন ‘ব্রিটিশ শাসক’দের, তার ব্যাখ্যায় যশোবন্ত সিং তাঁর বইয়ে এ ক্ষেত্রে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের চিন্তাকে নেহরু ও প্যাটেলের বিরুদ্ধে তাঁর (জিন্নাহর) এক অত্যাশ্চর্য পাশার চাল হিসেবেই অভিহিত করেছেন।
১৯৪৭-এর গ্রীষ্মের সেই ভারত বিভাগকে শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এক বিরাট রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করার একটা প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় যশোবন্ত সিংয়ের বইয়ে। আর জিন্নাহর বিজয় মানেই নেহরু-প্যাটেল-গান্ধী সর্বোপরি সমগ্র ভারতের রাজনৈতিক পরাজয়, তা বলতে মোটেও ভোলেননি তিনি।
জিন্নাহর পাকিস্তান প্রস্তাব তড়িঘড়ি করে কোন হিসেবে নেহরু-প্যাটেল মেনে নিলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অথচ দুজনই তাঁদের রাজনৈতিক জীবনের একটা বড় অংশ অবিভক্ত ভারতের প্রশ্নে উত্সর্গ করেছিলেন। নেহরু-প্যাটেলের ভারতভাগের সম্মতি মহাত্মা গান্ধীকেও ব্যথিত এবং হতাশ করেছিল, যার ফলে গান্ধী সক্রিয় রাজনীতির সংশ্রাব ত্যাগ করেছিলেন। নেহরু-প্যাটেলের পাকিস্তান তথা ভারত বিভাগে সম্মতি এই প্রশ্ন তুলেছে যে, অধিকারের প্রশ্নে সচেতন মুসলমানদের ভারতে সম-অধিকার না দেওয়ার অন্তবর্তী কোনো পরিকল্পনা তাঁদের ছিল কি না। ইতিহাসবিদদের তা বিশ্লেষণের সুযোগ করে দিয়েছেন যশোবন্ত সিং তাঁর বইয়ের মাধ্যমে।
তাহলে ভারত বিভাগ কি কেবল ক্ষমতার প্রশ্নে বনিবনা না হওয়ার কারণে, নাকি নিছক সাম্প্রদায়িকতার নিগড়ে বাঁধা এক ঘটনা, তা বিশ্লেষণের ব্যাপার হলেও ১৯৩৭ সালের পর থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ক্রমান্বয়ে ভারতীয় মুসলমানদের প্রধান মুখপাত্র থেকে ভারতের হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠা নেহরু ও প্যাটেলের জন্য স্বস্তিদায়ক কিছু ছিল না—এ কথা বলাই যায়।
জিন্নাহ প্রথমে চাইলেন স্বাধীন ভারতবর্ষে মুসলমানদের সম-অধিকার, মর্যাদার প্রশ্নে অদ্বিতীয়তা। তিনি এ কথা বারবার বলতেন, ভারতীয় মুসলমানেরা সম-অধিকার পেলে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি ছেড়ে দেবে। কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের পর্যাপ্ত অংশীদারত্বই ছিল তাঁর মূল দাবি। কিন্তু জিন্নাহর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জওহরলাল নেহরু তা চাননি। তিনি বলে এসেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের কথা, যা প্রকারন্তরে ছিল হিন্দুপ্রধান শাসনকাঠামোরই অপর নাম। জিন্নাহ ও মুসলমান সমাজ নেহরুর এই অবস্থানে রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ বোধ করেনি। তখনই তিনি মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের দাবি তুলে ধরেন। এখানে নেহরু যদি ছাড় দিতেন তাহলে হয়তো ভারত বিভাগ ঠেকানো যেত। যশোবন্ত সিং তাঁর বইয়ে এই প্রশ্নে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। নেহরুর রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ এবং মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান প্রস্তাব মেনে নিয়ে যে প্রস্তাব গ্রহণ করে, তাতে একে ‘মন্দের ভালো’ ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই ‘মন্দের ভালো’ প্রস্তাব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নেহরু-প্যাটেল নিজেদের ছাড় দেওয়ার মানসিক দৈন্যকে প্রকট করে তুলে ধরেছেন। যশোবন্ত সিং তাঁর বইয়ে একপর্যায়ে বলেছেন, রাজনীতিবিদদের অনৈক্য ও অসংকীর্ণ আচরণ তথা ছাড় দেওয়ার মানসিকতার অভাব, স্বাধীনতার প্রশ্নে তত্কালীন ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নিয়ে আসে, তাঁদেরই বিপুল উত্সাহে শেষ পর্যন্ত ভারতের অঙ্গহানির অস্ত্রোপচার হয় এবং জন্ম নেয় ‘পাকিস্তান’ নামক এক ‘ইনকিউবেটর’ রাষ্ট্র।
জিন্নাহ বিতর্ক-২
ধর্মনিরপেক্ষ, না সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ‘ইনকিউবেটর রাষ্ট্র’ পাকিস্তান অর্জনের মধ্য দিয়ে জওহরলাল নেহরু ও কংগ্রেসের একক মানসিকতা এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ভাবনার রাজনৈতিক জবাব দেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুসলমানদের আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের তত্ত্ব এক চিরন্তন বিতর্ক। ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করে দেওয়া তাঁর এই দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে আজ বহু বছর ধরে জিন্নাহ ভারতীয়দের কাছে একজন খলনায়ক হিসেবেই পরিচিত। জীবিত অবস্থায় তিনি ভারতীয়দের এই মনোভাব বুঝতে পারতেন। তিনি জানতেন দ্বিজাতিতত্ত্ব তাঁকে ভারতীয়দের চিরন্তন শত্রুতে পরিণত করবে। তবে এ ব্যাপারে ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে এলাহাবাদে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমি সমালোচিত হতে পারি, আমি আমার বিরুদ্ধবাদীদের কাছ থেকে রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হতে পারি; তবে আমি নিশ্চিত, একটা সময় আসবে, হয়তো বা সেই সময়টি আমি দেখে যেতে পারব না, যখন আমার বিরুদ্ধবাদীরাই আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে, আমি নিশ্চিত, সে দিনটি বেশি দূরে নয়।’
১৯৯৯ সালে পাকিস্তান সফরের সময় করাচিতে ভারতের তত্কালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি, যিনি ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পুরোধা, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে প্রথমবারের মতো একজন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আজ তার প্রায় এক দশক পর আদভানির দলেরই আরেকজন এক ধাপ এগিয়ে ভারত বিভাগকে প্রকারান্তরে জিন্নাহর রাজনৈতিক অধিকার হিসেবেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
পাকিস্তানের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আয়শা জালাল আজ থেকে বহু বছর আগে লেখা তাঁর বই সোল স্পোকস্ম্যান-এ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে বলেছিলেন, উপমহাদেশ সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা আর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ঘটনাবলির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যক্তিগতভাবে একজন আধুনিকমনস্ক ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এককালে কংগ্রেসের একজন বড়মাপের নেতাও ছিলেন। কংগ্রেস থেকে বের হয়েও জিন্নাহ অনেক দিন হিন্দু-মুসলমানের সমঅধিকারের প্রশ্নে রাজনীতি করেছেন, ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়ও তাঁর লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের সমঅধিকার। কিন্তু তাঁর এই দাবি অপাঙেক্তয় হয়ে পড়ায় তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের ফর্মুলা সামনে নিয়ে আসেন। জিন্নাহর প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জওহরলাল নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে মুসলমানদের সমঅধিকার প্রশ্নে একমত করতে না পারার কারণেই দ্বিজাতিতত্ত্বকে সামনে নিয়ে আসেন। নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক বিজয়কে সুনিশ্চিত করেন। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে ভারতজুড়ে তিনি সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হয়ে আছেন। অথচ হিন্দু-বিরোধিতা নয়, তাঁর লক্ষ্য ছিল তাঁদের সঙ্গে সমঅধিকারের ভিত্তিতে একসঙ্গে বাস করা। স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোতে কেন্দ্রের শাসনকে সীমিত করে রাজ্যগুলোকে একেকটি স্বায়ত্তশাসিত ইউনিটে পরিণত করে সবার অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু কংগ্রেস তথা নেহরুর সংখ্যাগরিষ্ঠ তত্ত্বে জিন্নাহ বুঝতে পেরেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে অসমতা। তাই এ নিয়ে নেহরুর সঙ্গে তাঁর বনেনি। ইন্ডিয়া টুডে প্রকাশিত ‘মাস্টার্স অব মিউটিলেশন’ শিরোনামের এক নিবন্ধে জিন্নাহ-গবেষক আয়শা জালাল বলেছেন, ‘নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেলই ভারতকে ভাগ করতে বেশি উত্সাহী ছিলেন। ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতকে বিভক্তি থেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছিলেন একেবারে শেষ পর্যন্ত। জিন্নাহর সমঅধিকার এবং একেকটি রাজ্যকে ইউনিটে পরিণত করার প্রস্তাবে নেহরু-প্যাটেল একমত হলেই খুব সহজে ভারত বিভাগ এড়ানো যেত। আয়শা জালাল একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে ক্ষমতার মোহ নেহরু ও প্যাটেলকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছিল, ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার স্বার্থে ভারতের বিভক্তিকেও তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন।
একজন কড়া ভারতীয় জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি কেন, কিসের ভিত্তিতে তাঁর চিন্তা-চেতনা ধর্মাশ্রয়ী করলেন, তার সুন্দর বিবরণ যশোবন্ত সিং তাঁর বইয়ে দিয়েছেন নির্মোহ আবহে। তবে এত কিছুর পরও তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব ক্ষমতার প্রশ্নে আপস না হওয়ার কারণেই সামনে এসেছে। ইতিহাসের আবেগী ব্যাখ্যায় তিনি হয়তো ভারতের বিভাজনের প্রতীক হয়ে আছেন, কিন্তু চল্লিশের দশকের সেই নাটকীয় দিনগুলোতে জিন্নাহ যে ভারত বিভাগের বিপক্ষে ছিলেন, তা ইতিহাসের প্রমাণিত সত্য। এর পক্ষে আরও অকাট্য প্রমাণ ইতিহাসবিদেরা ভবিষ্যতে অবশ্যই বের করবেন বলে আশা করা যায়।
নেওয়া হয়েছে "প্রথম আলোয়"য় প্রকাশিত ধারাবাহিক থেকে।
জিন্নাহ বিতর্ক-৩
একাধারে নায়ক এবং খলনায়ক
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারত বিভাগ প্রাথমিকভাবে চাননি—এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি জিন্নাহ, নেহরু তথা কংগ্রেস আর সর্দার বল্লভ প্যাটেলের নানামুখী স্বার্থচিন্তার সুযোগটাও খুব ভালোমতো নিয়েছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে মুসলমানদের আলাদা আবাসভূমি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা জিন্নাহ সামনে এনেছিলেন যখন অন্য কংগ্রেসনেতারা মুসলমানদের সম-অধিকারের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতের কাঠামোর মধ্যে জিন্নাহর দাবিমতো স্বায়ত্তশাসন দিতে গড়িমসি করছিলেন। রাজনীতিবিদদের অনৈক্য ও স্বার্থান্বেষণ ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে অচলাবস্থা ও জটিলতার সৃষ্টি করে। ঠিক এ সময়ই ভারতের স্বাধীনতা প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভারতে আসেন ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। মাউন্ট ব্যাটেন যেকোনো মূল্যে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ছিলেন বদ্ধপরিকর। ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও জাতিগোষ্ঠীগত সাম্য ও সম্প্রীতি তাঁর কাছে মুখ্য বিষয় ছিল না। তিনি একজন সাধারণ চাকুরে হিসেবেই ব্রিটিশরাজের নির্দেশমতো ব্রিটেনের রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করতেই মনোযোগী ছিলেন বেশি।
বিভিন্ন ইতিহাসবিদ নানা সময়ে ভারত ভাগের পেছনে তত্কালীন রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ও বিভিন্ন রকম স্বার্থের দ্বন্দ্বকে দায়ী করেছেন।ভারতের শীর্ষস্থানীয় সংবাদ সাময়িকী ইন্ডিয়া টুডেতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও জিন্নাহ গবেষক আয়শা জালাল বলেছেন,‘যখন ভারতকে অখন্ড রাখার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলো এবং হিন্দুমহাসভার ভারতের দুটি প্রধান মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবকে দুইভাগে ভাগ করে দেওয়ার প্রস্তাবকে নেহরু ও প্যাটেল সমর্থন দিয়েছেন তখনও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতেকে অখন্ড রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। যদি কংগ্রেস তথা নেহরু ও সর্দার বল্লভ প্যাটেল জিন্নাহ’র সাথে কিছু বিষয়ে একমত হতেন তাহলে হয়তো ভারতভাগ ঠেকানো যেতো।’ আয়শা জালালের এই বক্তব্য জিন্নাহ’র অখন্ড ভারতের প্রাথমিক চিন্তা সমর্থন করে। ভারতে শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনও ঠিক সেই সুযোগটিই দারুণভাবে গ্রহণ করেন। ভারতের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো রাজনীতিবিদই নিজেদের বা একান্ত দলীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করেননি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতো একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম সত্যিকারের জাতীয় প্ল্যাটফর্মের মতো আচরণ করতে পারেনি। বরং শেষের দিকে তারা কেবল হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক অভিলাষ। রাজনীতিবিদেরা ভারতের স্বাধীনতাকেই সবচেয়ে বড় এজেন্ডা হিসেবে তুলে ধরতে পারেননি। সেটা করতে পারলে মন্ত্রিসভায় কজন মুসলমানের অন্তর্ভুক্তি হলো কিংবা মুসলমানদের ‘মুখপাত্র’ হিসেবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ক্ষমতার কতটুকু স্বাদ পেলেন—এসব ব্যাপার কংগ্রেসিদের কাছে খুব একটা মুখ্য বিষয় হতো না। এসব কোনোটাই না হওয়াতে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কংগ্রেস স্বয়ং অখণ্ড ভারতের প্রশ্নে কতটা আন্তরিক ছিল। নেহরু, প্যাটেল সবার মধ্যেই জিন্নাহকে অবজ্ঞা করার একটা প্রবণতা ছিল। জওহরলাল নেহরু জিন্নাহকে রাজনৈতিকভাবে ঈর্ষা করতেন। জিন্নাহ যখন মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতা, কংগ্রেসে তখন নেহরু, মওলানা আজাদের যৌথ নেতৃত্ব। নেহরু দারুণ প্রজ্ঞাবান একজন রাজনীতিবিদ হওয়ার পরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরোপুরি স্বাধীনতা তাঁর ছিল না। অপরদিকে জিন্নাহর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো নেতা মুসলিম লীগে ছিল না। এ ব্যাপারটি নিয়ে নেহরুর মনের গহিনে একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা কাজ করত। একবার মাউন্ট ব্যাটেনকে কথা প্রসঙ্গে জিন্নাহ সম্পর্কে নেহরু বলেছিলেন, ‘ক্ষমতার বাতিকে পাওয়া মাঝারি গোছের একজন উকিল বই আর কিছু নন মি. জিন্নাহ।’ ভারতীয় রাজনীতিকদের এ রকম ব্যক্তিদ্বন্দ্ব দারুণ উপভোগ করতেন মাউন্ট ব্যাটেন। এ সময় মহাত্মা গান্ধী এই দ্বন্দ্ব নিরসনে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। ভারতের দুর্ভাগ্য, গান্ধী কখনোই আপদমস্তক রাজনীতিক ছিলেন না। তিনি অনেকটা সাধুসন্ত ধরনের মানুষ ছিলেন। চল্লিশের দশকে রাজনীতির জটিল-কুটিল অন্ধ গলিতে তিনি বিচরণ করতে পারেননি। তার ওপর কংগ্রেসের নেতৃত্বও পুরোপুরি তাঁর হাতে ছিল না।
মোট কথা, সাতচল্লিশের ভারত ভাগ ছিল চমত্কার একটি রাজনৈতিক নাটক। এই নাটকের প্রধান কয়েকটি চরিত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন ঐতিহাসিকেরা নানাভাবে। তাঁরা এই নাটকের প্রধান চরিত্র হিসেবে জিন্নাহ, নেহরু, প্যাটেল আর মাউন্ট ব্যাটেনকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সে সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে বলা যেতে পারে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্র। তিনি একাধারে সেই নাটকের প্রধান চরিত্র আবার একই সঙ্গে খলনায়ক। তিনি একই সঙ্গে ভারতকে ভাগ করতে চেয়েছিলেন আবার চাননি। তিনি কখনো ধর্মনিরপেক্ষ কখনো বা সাম্প্রদায়িক, যে জিন্নাহ একসময় ছিলেন ‘হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের দূত’, আবার আরেক সময় নিজের আগের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমি পাকিস্তান দাবি করে মাউন্ট ব্যাটেনকে দিয়ে তা আদায় করেও ছাড়েন। তবে সে সময়ের কংগ্রেসনেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদও বলেছেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কখনোই ভারতের বিভাজন চাননি। ভারতে মুসলমানদের সম-অধিকার চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন। এর পরও কেন ভারত ভাগ হলো তার কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। এই ব্যাখ্যা বের করার দায়ভার ইতিহাসবিদদের। নেহরু চিন্তাচেতনায় কেতাদুরস্ত ব্যক্তি হলেও মনের দিক দিয়ে কখনোই উদার মনমানসিকতার কেউ ছিলেন না। তিনি যদি কেবল জিন্নাহর সঙ্গে নিয়মিত ওঠা-বসা এড়ানোর জন্য ভারত ভাগে রাজি হয়ে থাকেন, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। সব মিলিয়ে তখনকার রাজনীতিবিদদের অভাবনীয় স্বার্থচিন্তা ব্রিটিশদের ভারতের স্বাধীনতা দেওয়ার সময় অবৈজ্ঞানিক সমাধানে প্ররোচিত করে। উপমহাদেশে চিরকালের জন্য এক সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। মাত্র কয়েকজনের স্বার্থদ্বন্দ্বের কাছে হেরে যায় গোটা একটি অঞ্চলের ভূগোল। মানুষকে মেনে নিতে হয় নিদারুণ দুর্ভোগ। আজ এত বছর পর সাতচল্লিশের বিভাজন নিয়ে এই উপমহাদেশে নতুন করে কথাবার্তা, চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। অনাগত ভবিষ্যত্ অবশ্যই আরও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করবে সাতচল্লিশের দেশভাগের খলনায়কদের। সবকিছুর বিচারেই সাতচল্লিশের আগস্ট মাসের সেই সব ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাসের এক মর্মন্তুদ অধ্যায়।
0 comments:
Post a Comment