Friday, October 9, 2009

বড় কাটরা

0 comments
বিলুপ্তির পথে ঐতিহাসিক বড় কাটরা

আশীষ-উর-রহমান
তারিখ: ০২-১০-২০০৯
ভবনটির ভেতরের গম্বুজে লেখা ছিল, ‘পৃথিবীর সম্রাটের অকৃত্তিম ও ন্যায়বিচারক পুত্র শাহ সুজার আমলে (এটি নির্মাণ করা হয়)। তিনি এরূপ প্রতাপশালী যে, তাঁর দরবারে প্রাচীন চীন সম্রাট গর্বভরে ধুলা পরিষ্কার করে থাকেন। তিনি এত ঐশ্বর্যবান যে, তাঁর হাতের মুঠি মুক্তা দিয়ে সমুদ্রের গহ্বর এবং মেঘমালার প্রান্ত ভরে রাখেন।... তাঁর দরবারের সেবক আবুল কাশেম আরশের স্তম্ভস্বরূপ এ উঁচু ভবন নির্মাণ করেন। কত সুন্দর এ অবিকল প্রতিলিপি।’ শিলালিপির বর্ণনা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে আজকের দিনের পাঠকদের কাছে। তবে যখন এ ভবনটি নির্মিত হয়েছিল তখন এর স্থাপত্যশৈলীতে দেশবাসী তো বটেই, মুগ্ধ হয়ে স্বর্গীয় বলে মেনে নিয়েছিলেন বিদেশি পর্যটকেরাও। অতীত বিবরণ পাঠ করে এখনো বহু বিদেশি পর্যটক আসেন ভবনটি দেখতে। এসে কী দেখেন তাঁরা?
দেখেন, এককালে যে প্রাসাদে বসে দেশ শাসন করতেন, ইতিহাসখ্যাত বাংলার দোর্দণ্ড প্রতাপ সুবাদারেরা, সেখানে এখন ভুষিমালের আড়ত, নরসুন্দরের দোকান, প্রিন্টিং প্রেস, ঝালাই কারখানা, হরেক রকম পণ্যের পাইকারি দোকান আর বিশাল অংশজুড়ে কওমি মাদ্রাসা। এর মধ্যে ‘বড় কাটরা’ নামের মুঘল আমলে নির্মিত ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর ও বড় এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের উত্তর দিকের তিলতলা ফটক এবং পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তের জরাজীর্ণ অষ্টকোনাকৃতির বুরুজ দুটি ছাড়া প্রায় সবই চলে গেছে বিলুপ্তির কবলে। উত্তর-পশ্চিম দিকে যে ভবনটি ছিল সেখানে ‘জামেয়া হোসায়েনিয়া আশরাফুল উলুম’ মাদ্রাসার কুতুবখানা ও নফিয়াতুল কোরআন বিভাগ। কুতুবখানার অংশটিও এখন বিধ্বস্ত। প্রাঙ্গণজুড়ে ইটসুরকির স্তূপ। এখানে মাদ্রাসার শৌচাগার নির্মাণের জন্য ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ। তবে মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মুফতি মোহাম্মদ তৈয়ব গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘ভবনটি বহু পুরোনো। ফেটে গিয়েছিল। ঈদের আগে কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি ও ভূমিকম্পে ভবনটি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর এটি আপনা থেকেই ধসে পড়ে। এতে মাদ্রাসার মওলানা সায়েদুর রহমান নামের এক শিক্ষক ও তিন ছাত্র আহত হয়।’
বড় কাটরার অতীত: বড় কাটরা নির্মাণ করেছিলেন সুবাদার সুলতান মুহম্মদ সুজার মীর-ই-ইমারত (প্রধান স্থপতি) আবুল কাশিম, ১৬৪৪ সালে। সুবাদারের বাসভবন হিসেবে নির্মিত এই অনিন্দ্যসুন্দর ভবনটি যে কারণেই হোক, শাহ সুজার পছন্দ হয়নি। তিনি এটির নির্মাতা আবুল কাশিমকে দান করেন সরাইখানা হিসেবে ব্যবহারের জন্য। ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ খরচের জন্য তিনি পাশেই ২২টি দোকান তৈরি করে দেন। ভবনের এ-সংক্রান্ত শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘সুলতান শাহ সুজা বাহাদুর সত্পথে ব্যাপৃত থাকতেন। এ জন্য আল্লাহর দয়াপ্রত্যাশী আবুল কাশিম আল হুসাইনী আত্তবাতবা আসসামনাঈ এ পবিত্র স্থানসংলগ্ন ২২টি দোকানসহ ওয়াক্ফ করে সঠিক ধর্মীয় বিধানমতে শর্তারোপ করেন, যেন ওয়াকফের তত্ত্বাবধায়কগণ এর থেকে প্রাপ্ত আয় এগুলোর নির্মাণ ও দীন-দুঃখীদের জন্য ব্যয় করেন। কোনো অভাবী লোক আগমন করলে তার নিকট থেকে কোন ভাড়া নিতে পারবে না যেন তার পুণ্য শুভামলে আরোপ হয়। অন্যায়কারীরা বিচারের দিন ধরা পড়বে।’ (অনু: মুনশী রহমান আলী তায়েশ)।
বড় কাটরা কেমন ছিল, আজ তা অনুমান করাই কঠিন। ঢাকার ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ মুনতাসীর মামুন রেনের মানচিত্রের অনুসরণে তাঁর ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘মাঝখানে প্রাঙ্গণ, চারদিকে চকমিলান ইমারত দিয়ে ঘেরা ছিল। মূল প্রবেশদ্বার ছিল উত্তর ও দক্ষিণে। দক্ষিণের অংশটি নদীর দিকে, পূর্ব-পশ্চিমে দুশো তেইশ ফুট লম্বা। এ অংশের মাঝামাঝি স্থানে ছিলো তিনতলা উঁচু ফটক। তার দুপাশে দোতলা ঘরের সারি। একেবারে দু’প্রান্তে আটকোণ দুটি বুরুজ। চুনসুরকি দিয়ে মজবুত করে নির্মিত হয়েছিল অট্টালিকাটি।’
সোনালি দিন: সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুলতান মুহম্মদ সুজা বাংলার সুবাদার হয়ে আসেন ১৬৩৯ সালে। কোনো শাহজাদা হিসেবে তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম সুবাদার। ঐতিহাসিক আবদুল করিম তাঁর মোগল রাজধানী ঢাকা বইতে জানিয়েছেন, ‘পূর্ববর্তী সুবাদারগণ তাঁদের বাসভবন হিসাবে কোন প্রকার প্রাসাদ নির্মাণ না করেই কেল্লার মধ্যে বাস করতেন। কিন্তু সম্ভবত সুজা একজন শাহজাদা ছিলেন বলে তাঁর জন্য একটি নিজস্ব প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন।’
পর্তুগিজ ধর্মযাজক সেবাস্তিয়ান মানরিক ১৬৪০ সালে ঢাকা সফর করে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লিখেছিলেন, ‘ঢাকা বাংলার প্রধান শহর। এ শহরের একপ্রান্তে সুপরিচিত শহরতলী মনেশ্বর এবং অপরপ্রান্তে নারিন্দা ও ফুলবাড়িয়া।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘তখন ঢাকার ব্যবসা-বাণিজের ফলে ‘শহরের সমৃদ্ধি এমন বিস্ময়কর ছিল যে, ঐ টাকা পয়সা গণনা দুঃসাধ্য বিধায় তা ওজন করা হত।’ সুজা ঢাকায় এলে বড় কাটরার উত্তর অংশে বসবাস করতেন। এরপর নওয়াব শায়েস্তা খাঁ ও মীর জুমলা এখানে থেকেই দেশ শাসন করতেন। ১৭৬৫ সালে নিমতলী প্রাসাদ নির্মাণের আগ পর্যন্ত নায়েব জেসারত খাঁ বড় কাটরাতেই থাকতেন এবং দরবার করতেন। পরে তাঁরা নিমতলী প্রাসাদে চলে আসার পর বড় কাটরার গৌরব অস্তমিত হতে থাকে। চার্লস ডয়লি ১৮২২ সালে লিখেছিলেন, বড় কাটরায় তখন গরিব দেশীয়রা বসবাস করত। তাঁর আঁকা ছবিতে দেখা যায়, উত্তর দিকের ফটকটি ধ্বংসের পথে, তবে দক্ষিণের ফটকটি তখনো বেশ ভালো অবস্থায় ছিল।
কওমি মাদ্রাসা: বড় কাটরার নিচতলায় নানা দোকানপাট, ওপরের অংশে এখন কওমি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মুফতি মোহাম্মদ তৈয়ব জানালেন, ১৯৩০ সালে এই মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে। জিঞ্জিরার মরহুম হাফেজ মোহাম্মদ হোসায়েন বড় কাটরা সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছিলেন। তিনিই এর মালিক। পরে তিনি এটি মাদ্রাসাকে দান করেন। মাদ্রাসা পরে আরও কিছু জায়গা কিনে আয়তন বড় করেছে। তবে কাটরার অনেক অংশই বেদখল হয়ে গেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পূর্ব-পশ্চিমের তিনতলা বিশিষ্ট দুই বুরুজ ও প্রধান ফটকটি ছাড়া পুরোনো ভবনের অস্তিত্ব তেমন নেই। বুরুজ ও ফটক তিনতলা হলেও এর দুই পাশের ভবনগুলো ছিল দ্বিতল। এখানে মাদ্রাসার ছাত্রাবাস ও শ্রেণীকক্ষের জন্য ওপরে আরও একটি তলা নির্মাণ করা হয়েছে। এবং ভেতরেও পুরোনো ভবনের জায়গায় নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। উপাধ্যক্ষ বললেন, ‘ভবনটি সংস্কার না করার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কুতুবখানাটি নিজে থেকেই ভেঙে পড়েছে। আমরাও চাই, সরকার এই ভবনটির সংস্কার করুক। তবে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভাষ্য: বড় কাটরা ভবনটির দেখভালের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল খালেকের। গতকাল এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসার অংশে ভবন ভাঙার কথা আমরা শুনেছি। তবে বড় কাটরা ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ। জিঞ্জিরার হাফেজ মোহাম্মদ হোসেন, বেগমবাজারের ফরিদউদ্দিনসহ অনেকেই এর মালিক। ১৯০৪ সালের ‘এনশিয়েন্ট মনুমেন্ট প্রিজার্ভেশন অ্যাক্ট’-এর আওতায় ১৯০৯ সালে প্রথম বড় কাটরাকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই আইনের বিধিমোতাবেক ব্যক্তিমালিকানাধীন পুরাকীর্তির সংরক্ষণ বা সংস্কার করতে হলে মালিকের সঙ্গে চুক্তি করে তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে করতে হবে। তিনি আরও জানান, ১৯২২ সালে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মালিকপক্ষ রাজি না হওয়ায় পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ঘোষণা প্রত্যাহার করা হয়। পরে ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয়বার সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখনো মালিক রাজি না হওয়ায় ১৯৬৮ সালে ঘোষণাটি প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ভবনটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৮৯ সালে তৃতীয়বার সংরক্ষিত ভবন হিসেবে ঘোষণা করে এটি সরকারিভাবে অধিগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক প্রতিবেদন দিয়েছেন। মোট সম্পত্তির পরিমাণ এক একর ৮ শতাংশ। কিন্তু এই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে যে টাকার দরকার, তা অধিদপ্তরে নেই বলে এ ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।’ ভবনটির এখনো যে অবস্থা আছে, তা সংরক্ষণ না করলে অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ব্যবসায়ীদের মন্তব্য: বড় কাটরায় যাঁরা ব্যবসা করছেন তাঁরাও অনেকে চান, ঐতিহাসিক এই ভবনটি সরকার অধিগ্রহণ করে একে সংরক্ষণ করুক। অনেকেই এখানে দোকান ভাড়া নিয়েছেন মাদ্রাসা ও মালিকের কাছ থেকে। প্রধান ফটকের নিচতলায় ইলেকট্রিক সামগ্রীর দোকান সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ, এর মালিক সাইদুর রহমানও একজন ভাড়াটিয়া। তিনি বললেন, ‘মুঘল সম্রাটের সম্পত্তি কীভাবে পাবলিকের হাতে গেল, সেটা দেখা দরকার। এখনো অনেক পর্যটক বড় কাটরা দেখতে আসেন। তাঁরা আমাদের নানা প্রশ্ন করেন। আমাদের নিজেদেরই লজ্জা লাগে ঐতিহাসিক ভবনের এমন অবস্থায়।’ এখানেই আছে স্টার প্রেস। মালিক ফারুক চাকলাদার বললেন, ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি এখানে আছেন। এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি। লিজ নিয়েছেন। তবে তিনিও চান, ভবনটি সংরক্ষণ করা হোক। সব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করলে জায়গা ছেড়ে দিতে তাঁরও আপত্তি নেই। বললেন, ‘আমার স্বার্থ বড় কথা নয়। দেশের সম্মান এর সঙ্গে জড়িত। সরকার যদি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়, তবে উঠে যাব।’
এফ বি ব্রাডলি বার্টও এমন আশা করেছিলেন ১৯০৯ সালে তাঁর বই প্রাচ্যের রহস্য নগরীতে। বড় কাটরার সৌন্দর্যে মুগ্ধ এই বিদেশি ঐতিহাসিক লিখেছিলেন, ‘মনোরম অথচ গাম্ভীর্যপূর্ণ ও সমুন্নতশীর্ষ এই অট্টালিকাটি নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।... কোন কোন প্রাচীর ও দেয়াল ভেঙে পড়েছে। এতত্সত্ত্বেও যতদিন পর্যন্ত দেয়ালগুলোর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে, ততদিনই এর আকর্ষণ ও মনোহারিত্ব কিছুতেই বিনষ্ট হবে না। আশা করা যায়, নয়া সরকার ঢাকার সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্যময় এই অট্টালিকাটির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন।’
এরপর ১০০ বছর পার হতে চলল, বড় কাটরার আর সংস্কারের ব্যবস্থা করতে পারেনি কোনো সরকার। ভেঙে পড়ছে বা ভেঙে ফেলা হচ্ছে এর অবশিষ্ট দেয়ালগুলো। এভাবেই একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ঢাকার প্রাচীন ও সুন্দর ঐতিহাসিক এ ভবনটি।

0 comments:

Post a Comment