Friday, October 9, 2009

সাহিত্যে নোবেল পেলেন জার্মানির হেরটা মুয়েলার

0 comments
রুমানীয় বংশোদ্ভূত জার্মান লেখক হেরটা মুয়েলার সাহিত্যে ২০০৯ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সুইডিশ একাডেমি তঁার এ পুরস্কার পাওয়ার কথা ঘোষণা করে। সাহিত্যিক হিসেবে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তঁার সম্পর্কে বিচারকেরা বলেন, Èহেরটা মুয়েলার তঁার কবিতায় গভীর মনোনিবেশ ও গদ্যে অকপটতার মাধ্যমে বঞ্চিতদের চিত্র তুলে ধরেছেন।'

১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু করার পর থেকে ১২তম নারী হিসেবে হেরটা মুয়েলার এ পুরস্কার পেলেন। এর আগে ২০০৭ সালে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ডোরিস লেসিং সাহিত্যে নোবেল জয় করেন।
হেরটা মুয়েলার ১৯৫৩ সালের ১৭ আগস্ট রুমানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রুমানিয়ার সংখ্যালঘু জার্মান পরিবারের সন্তান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তঁার মাকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি Èশ্রমশিবিরে' পাঠানো হয়। রুমানিয়ায় হেরটার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্য কেটেছে। সত্তরের দশকে তিনি রুমানিয়ার সাবেক স্বৈরশাসক নিকোলাই চসেস্কুর গোপন পুলিশ বাহিনীকে সহযোগিতা না করার অভিযোগে শিক্ষকের চাকরি খোয়ান। ১৯৮৭ সালে অভিবাসী হিসেবে জার্মানিতে পাড়ি জমানোর আগ পর্যন্ত তিনি সরকারের হুমকির মুখে ছিলেন।

১৯৮২ সালে জার্মান ভাষায় লেখা হেরটা মুয়েলারের গল্পসংকলন নাডিরস প্রকাশিত হয়। এটিই তঁার প্রথম বই। বইটি চোরাই পথে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এসব দেশের জার্মানভাষী পাঠকদের কাছে বইটি দারুণভাবে সমাদৃত হয়। গল্পগুলোতে চসেস্কুর শাসনামলে রুমানিয়ার জার্মানভাষীদের গ্রামে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়। এ জন্য তত্কালীন রুমানীয় সরকার হেরটার গল্পগুলো কাটছঁাট করে। ১৯৮৪ সালে অপ্রেসিভ ট্যাংগো (ইংরেজি নাম) নামে তঁার আরেকটি গল্পসংকলন প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটির কাহিনীতেও রুমানিয়ায় জার্মান ভাষাভাষীদের ওপর নিপীড়নের চিত্র ফুটে উঠেছে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস দ্য পাসপোর্ট। এরপর গল্প, উপন্যাস ও কবিতার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে তঁার। মূলত একনায়ক চসেস্কুর আমলে রুমানিয়ায় বেড়ে ওঠা নিপীড়িত মানুষের জীবনচিত্রই উঠে এসেছে তঁার লেখনীতে।
রুমানীয় বংশোদ্ভূত অপর শীর্ষস্থানীয় লেখক রিচার্ড ওয়াগনার হলেন হেরটা মুয়েলারের স্বামী। সূত্র: এএফপি, এপি, বিবিসি, গার্ডিয়ান অনলাইন।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------
*********************************************************************************
কেন হেরটা মুয়েলার
২০০৯-এ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী হেরটা মুয়েলারকে নিয়ে লিখেছেন ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
এ বছর বেশ কানাঘুষা ছিল, ইসরায়েলি ঔপন্যাসিক অ্যামস ঔজ্ কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জয়েস ক্যারল ওটস্ অথবা ফিলিপ রথেরই ভাগ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের শিকেটি ছিঁড়বে। অনেকেরই প্রতীতি ছিল, কোনো না কোনো মার্কিনকে এবার পুরস্কারটি দেওয়া হবে। এসব কানাঘুষা সাধারণত বাস্তবে রূপ নেয় না; নোবেল পুরস্কার মনোনয়নের ব্যাপারে সুইডিশ কমিটি যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করে থাকে। নির্ধারিত সময়ে কমিটির স্থায়ী সচিবের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগ পর্যন্ত জানা সম্ভব হয় না, কাকে পুরস্কার দেওয়া হলো। কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় সম্ভাব্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করে থাকেন; যেমন ২০০৫-এ হ্যারল্ড পিন্টারকে অভ্যন্তরীণ নথিপত্রে ‘হ্যারি পটার’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। সুইডিশ কমিটির সদস্যরা শর্ট লিস্টেড প্রার্থীদের বই পড়ার সময় অন্য বইয়ের জ্যাকেট লাগিয়ে নেন, যাতে বোঝা না যায় তাঁরা কী পড়ছেন।

তার পরও কিছু কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়ে যায়। যাঁরা নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়ে থাকেন, তাঁদের অনেকেই নিজেদের মনোনীত সাহিত্যিকের নাম একসময় আর গোপন রাখেন না। সারা বিশ্ব থেকে শত শত সাহিত্যিকের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য পাঠানো হয়। তা থেকে প্রথমে ২৫ জনের, দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৫ জনের তালিকা করা হয়। বছরের মে মাসের মধ্যে মাত্র পাঁচজনের একটি শর্ট লিস্ট চূড়ান্ত করা হয়। জুন থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিশ্বের সাহিত্যামোদী মহলে জল্পনাকল্পনা চলে, এ শর্ট লিস্টকে কেন্দ্র করে বাজি ধরা হয় সম্ভাব্য সাহিত্যিকদের ওপর।
এটা ঠিক যে এ বছরের সম্ভাব্য সাহিত্যিকদের তালিকায় হেরটা মুয়েলারের নামটি ছিল এবং অ্যামস ঔজ্, জয়েস ক্যারল ওটস্ ও ফিলিপ রথের সঙ্গে এককাতারেই তা কখনো কখনো, বিশেষ করে যতই পুরস্কার ঘোষণার দিন-ক্ষণ এগিয়ে এসেছে, উচ্চারিত হয়েছে। তবু তাঁকেই নোবেলের জন্য মনোনীত করায় আপত্তি উঠেছে। নোবেল কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে এ বছর একটি ভোট গ্রহণ প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ১২ অক্টোবর ২০০৯ পর্যন্ত ১১ হাজার ২৯২ জন ভোটদাতার মধ্যে ৯৩ শতাংশ ব্যক্তি তাঁর কোনো লেখাই পড়েননি। আরেকটি বিষয়ে ভোট নেওয়া সম্ভব ছিল: নোবেল ঘোষণার আগ পর্যন্ত কতজন এ লেখকের নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এতে হিসাবের খুব একটা তারতম্য হতো বলে মনে হয় না। অগ্রগণ্য মার্কিন সাহিত্যিক হ্যারল্ড ব্লুম অকপটে জানিয়েছেন, পড়া দূরের কথা, তিনি এ পর্যন্ত মুয়েলারের নামই শোনেননি। ব্লুমকে সম্ভবত পড়ার চেয়ে লেখা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়; তিনি যত বই লিখেছেন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ জীবনে ততগুলো বই পড়ে উঠতে পারে না।
প্রধানত তুলনামূলকভাবে অপরিচিত হওয়ায় মুয়েলারের নোবেল প্রাপ্তিতে বেশ খানিকটা শোরগোল উঠেছে। খোদ বার্লিনের সাধারণ পাঠকমহলে মুয়েলার খুব প্রিয় কোনো নাম নয়। তবে এটা তো ঐতিহাসিক সত্য যে পাঠকের আনুকূল্য এবং নোবেল পুরস্কার সর্বদা একসঙ্গে যায় না। ১৯১৬ সালে নোবেলজয়ী সুইডিশ সাহিত্যিক ভেনে ভন হাইডেনস্টামের (Verner von Heidenstam) নাম আজ অনেকটাই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে।
জার্মান কথাসাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের পর জার্মানির লেখক হিসেবে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে হেরটা মুয়েলারের মূল্যায়ন হবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে। তবে তা হয়তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাঁর মাত্র চারটি উপন্যাস এবং একটি ছোটগল্প সংকলন আজ পর্যন্ত ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। পুনর্মুদ্রণের আগে সেগুলোও বিশ্বব্যাপী সাধারণ পাঠকের হাতে পৌঁছাবে না। ২০০১-এর পর তাঁর কোনো বই ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়নি।

২.
হেরটা মুয়েলারের প্রথম পরিচয়—তিনি রুমানিয়ায় জন্ম নেওয়া একজন জার্মান। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট তাঁর জন্ম। পরিণত বয়সে, ১৯৮৭ সালে রুমানিয়া ছেড়ে চিরকালের জন্য জার্মানিতে এসে নতুন ঠিকানা করেছেন তিনি। তিন যুগেরও বেশি সময় এরই মধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। তবু রুমানিয়ার জীবন তাঁর সাহিত্যিক চিন্তা-চেতনার প্রধান উপজীব্য। শৈশব-যৌবনের ৩০টি বছর কেটেছে একপতি রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তিনি চিন্তা ও প্রকাশের স্বাধীনতার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। গোপন নিরাপত্তা (এসএস) পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অসম্মত হওয়ায় তাঁকে চাকরি হারাতে হয়েছে। লেখালেখির মধ্যে তিনি একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবীর অন্বেষণ করেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ছিল ১৫টি গল্পের একটি সংকলন, যা ইংরেজি অনুবাদে নাডিরস প্রচ্ছদ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি অনবরত লিখেছেন। বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ অনূদিত হয়েছে।
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার কিছুক্ষণ পর টেলিফোনে নেওয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘আমি গল্প খুঁজি না, গল্পই আমাকে খুঁজে নেয়।’ আবার বলেছেন, ‘আমি মুখ্যত নিজের জন্যই লিখি। লেখার মধ্য দিয়েই বাস্তবতার প্রকৃত রূপটি সঠিকভাবে উপলব্ধ হয়।’ ফলত তাঁর রচনার আখ্যানভাগ আত্মজৈবনিক। কেবল রাষ্ট্রযন্ত্র নয়, নিজ গোত্রের কাছেও তিনি বৈরিতা পেয়েছেন। ফলে তাঁর রচনায় প্রত্যক্ষ হয় আত্মোপলব্ধির নিরঞ্জন প্রতিফলন। পাঠকের মুখাপেক্ষিতা তাঁকে প্রভাবান্বিত করেনি কখনো।
মুয়েলারের ভাষাভঙ্গি সম্পর্কে ‘কবিতার একাগ্রতা’ এবং ‘কথাসাহিত্যের নিরাবরণতা’—এ দুটি কথা ব্যবহার করা হয়েছে ৫৯ সেকেন্ডের নোবেল ঘোষণায়। আর তৃতীয় বিষয়টি তাঁর লেখার উপজীব্য নিয়ে: উদ্বাস্তু মানুষের পরিপ্রেক্ষিত। কেবল এটুকু দিয়ে একজন লেখকের নোবেলযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না; কিংবা তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা সম্পর্কেও নতুন কারও মনে প্রতীতি উত্পাদন করা যায় না। সমনোযোগ পাঠের মাধ্যমেই পাঠককে পরিচিত হতে হবে মুয়েলারের সঙ্গে। তাঁর কোন বইটি প্রথমে পড়বেন? মুয়েলার বলেছেন, সর্বশেষ বইটি নিতে যার প্রচ্ছদ নাম রাখা হয়েছে Die Atemschaukel; সর্বশেষ এ বইটি এখনো প্রকাশের অপেক্ষায়। ডোনাল ম্যাকলাফলিনের ইংরেজি অনুবাদের প্রচ্ছদ নাম দেওয়া হবে Everything I Possess I Carry With Me (বাংলায়: আমার যা কিছু আছে তা নিয়েই আমি পথ চলি)। এ উপন্যাসের প্রথম অনুচ্ছেদ থেকে মুয়েলারের রচনাশৈলী সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া কি সম্ভব?
‘১৯৪৫-এর জানুয়ারি, কিন্তু যুদ্ধ তখনো চলছিল। এ গভীর শীতের মধ্যে রুশরা আমাকে কে জানে কোথায় নিয়ে যাবে শুনে সবাই আমার জন্য কিছু না কিছু একটা নিয়ে এসেছে; সেগুলো হয়তো কোনো কাজেই লাগবে না। আসলেও আর কিছুতেই কিছু যাবে-আসবে না আমার। কপালের ফের অপরিবর্তনীয়: রুশদের তালিকায় আমার নাম উঠে গেছে, অতএব সবাই কিছু না কিছু নিয়ে এসেছে, আর যার যা মনে এসেছে কোনো একটা পরিণতি ভেবে নিয়েছে। সবই আমি গ্রহণ করেছি। আর সেই ১৭ বছর বয়সেই ভেবেছি, বিদায় হওয়ার জন্য সময়টা আদৌ মন্দ নয়। রুশদের তালিকায় নাম না উঠলেও হয়তো আমি কেটে পড়তাম, পরিস্থিতি এতটাই খারাপ মোড় নিয়েছিল যে সেটাই যথোচিত হতো। এ শহরটার ঘেরাটোপ থেকে আমি নিষ্কৃতি চেয়েছিলাম। এটা এমন একটা শহর, যার পাথরগুলোও নজরদারি করে। ভেতরে ভেতরে আমি যতটা অধীর হয়ে উঠেছিলাম ভয় ততটা দানা বাঁধেনি। আর আমার নীতিবোধের বালাই যতটুকু ছিল, তাতে ওই রুশদের তালিকায় নাম ওঠা নিয়ে আত্মীয়স্বজনের মনঃকষ্ট আমাকে তেমন বিচলিত করেনি। তাদের আশঙ্কা, ভিনদেশে আমার পোড়া কপালে না জানি কী ঘটবে! আর আমি চেয়েছিলাম, এমন কোথাও যেতে, যেখানে আমাকে চিনে ফেলার মতো কেউ নেই।’
একটি অংশে আমরা পাঠ করি, ‘সুগভীর নৈঃশব্দ্যের মধ্যে আমি নিজেকে অন্তরীণ করেছি এবং তা এত দীর্ঘকাল ধরে যে ভাষায় আর নিজেকে অবমুক্ত করতে পারি না। আমার মুখ খোলা মানে নিজেকে নতুন কোনো মোড়কে আবৃত করা।’ তাঁর মাতৃভাষা জার্মান। কিন্তু তাঁর রচনাশৈলীতে রুমানীয় ভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁর ভাষার যে কাব্যিক সৌন্দর্য সুইডিশ কমিটি প্রত্যক্ষ করেছে, তা সম্ভবত রুমানীয় ভাষার অবদান। উদ্ধৃতিতে এ কাব্যিকতা আভাসিত। মুয়েলার নিজেও বলেছেন, রুমানীয় বাক্প্রতিমার সমৃদ্ধি উপেক্ষণীয় নয়।
ইংরেজিতে অনূদিত উপন্যাস দি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আলোচনাক্রমে নিউইয়র্ক টাইমস-এর গ্রন্থালোচক পিটার ফিলকিনস লিখেছিলেন, মুয়েলারের উপন্যাসপাঠ সহ্যশক্তির পরীক্ষা বটে, সেটা আদৌ সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নয়। উপর্যুক্ত ক্ষুদ্র উদ্ধৃতির ভিত্তিতে কোনো ঔপন্যাসিকের মূল্যায়নের প্রচেষ্টা কেবল অন্যায্য নয়, তা আস্পর্ধাও বটে। তবে এটুকু প্রতীয়মান হয় যে মুয়েলার মূলত গল্পকার নন। কথকতা তাঁর বৈশিষ্ট্য এবং শ্রোতার মুখাপেক্ষিতা তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করে না। কী এ লক্ষ্য? তাঁর লক্ষ্য নিজ অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা। অতএব তাঁর বিষয়বস্তুর বৈশিষ্ট্য আত্মজৈবনিকতা। তিনি বলেছেন, সাহিত্য সর্বদাই এমন ঘটনা থেকে উত্সারিত, যা কাউকে সরাসরি রক্তাক্ত করেছে এবং একশ্রেণীর সাহিত্যে বিষয়বস্তু নির্বাচনে লেখকের ভূমিকা থাকে না; বরং তিনি সে বিষয়ই উপজীব্য করেন যা তাঁর ওপর নিক্ষেপিত হয়েছে।
এটা ঠিক যে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, একপতি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকৃতাচার, পরিপার্শ্বের অন্যায় বৈরিতা বা কয়েদখানার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস রচিত হয়েছে; কিন্তু মুয়েলারের সঙ্গে একমত হওয়া দুরূহ যে লেখকের ব্যক্তিগত রক্তক্ষরণই সাহিত্যের প্রধান উত্স-সরোবর। কেননা মানুষের জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। সাহিত্য কেবল অভিজ্ঞতার প্রতিফলন নয়, এতে কল্পনার একটি তাত্পর্যপূর্ণ অবদান আবশ্যক। অনস্বীকার্য যে ভাষার কুশলতা এবং প্রকাশভঙ্গির স্বকীয়তা একজন লেখককে বিশিষ্ট করে তোলে। বলা যায়, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির কারণেই একজন গল্পকার পরিণত হয় কথাসাহিত্যিকে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে গল্পই পাঠকের প্রধান অভীষ্ট। এ লক্ষ্য এড়িয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছানো ঔপন্যাসিকের জন্য দুরূহ। হয়তো হতভাগ্য রুমানিয়ার একপতি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নে ধর্ষিত সমাজ-মানসের প্রতিরূপ সাহিত্যে হেরটা মুয়েলারের মতো নিখুঁতভাবে ধারণ করা আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু এটাই একজন লেখকের মূল দায়িত্ব কি না, সে প্রশ্ন চিরকালই তর্কাধীন হয়ে থাকবে। মহত্ লেখক আত্মসত্তা কিংবা সমাজ—সম্ভবত কারও কাছেই দায়বদ্ধ থাকেন না; দায়বদ্ধতার ঋণ পরিশোধ করা ঔপন্যাসিকের কাজ নয়।

0 comments:

Post a Comment