Sunday, October 4, 2009

নাচিয়ে যেমন নাচায় তেমনই নাচে

0 comments
পুতুল কি নাচতে পারে? সে কি গাইতে পারে? পারে না। পারে যে না, তা জানে সবাই। তা সত্ত্বেও পুতুলের লোকপ্রিয়তা অশেষ। শৈশবে খেলার পুতুল, বয়সকালেও মনমাতায় বোবা পুতুল। পুতুলে অনুরাগ মানুষের কম-বেশি আশৈশব। কারো আনন্দ পুতুল নাচিয়ে, কারো মনখুশি হয় পুতুলের নাচ দেখে। পুতুল নাচের ইতিকথা, সে অবশ্য ভিন্ন ব্যাপার। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাসের নাম এটি। ভাবজগতের মানুষ যারা, তারা নিজেদেরও ভাবেন পুতুল হিসেবে। তারা স্রষ্টার প্রেমে মগ্ন হয়ে গেয়ে উঠেন, যেমনি নাচাও, তেমনই নাচি পুতুলের কি দোষ! আবার কেউ কেউ নিজেরাই পুতুল সাজিয়ে পুতুল নাচান। পুতুল নাচিয়ে তারা আনন্দ খোঁজেন, অন্যদের আনন্দিত করেন। তাদের অন্ন সংস্থানও হয় এই করে। কাজেই পুতুল নাচানো একটি পেশাও বটে।

পুতুল নাচ বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির অংশ। নির্মল বিনোদনের চমৎকার মাধ্যম। পুতুল নাচের চল আছে বিদেশেও। আমরা বলি পুতুল নাচ। ইংরেজীভাষীরা একে চেনেন পাপেট, পাপেট শো কিংবা পাপেট থিয়েটার নামে। সাধারণ পুতুল আর নাচের পুতুলের মধ্যে ব্যবধান বিসত্দর। বাচ্চাদের খেলার পুতুল, সে নাচতে পারে না। আধুনিককালের ব্যাটারি চালিত কোনো কোনো পুতুল হয়তো নড়াচড়া করতে পারে, কিন্তু নাচিয়ের ইচ্ছেমত নাচতে পারে না। কাজেই নাচার জন্য চাই অন্যরকম পুতুল, যে ফলো করতে পারে নাচিয়ের প্রতিটি নির্দেশ। সে জন্যেই নাচের পুতুল বানাবার জন্য রয়েছে আলাদা কারিগর। শোলা, কাঠ, কখনো কখনো মাটি দিয়েও তৈরি হয় ছোট ছোট নাচের পুতুল। এদের পোশাক পরিয়ে, মাথায় লম্বা কিংবা খাটো পাটের চুল লাগিয়ে সাজানো হয় নারী-পুরম্নষ, বালক-বালিকা কখনোবা রাজা-রাণী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কান্দিপাড়া একদা নাচের পুতুল তৈরির জন্য ছিল দেশ বিখ্যাত। কারিগরদের প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। এখন অনেক মুসলমানও এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।

পাপেট। পাপেট্রি। পাপেট শো বা পাপেট থিয়েটার নামে চেনে একে বিদেশীরা। নাটকের মতোই পুতুল নাচের জন্যও প্রয়োজন একটি মঞ্চ। এক বা একাধিক ব্যক্তি কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো নেপথ্যে থেকে সুতো টেনে পুতুল নাচিয়ে নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেন। পুতুলগুলো সাধারণত মাটি ও কাঠের তৈরি। এসব পুতুলের ওপরের অর্ধাংশে রং দিয়ে আকা হয় চোখ, মুখ, নাক, কান প্রভৃতি।

নাচের পুতুল সাধারণত চার ধরনের হয়ে থাকে। তারের পুতুল, লাঠি পুতুল, বেনীপুতুল ও ছায়াপুতুল। তারের পুতুল সূক্ষ্ম তার বা সূতার সাহায্যে এবং লাঠি পুতুল লম্বা সরম্ন লাঠি দিয়ে নাচানো হয়। আর দুই বা ততোধিক পুতুল যখন এক সঙ্গে বেঁধে হাত দিয়ে নাচানো হয় তখন তাকে বলা হয় বেনী পুতুল।



সাধারণ নাটকে স্থানের সীমাবদ্ধতা থাকলেও পুতুলনাচে তার বিসত্দৃতি অনেক। জলের প্রাণী, আকাশের পাখি, ডাঙ্গার মানুষ, বনের পশু সবই কাহিনীর প্রয়োজনে একসঙ্গে এক মঞ্চে অভিনয় করে। নির্বাক পুতুলসহ সকল প্রাণীই নিজস্ব আচার-আচরণের পাশাপাশি মানুষের ভাষায় কথা বলে। এর ফলে পুতুল নাচ হয়ে ওঠে প্রাণবনত্দ ও আনন্দময় এবং সকল বয়স ও শ্রেণীর দর্শকরা তা সানন্দে উপভোগ করে। চরিত্রানুযায়ী পোশাক-পরিচ্ছদ, রূপ-সজ্জা এবং নানাবিধ উপকরণ সংযোজন করে পরিচালক পুতুলের অভিনয়শৈলী তুলে ধরেন। বিশ শতকে আধুনিক শিল্পকলা হিসেবে পুতুলনাচ স্বীকৃত হয় এবং টেলিভিশন আবিষ্কারের পর তা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে।

মধ্যযুগে ইটালিতে 'পুলসিনেলো' নামে আবির্ভাব ঘটে সূতা পাপেটের, ফ্রান্সে যার নাম হয় 'পেলসিনেল'। দসত্দানা পাপেটের জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে জন্ম দেয় 'পাঞ্চ'। এই 'পাঞ্চ' প্রতিরূপ দৃষ্ট হয় রাশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে, জার্মানি ও সুইডেনে পাঞ্চের নাম 'কাসপার' হল্যান্ড 'ইয়ান ক্লাসেন' এবং হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ায় 'ভাসিলচে'। এছাড়াও মিশর, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইন, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলংকার পুরানো ও আধুনিক ধারার পুতুলনাচের অসত্দিত্ব বিদ্যমান। ভারতের ডলস-থিয়েটার এবং বর্তমান পাপেট থিয়েটার আধুনিক ধারায় পুতুলনাচের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে পুতুলনাচের প্রায় হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। এখানে তারের পুতুল, লাঠি পুতুল ও বেণী পুতুল এই তিন ধরনের পুতুলনাচের প্রচলন আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কয়েকটি দল পুতুলনাচের প্রাচীন ধারাকে আজো ধরে রেখেছে। এখন অনেক পেশাদার শিল্পী ধর্ম নিরপেৰভাবে পুতুলনাচের দল গঠন ও পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশে তারের পুতুল ও লাঠি পুতুলের চর্চাই বেশি হয়। এৰেত্রে শিল্পী দু'হাতে সর্বোচ্চ ৩টি পুতুল ধরে সংলাপ বা সুরের তালে তালে পুতুলকে নাচান। পুতুলনাচে সাধারণত রাধাকৃষ্ণ, সীতাহরণ বা রামায়ণ মহাভারতের অন্যান্য কাহিনী এবং লোক জীবনের কিস্সা, পালাগান ইত্যাদি তুলে ধরা হয়। এছাড়া সমসাময়িক ঘটনাবলি যেমন- শিশু, নারী ও বয়স্ক শিৰা, সুখী, পরিবার, দাম্পাত্য জীবন, প্রেম বিরহ, জামাই-শাশুড়ি ও বউয়ের কলহ ইত্যাদিও লৰ্য করা যায়। বিভিন্ন মেলা ও লোকজ উৎসব অনুষ্ঠানে পুতুল নাচের আসর বসে।

এ কালে পুতুল নাচ হয়েছে আরো স্মার্ট এবং চিত্তগ্রাহী। টেলিভিশনের পর্দাতেও দেখতে পাওয়া যায় মনোমুগ্ধকর পাপেট শো। শিল্পী মোসত্দফা মনোয়ার এৰেত্রে পথিকৃৎ বাংলাদেশে। পাপেটের অংশগ্রহণে বাচ্চাদের টিভি অনুষ্ঠানগুলো হয়ে ওঠে আরো অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। ফারিয়া আনজুমান

0 comments:

Post a Comment