Friday, October 9, 2009

সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইবু্ন্যালে যাচ্ছে বাংলাদেশ

0 comments
 ভারত ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে চিঠি
সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইবু্ন্যালে যাচ্ছে বাংলাদেশ
সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জাতিসংঘের সালিস আদালতে (আরবিট্রেশন ট্রাইবু্ন্যাল) যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারত ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে তাদের দাবি করা সীমায় বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের কথাও বলা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তাঁর মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারত ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে বাংলাদেশের জাতিসংঘে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
'যত বাধাই আসুক না কেন, আমরা গ্যাস উত্তোলন করবই' গত বুধবার সংসদে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের এক দিন পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ঘোষণা দিল।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা রয়েছে। কিন্তু দেশের সব প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সম্পদের প্রয়োজন। এ কারণেই বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে, তা আহরণ ও ব্যবহার করতে হবে। সেটি করতে হলে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা দরকার। তাই আনক্লজ (জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত সনদ) অনুযায়ী আমরা আরবিট্রেশনে যাওয়ার জন্য ভারত ও মিয়ানমারকে চিঠি দিয়েছি।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমরা চাই, আলোচনার মাধ্যমে শানি্তপূর্ণভাবে বিষয়টির সমাধান হোক। কিন্তু দীর্ঘ সময় বিষয়টি ঝুলে থাকলে সাগরের গ্যাস বা সম্পদ আহরণ করে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের সম্পদ ও সমুদ্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এটিই যথাযথ পদক্ষেপ।' তিনি বলেন, এর ফলে জাতিসংঘের অধীনে আদালত বসবে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। এর বাইরেও বাংলাদেশ আলোচনার সব দরজাই খোলা রাখছে।
আরবিট্রেশনে যাওয়ার ফলে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো অবনতি ঘটবে কি না, জানতে চাইলে দীপু মনি বলেন, 'এতে সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে না। ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। প্রধানমন্ত্রী কিছুদিনের মধ্যেই ভারত যাবেন।'
পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস সাংবাদিকদের বলেন, চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও মিয়ানমার ৩০ দিনের মধ্যে তাদের অবস্থান জানাবে। এরপর বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জাতিসংঘে আদালত বসবে। তবে একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও চলবে। আলোচনার মাধ্যমে ইতিবাচক সমাধান হলে বাংলাদেশ আরবিট্রেশন থেকে সরে আসবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কমোডর খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এই চিঠির মাধ্যমে জাতিসংঘে আরবিট্রেশনের প্রাথমিক প্রক্রিয়ার সূচনা হলো। সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তিতে জাতিসংঘে এখন পাঁচ সদস্যের আদালত বসবে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে একজন ও ভারতের পক্ষে একজন থাকবেন। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে আরও তিনজন বিচারক থাকবেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষে সেখানে আইনি লড়াই করবেন ব্রিটিশ আইনজীবী ভন লুই।
এদিকে গতকাল এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্রসচিব জানিয়েছেন, সমুদ্রসীমা নিয়ে ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ সম্মেলনে স্বীকৃত আইনের আওতায় বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের দাবির বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। এই তিনটি দেশই ১৯৮২-এর আইনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে বিরোধ নিষ্পত্তিতে এ-সংক্রান্ত ট্রাইবু্যনালের আদেশ মানতে তিনটি দেশই বাধ্য।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বঙ্গোপসাগরে খনিজ সম্পদ আহরণের ওপর দেশের ভবিষ্যত্ উন্নয়ন অনেকটাই নির্ভর করছে। জাতিসংঘে দেওয়া ভারত ও মিয়ানমারের দাবি অন্যায্য উলে্লখ করে তিনি বলেন, এর ফলে সাগরে বাংলাদেশের খনিজ অনুসন্ধানের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
পররাষ্ট্রসচিব আরও বলেন, 'প্রতিবেশী দেশ দুটির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে আমরা আন্তরিক। আমরা এখনো আশাবাদী, এ নিয়ে সমঝোতায় পৌছানো সম্ভব হবে। আর তা যদি না-ও হয়, তবে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আইনি পথ তো খোলা রইল।'
মিজারুল কায়েস বলেন, 'সমঝোতার আলোচনা চালিয়ে গেলেও আমরা এর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করব না। কারণ, গত ৩৫ বছরের আলোচনায় আমরা কোনো ফল দেখিনি। এ কারণেই বাংলাদেশ জাতিসংঘে যাচ্ছে।'



 বিরোধ মেনেই সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে রাজি কনোকো । অরুণ কর্মকার
বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে প্রণীত নিজস্ব সমুদ্র আইন অনুযায়ী দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছিল। ভারত ও মিয়ানমারও নিজেদের মতো করে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছে। তিনটি দেশ প্রতিবেশী হওয়ায় ভেৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এক দেশের মধ্যে অপরের সীমানারেখা ঢুকে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় যে ২৮টি তেল-গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে, এর ১৭টি মিয়ানমার এবং ১০টি ভারত নিজেদের এলাকায় বলে দাবি করছে। মূলত এই নিয়ে সমুদ্রসীমার বিরোধ শুরু হয়েছে।

তবে ভারত ও মিয়ানমার শুধু দাবি করেই বসে নেই। তারা তাদের নিজ নিজ দাবি করা সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরুও করে দিয়েছে। ফলে অবস্থানগত দিক দিয়েও তারা বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে আছে।
জাতিসংঘের সমুদ্রসীমাবিষয়ক আইনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশীদের মধ্যে এ রকম বিরোধ দেখা দিলে তা দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার চষ্টো করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে যেকেউ আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। বাংলাদেশ এখন যে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে, সেটি জাতিসংঘের সমুদ্রসীমাবিষয়ক আইনের অধীনে গঠিত একটি সালিসি আদালত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কমোডর খুরশিদ আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, Èআমরা প্রায় ৩৫ বছর তো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই বিরোধ মীমাংসার চষ্টো করেছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এখন আমাদের সমুদ্রসীমায় প্রায় সবগুলো তেল-গ্যাসক্ষেত্রের ওপরই হয় ভারত নাহয় মিয়ানমার মালিকানা দাবি করছে। এখন তো আর আমাদের বসে থাকার সময় নেই।'
এক প্রশ্নের জবাবে কমোডর খুরশিদ আলম বলেন, Èমহীসোপানের ওপর আমাদের দাবি জানানোর যে সময় আছে ২০১১ সালের জুন মাস পর্যন্ত, এর মধ্যেই আমরা জাতিসংঘে এই দাবি জানাব।'
সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি করতে কনোকো ফিলিপসের ইতিবাচক সাড়া: বাংলাদেশ সমুদ্রসীমায় দ্রুত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করতে চায়। এ জন্য উত্পাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) স্বাক্ষরে মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ নম্বর ক্ষেত্রের মধ্যে ভারত ও মিয়ানমারের দাবি করা এলাকা বাদ দিয়ে অনুসন্ধানের সরকারি শর্ত মেনেই তারা কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে।
ভারত ও মিয়ানমারকেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, তাদের দাবির বিষয়টি ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত সংশি্লষ্ট এলাকায় বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করবে না। তবে বিষয়টির আইনগত ফয়সালার অব্যাহত চষ্টো চালানো হবে। এই চষ্টোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাও করতে পারে, কনোকো ফিলিপসকে তাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নীতিগত এই বিষয় ছাড়াও মডেল পিএসসিতে কিছু শব্দ ও ভাষাগত সংশোধন এবং আরও কয়েকটি বিষয় সুনির্দষ্টিভাবে উলে্লখ করার বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত প্রকাশের মধ্য দিয়ে পেট্রোবাংলা ও কনোকো ফিলিপসের মধ্যকার চার দিনের প্রাথমিক আলোচনা গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এই কাজগুলো শেষ করার পর উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বিতীয় দফার বৈঠক হবে। এর মধ্যে আগামী ১৪ অক্টোবর আইরিশ কোম্পানি টালে্লার সঙ্গে পেট্রোবাংলা আলোচনা শুরু করবে অগভীর সমুদ্রের ৫ নম্বর ব্লকে পিএসসি স্বাক্ষরের বিষয়ে। সংশি্লষ্ট সরকারি সূত্রে এই খবর জানা গেছে।
কনোকোর সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও সরকারি প্রতিনিধিদলের প্রধান মোক্তাদীর আলী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, Èআমরা উভয় পক্ষই আলোচনায় সন্তুষ্ট। নীতিগত কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য হয়নি। তবে পিএসসিতে কতিপয় বিষয় সুনির্দষ্টিভাবে উলে্লখ করার জন্য দুই পক্ষই আমরা একমত হয়েছি।'
এই বিষয়গুলো কী জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, পিএসসিতে উলে্লখ করার জন্য নির্ধারিত প্রথম বিষয় হচ্ছে ভারত ও মিয়ানমারের বর্তমান দাবি করা এলাকায় অনুসন্ধান না চালানো। দ্বিতীয়ত, এগুলো Èফোর্স মেজার' হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাত্ এভাবে বন্ধ রাখার জন্য ঠিকাদার (কনোকো ফিলিপস) দায়ী থাকবে না। তৃতীয়ত, পিএসসি অনুযায়ী পেট্রোবাংলা ও ঠিকাদারের মধ্যে বিরোধাত্মক কোনো বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যস্থতায় মীমাংসা না হলে নিষ্পত্তি করা হবে বাংলাদেশের সালিসি আইন ২০০১ অনুযায়ী এবং সালিসের স্থান হবে একমাত্র ঢাকা। এখানে সংশোধন করে ঢাকা ছাড়া দ্বিতীয় একটি স্থানের নাম অন্তভর্ুক্ত করা হবে। চতুর্থত, ঠিকাদারের কাজের কোনো পর্যায়ে যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষতি হয়, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ (তৃতীয় পক্ষের ক্ষতিপূরণ) দিতে হবে প্রকৃত ক্ষতির সমপরিমাণ।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, এগুলো ছাড়া প্রায় সবই হচ্ছে ভাষাগত সংশোধন। আলোচনায় উভয় পক্ষ যেভাবে সম্মত হয়েছে, সেভাবে পিএসসিতে এই সংশোধন ও সংযোজনগুলো করে পেট্রোবাংলা পাঠাবে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে সেটি আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আবার কনোকো ফিলিপসকে আহ্বান জানানো হবে পরবর্তী আলোচনার জন্য।

0 comments:

Post a Comment