অস্বাভাবিক আকৃতি সব সময়ই মানুষকে সবসময় সংকুচিত করে। শিকার হতে হয় নানা বিব্রতকর পরিস্থিতির। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে অসহনীয় হয়ে ওঠে জীবন। ইচ্ছা করে বনে গিয়ে বাস করতে। কিন্তু চাইলে কি আর বনে বাস করা যায়? তবে বনে বাস করা যাক আর না যাক আলাদা গ্রাম করতে তো বাধা নেই। এমনই একটি গ্রাম ভারতের উদালওড়ি। এখানে বসতি গড়ে তুলেছেন বামনরা। ভুটান সীমান্তের কাছে উদালওড়ির টংলা বাজার থেকে কিলোমিটার দেড়েক ভেতরে এর অবস্থান। সে দেশে এটাই বামনদের প্রথম গ্রাম। এটাকে তারা গ্রাম নয়, স্বর্গ মনে করেন। আর পাঁচটা গ্রামের মতোই চারপাশ। গাছপালা, কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ির মধ্য দিয়ে ইট-মাটির রাস্তা। চাটাই ঘেরা বসতবাড়ি। পার্থক্য শুধু বাসিন্দা। দিনের পর দিন লম্বা মানুষদের তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বিরুদ্ধে লড়াই করে অসামান্য উচ্চতায় পেঁৗছে গেছে বামনরা। কয়েক বছর আগে লড়াইটা শুরু হয়েছিল আড়াই থেকে তিন ফুট উচ্চতার মানুষদের। প্রেরণা জুগিয়েছিলেন নাটকপাগল পবিত্র রাভা। কিন্তু তিনি বামন নন। স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষ। তবে বামনদের জন্য রয়েছে তার অস্বাভাবিক মমতা। ২০০৩ সালে দিলি্লর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে পাঠ নিয়ে টংলায় নিজের প্রত্যন্ত গ্রামে ফেরেন এ যুবক। বামনদের প্রতি সমাজের অবহেলা দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন। তাই নিজের হাতে গড়া নাট্যদল দাপোন (দর্পণ)-এ পবিত্র টেনে আনলেন বামনদের। ২০০৮ সালে খর্বকায় মানুষদের নিয়ে করলেন কর্মশালা। দেড় মাসের কর্মশালা শেষে ২৩ বামন ও বিশাল বপু সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মঞ্চস্থ করলেন নাটক 'কিনো কঁও'। গৌহাটি, কোকরাঝাড়, ডিব্রুগড় হয়ে ওই নাটক পাড়ি দেয় দিলি্ল। দর্শকদের চেতনায় চাবুক মেরে যায় বামন বাহিনী। দিলি্ল জয় করে বিমানে চেপে ঘরে ফেরার পর তাদের নিয়ে বিদ্রূপ করাটা কমে আসে। আর এখান থেকেই শুরু হয় আরেক স্বপ্নের। তাদের নিজস্ব বসতির।
এ গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ অক্ষয় কুমার দাস। উচ্চতা বড়জোর আড়াই ফুট। মুখে হাসি লেগেই থাকে। বললেন, শিরদাঁড়া কিছুটা শক্ত হয়েছে। এবার নতুন পৃথিবী গড়ার পালা, যেখানে স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষের কাছে খেলার জিনিস হয়ে থাকতে হবে না বামনদের। ১৮ বছর ধরে মুনলাইট সার্কাসে জোকারের চাকরি করছেন জেমস দইমারি। তিনি বলেন, 'বাওনা'রা কাজ কিছু কম পারে না। তাদের দুঃখ-কষ্ট বাইরের সমাজ বোঝেনি। অক্ষয় ও জেমস, দু'জনের স্ত্রীই লম্বা। গ্রাম গড়া শেষ হলেই সপরিবারে চলে আসবেন তারা।
অক্ষয় বলেন, বাড়ির লোকের আপত্তি সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করে নুমোলি। তাদের ছেলে ম্যাট্রিক দেবে। মেয়ের বয়স ১২ বছর। দু'জনেরই লম্বা গড়ন। জেমস হাসতে হাসতে বলেন, ওর স্ত্রী সার্কাসেই কাজ করত। শুধু ছুটি চাইত। ম্যানেজার জোকারকে বিয়ে করার শর্ত দিলেন। জন্মভূমিতে যাওয়ার লোভে বামন জোকারকে বিয়ে করতে রাজি হয় বেচারি। তাদের ঘরে পাঁচ মেয়ে। দু'জন বামন; তিনজন স্বাভাবিক।
পবিত্র বলেন, চার বিঘা এলাকায় পুকুর, অসমিয়া ও বড় মাধ্যমের স্কুল। ৮ বাই ১০ ফুটের খান পনেরো ঘর। একটি নামঘর, পাঠাগার, কর্মশালা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ঘর, প্রেক্ষাগৃহও গড়া হবে। এক প্রান্তে উন্মুক্ত মঞ্চও গড়ার কথা ভাবছেন তিনি। থাকবে প্রবীণদের বসতি। সেই সঙ্গে ফুটবল ও বাস্কেটবল কোর্ট। তার দলে ২৩ জন বামন রয়েছে। আশপাশের সব এলাকা মিলিয়ে এ সংখ্যা ৭০। সবাইকে এ গ্রামে নিয়ে আসতে চান তিনি।
পবিত্রর স্ত্রী প্রীতি বলেন, গ্রাম গড়তে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ কোটি টাকার ধাক্কা। ছবিতে অভিনয় করে অর্জিত সব অর্থ বেরিয়ে যাবে। অর্থের জন্য বড়ল্যান্ডের প্রধান হাগ্রামা মহিলারির দ্বারেও গেছেন পবিত্র।
সূত্র :আনন্দবাজার অনলাইন
0 comments:
Post a Comment