ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শহীদুল্লাহ হল ও আশপাশের এলাকাজুড়ে একসময় ছিল বিশাল বাগান। তখন এর নাম ছিল বাগ-ই-মুসা খাঁ। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ওই বাগান তৈরি করেছিলেন ইতিহাসখ্যাত বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খান। এখন এ জায়গায় বাগান কিংবা আরণ্যক পরিবেশের ছিটেফোঁটাও নেই। আছে নতুন করে লাগানো কিছু নারিকেল ও কয়েকটি পলাশগাছ। আর কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা_'মুসা খান মসজিদ'।
শহীদুল্লাহ হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে তিন গম্বুজবিশিষ্ট প্রাচীন, জরাজীর্ণ এ মসজিদ এখন হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। চারপাশে গজিয়ে উঠেছে বহুতল ভবন। নির্দেশক কোনো সাইনবোর্ড নেই। দীর্ঘদিন মসজিদটির সংস্কারও নেই। অনেকটা অনাদর, অবহেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে বারো ভুঁইয়াদের অতীত গৌরব। ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খানের নামে মসজিদটির নামকরণ। মুসা খানের কবরও রয়েছে কাছেই, মসজিদের উত্তর-পূর্ব পাশে।
বাবা ঈশা খাঁর মতো মুসা খান ছিলেন পরাক্রমশালী ও খ্যাতিমান। রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা সুবাদার ইসলাম খানকে এখানে আসার পথে প্রবল বাধা দিয়েছিলেন তিনিই। কয়েকবার লড়াই হয়েছিল সমানে সমান। তবে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছিলেন মুসা খান।
মসজিদের নাম মুসা খান হলেও ধারণা করা হয়, এ মসজিদের নির্মাতা তিনি নন। এর স্থাপত্যরীতি দেখে ঐতিহাসিকরা মত দেন, শায়েস্তা খানী রীতিতে নির্মিত মসজিদটি আসলে নির্মাণ করেছিলেন মুসা খানের ছেলে মাসুম খান কিংবা পৌত্র দিওয়ান মুনওয়ার খান। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়াও তাঁর 'বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ' বইয়ে এটি উল্লেখ করেছেন। পিতা বা পিতামহের নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিল বলেই লেখকের অনুমান। মসজিদে কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি বলে এর সঠিক নির্মাণকাল ও নির্মাতার নাম নিয়ে এ ধরনের ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের শুরুর মধ্যে মসজিদটি নির্মিত বলে ঐতিহাসিকদের অনুমান।
মুসা খান মসজিদ দেখতে খাজা শাহবাজের মসজিদের (তিন নেতার মাজারের পেছনে) মতো। ভূমি থেকে উঁচু মঞ্চের ওপর মসজিদটি নির্মিত। নিচে অর্থাৎ মঞ্চের মতো অংশে আছে ছোট প্রকোষ্ঠ। এগুলো এখন বন্ধ। দক্ষিণ পাশ দিয়ে ১২ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় মসজিদের দরজায়। পূর্ব দিকে খোলা বারান্দা। চওড়া দেয়াল। পূর্ব-পশ্চিমের দেয়াল ১ দশমিক ৮১ মিটার ও উত্তর-দক্ষিণের দেয়াল ১ দশমিক ২ মিটার চওড়া। পূর্বের দেয়ালে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে দুটি খিলান দরজা। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালের মধ্যে একটি প্রধান এবং পাশে দুটি ছোট মেহরাব। চারপাশের দেয়ালে মোগল রীতির নকশা। বাইরের দেয়ালের চার কোণে চারটি মিনারখচিত আট কোণ বুরুজ। এর পাশে ছোট ছোট মিনার। বুুরুজ ও ছোট মিনার ১৬টি। ছাদে তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি বড়। ওপরের কার্নিশ নকশাখচিত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদের বাইরের দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেছে। ছাদ ও কার্নিশে জন্মেছে পরগাছা। অজুখানা ও শৌচাগারেরও বেহাল অবস্থা।
এখানে যাঁরা নিয়মিত নামাজ পড়তে আসেন, তাঁদের দাবি মসজিদটি সংস্কার করা হোক। ষাটোর্ধ্ব কেরামত উল্লা আক্ষেপ করে বলেন, 'এটি আমাদের একটি গৌরব। কিন্তু মসজিদটি দেখার কেউ নেই।'
নওশাদ জামিল
0 comments:
Post a Comment