পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী একটি এলাকার নাম শাঁখারীবাজার। শাঁখারিদের তৈরি শাঁখার জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা। শাঁখারিদের আবাসিক এলাকা হিসেবে এটি এখনও বহন করছে নানা স্মৃতি ও ঐতিহ্য। ১৮৮৩ সালে বাংলায় শাঁখারিদের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৪৫৩ জন। তার মধ্যে পূর্ববঙ্গে বাস করতেন ২ হাজার ৭৩৫ জন। ঢাকায় ৮৩৫ জন এবং বাকিরা বাস করতেন বাখরগঞ্জে। পূর্ববঙ্গে শাঁখারিরা এসেছিলেন বল্লাল সেনের সঙ্গে। বিক্রমপুরে তাদের সেই স্মৃতি বহন করেছিল একটি বাজার। সেটি হলো শাঁখারীবাজার। সতের দশকে লাখেরাজ জমির প্রলোভন দেখিয়ে মোগলরা ঢাকায় এসে শাঁখারিদের নতুন শহর ঢাকায় নিয়ে আসে। সে সময় শাঁখারিরা ঢাকায় এসে একটি অঞ্চল বেছে বসবাস শুরু করেন। যেটি বর্তমানে শাঁখারীবাজার নামে সবার কাছে পরিচিত। ১৬৬৬ সালে পর্যটক ট্যাভারনিয়ার যখন ঢাকায় আসেন, তখন এ অঞ্চলে শাঁখারিদের বসবাস করতে দেখেন।
সেই থেকে এখনও একটি গ্রুপ পেশা ও পুরনো রীতিনীতি অক্ষুণ্ন রেখে একই জায়গায় বসবাস করছেন। এখন যেমন গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার জমি উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়, এরূপ উনিশ শতকের মধ্যভাগে শাঁখারীবাজারের জমির উচ্চমূল্য ছিল। শাঁখারিদের বাসগৃহের স্থাপত্য ছিল একটু স্বতন্ত্র ধরনের। ওয়াইজের মতে, লাখেরাজ শাঁখারিদের দেওয়া জমি আয়তনে ছিল ক্ষুদ্র। সেই আয়তন মেনেই নির্মিত হয় বাসগৃহ। সেই বাসগৃহ ছিল দোতলা। সামনে মূল ফটক হতো ছয় ফুটের মতো। করিডোর ছিল ২০-৩০ ফুট লম্বা। শাঁখারিদের অধিকাংশ ছিলেন নিরামিষভোজী এবং বিষ্ণু বা কৃষ্ণের অনুসরণকারী। ভাদ্রের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতো তাদের প্রধান উৎসব। এ সময় তারা পাঁচ দিন কাজ করতেন না। পূজা করতেন অগস্ত্য ঋষির। তাদের মতে, শঙ্খ অসুর নামে এক দানবকে অগস্ত্য হত্যা করেন। হত্যার জন্য যে করাত ব্যবহার হতো, সে করাত দিয়ে শাঁখারিরা শাঁখা কাটেন। শাঁখারীবাজারের বাইরে কোনো শাঁখারি বাস করলে তাকে করা হতো সমাজচ্যুত। সে কারণে হয়তো একই জায়গায় যুগ যুগ ধরে বাস করছেন। ওয়াইজের মতে, শাঁখারিরা নোংরাভাবে বাস করতেন। ফলে প্রায়ই মহামারী দেখা দিত। শাঁখারি মহিলারা ছিলেন পর্দানসীন। এরা খুব অপমানিত বোধ করতেন। শাঁখারীবাজারে এখনও শাঁখারি রয়েছে। যদিও সংখ্যায় কম। এ এলাকাটি খুবই ঘিঞ্জি। দালানগুলো অতি পুরনো। এখানে অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের বসতি। পুরনো ভবনের ফাঁকে ফাঁকে গড়ে উঠেছে নতুন ভবন। এখানকার রাস্তা সরু। বড় বড় যানবাহন চলতে পারে না। শাঁখারীবাজার এখনও ধরে রেখেছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য।
0 comments:
Post a Comment