Saturday, August 7, 2010

মনসা মঙ্গলে বাংলার ভাবের হদিস

2 comments
বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মনসা-মঙ্গল কাব্যের নানা আনুষ্ঠানিকতা প্রচলিত আছে। এগুলো বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোক নাটকের সম্পদ। এদের আছে আলাদা পরিবেশন রীতি, আলাদা আঙ্গিক। যাতে গ্রামীণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা আর জীবনের ভাবচিন্তা পরিস্কার বুঝা যায়। এই আয়োজন তাদের বেঁচে থাকার। এতে নিস্ফল তত্ত্ব আর বাহাস করার কোন সুযোগ বা প্রবণতা নাই।
বিভিন্ন অঞ্চলে মনসা-মঙ্গল
মনসা-মঙ্গল কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অনন্য কীর্তি। হরিদাস, বিজয়গুপ্ত, নারায়ণ দাস, কেতকা দাস ও ক্ষেমানন্দ প্রমুখ মনসা-মঙ্গল রচনা করেছেন। সাধারণত রাত জেগে মনসা-মঙ্গলের নাটক পরিবেশন করা হয়। রংপুর অঞ্চলে বিষহরির গান, রাজশাহী-নাটোর অঞ্চলে পদ্মাপুরাণ গান, কুষ্টিয়ায় পদ্মার নাচন, টাঙ্গাইল জেলায় বেহুলার নাচাড়ি, দিনাজপুর অঞ্চলে কান্দনী বিষহরির গান, সুনামগঞ্জ অঞ্চলে মনসার টপযাত্রা, বরিশাল অঞ্চলের রয়ানী গান উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে এটি মনসার ভাসান নামে পরিবেশিত হয়।
পরিবেশনার রীতি, বিশ্বাস, কারণ ও ভাবের আড়াল
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা আঙ্গিকে ভাসানযাত্রার পরিবেশনা রীতি চালু আছে। সাধারণত শ্রাবণ সংক্রান্তিতে এই নাটকগুলা হয়। মনসা-মঙ্গলের এই পরিবেশনার পেছনেও রয়েছে নানারকম কারণ। যেমন মানত, ইচ্ছাপূরণ, বিনোদন ইত্যাদি। এছাড়া মানত পূরণে বছরের যেকোন সময়ই এর আয়োজন করা যায়। সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস চলে আসছে- মনসাদেবীর গান বা পূজা করলে তিনি বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেন। তবে এই পরিবেশনার জন্য আলাদা আলাদা দল আছে। তারা নিজ নিজ অঞ্চলে বিশেষ সম্মানের অধিকারী। আবার কিছু কিছু পরিবেশনকারী দল কোন সম্মানী নেন না।
মনসা-মঙ্গল কাব্য সর্পদেবী মনসাকে নিয়ে লেখা। সে সময়ে মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিরা বৈষ্ণব পদাবলী লিখতেন। বৈষ্ণব পদাবলীতে দুনিয়ার সাথে ভাবের আড়াল আছে। কিন্তু গ্রামীণ আশাআকাঙ্ক্ষা নিয়ে লেখা মনসা-মঙ্গল কাব্যে সে আড়াল নাই। এটা একদম সাধারণ মানুষ আর মাটির গন্ধ মাখা।
মনসা-মঙ্গলের কাহিনী
মনসা-মঙ্গল লোকচেতনার ভেতর ধারণ করেছে পৌরাণিক চরিত্রসমূহ। এর কাহিনীতে দুটি ভাগ দেখা যায়। দেবলীলা এবং নরলীলা। কাহিনীর প্রধান চরিত্র হল- চাঁদ সওদাগর, বেহুলা ও লখিন্দর।
পার্বতী ছাড়া কারো প্রতি শিবের কাম হয় না। প্রেমে মগ্ন শিব একদিন পার্বতীর কথা চিন্তা করে কাম চেতনায় বীর্য বের করে দেন। সেই বীর্য পদ্ম পাতার ওপরে রাখেন। বীর্য পদ্মের নাল বেয়ে পাতালে চলে যায়। সেখানে সেই বীর্য থেকেই মনসার জন্ম। বাসুকীর কাছে বড় হয় মনসা। বাসুকী তার কাছে গচ্ছিত শিবের ১৪ তোলা বিষ মনসাকে দেন। যুবতী মনসা পিতার কাছে ফিরে এসে তার পরিচয় দেয়। আবদার করে কৈলাসে বাপের বাড়ি যাবার। শিব তার স্ত্রী পার্বতীর ভয়ে কন্যাকে নিতে চান না। পরে মন্দিরে ফুলের ডালিতে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু পার্বতী মনসাকে দেখে ফেলে। মনসাকে সতীন মনে করে এক চোখ অন্ধ করে দেয়। মনসা পার্বতীকে দংশন করে, শিবের অনুরোধে পার্বতীকে আবার জীবিত করে তোলে। পার্বতীর রোষে মনসাকে বনবাসে দেয়া হয়। এরমধ্যে ব্রহ্মর বীর্য ধারণ করে মনসা উনকোটি নাগ জন্ম দেন। এরপর মনসা সর্পদেবী আকারে হাজির হন। বনবাস থেকে ফিরে মনসা নিজের পূজা প্রচলনের আবদার প্রকাশ করে পিতার কাছে। শিব বলেন, যদি চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা দিতে রাজী হয়, তবে দুনিয়ায় মনসার পূজার প্রচলন হবে।
শিব ভক্ত চাঁদ সওদাগর তুচ্ছ নারীকে পূজা দিতে রাজী হন না। উল্টা মনসাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করে। যেকারণে মনসার রোষে চাঁদের চম্পকনগরে সাপের উপদ্রুব শুরু হয়। একে একে চাঁদের ছয় সন্তান মারা যায়। বাণিজ্যের নৌকা ডুবে গেলে চাঁদ সব হারিয়ে সর্বশান্ত হয়। তারপরও মনসার পূজাতে রাজী হয় না সে। অন্যদিকে চাঁদের বউ সনকা মনসার ভক্ত। মনসার বরে সে এক পুত্র জন্ম দেয়। নাম লখিন্দর। যদি চাঁদ মনসার পূজা না দেয় তবে লখিন্দর বাসর ঘরে সাপের কামড়ে মারা যাবে। এসব জেনেও চাঁদ লখিন্দরের সাথে উজানীনগরে বেহুলার বিয়ে ঠিক করে। চাঁদ তাদের জন্য লোহার বাসর ঘর তৈরি করে। তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। কাল নাগ লখিন্দরকে কামড় দেয়। লখিন্দরের মৃতদেহ কলার ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বেহুলা স্বামীর সঙ্গী হয়। এরমধ্য দিয়ে নানা ঘাটে নানা ঘটনা ঘটে। বেহুলা জানতে পারে স্বর্গের দেবতাদের নাচ দেখিয়ে খুশি করতে পারলে এর একটা বিহিত হতে পারে। অবশেষে বেহুলা দেবপুরীতে পৌঁছে। নাচ দেখিয়ে স্বর্গের দেবতাদের খুশি করে। দেবতাদের অনুরোধে মনসা লখিন্দরসহ চাঁদের অন্য সন্তানদের জীবন ও ডুবে যাওয়া ধনরত্ম ফিরিয়ে দেয়। বেহুলা সবকিছু নিয়ে বাড়ি ফেরে। বেহুলা মনসাকে কথা দেয় চাঁদ সওদাগরকে পূজা দিতে রাজী করাবে। চাঁদ সওদাগর সবকিছু দেখে খুশি হন, কিন্তু পূজার কথা শুনে বেঁকে বসে। শেষ পর্যন্ত বেহুলার অনুরোধে চাঁদ সওদাগর রাজী হয়। মনসাকে পেছনে রেখে বাম হাতে ফুল ছুঁড়ে দেয়। মনসা তারপরও খুশি হয়। এরপর থেকে দুনিয়াতে মনসার পূজা চালু হল।
এই হল মনসা-মঙ্গল কাব্যের কাহিনীর সার। এরমধ্যে নানা কবির লেখনীতে কিছু কিছু পার্থক্য আছে। তবে মূল কাহিনীর খুবই কম জায়গাতেই এই ফারাক। মনসার ভাসান যাত্রা বা এই ধরনের লোক নাটকে এখন প্রাধান্য বিস্তার করে আছে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী।
ব্রতকথা, পাঁচালী, মনসা-মঙ্গল কাব্য ও ভাসানযাত্রা
মনসা-মঙ্গলের কাহিনীর উৎস নিয়ে নানান কথা আছে। প্রাকৃতিক কারণে বাংলায় সবসময় সাপের উৎপাত বেশি। তাই সাপের প্রতি এক ধরনের ভয় মেশানো শ্রদ্ধা ছিল এখানে। আবার সাংস্কৃতিক কারণে বিভিন্ন ধরনের লোকজ দেব-দেবীর কাহিনী এখানে প্রচলিত ছিল। এখানকার কৃষিজীবন এসব কাহিনী দ্বারা প্রভাবিত। এছাড়া ব্রত-কাহিনী, পাঁচালীতেও এর হদিস আছে।
ব্রত-কথা বাংলার নারীদের নিজস্ব সম্পদ। ধর্ম, গৃহ জীবনের সুখ-শান্তি ও শিল্পের সংমিশ্রণে প্রচলিত ছিল নারীদের মাঝে। এরসাথে ব্রতাচার যুক্ত। ব্রতাচার ছাড়া ব্রতকথার আলাদা কোন মূল্য নাই। এগুলো ধর্মীয় আচরণের সাথে যুক্ত। যা মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। যেমন-অষ্টনাগের কাহিনী। কারো কারো মতে, মনসার ব্রতকথাটি মনসা-মঙ্গল কাব্যের চেয়ে আদিম। পাঁচালীর কাহিনী ও বক্তব্যের মধ্যে মোটামুটি সঙ্গতি আছে। পরবর্তীতে পরিমার্জিত আকারে বিভিন্ন কবির কাব্যে উঠে আসে এটি। কিন্তু মূল চরিত্র ও প্রয়োজন--অনার্য গ্রামীণ সংস্কার, লোকাচার এবং জীবনবাদ--একই থাকে। তবে ব্রতকথার যে ধর্মীয় তাৎপর্য সেটা ভাসানযাত্রার মত লোক নাটকে দুরস্ত থাকে না। একই কথা মনসা-মঙ্গল কাব্যের ক্ষেত্রেও সহী। কিন্তু এইকথা মনে রাখা জরুরি যে, মনসা-মঙ্গল কাব্য আর হিন্দু পুরাণ একই ধরনের বিষয় না। একইভাবে ভাসান যাত্রা আর পুরাণ নাটক এক জিনিস না।
অনার্য লোকায়ত দেব-দেবী
প্রাচীন ভারতবর্ষে বাংলার সংস্কৃতি ও লোকধর্মে আর্য ছাপ পড়ে অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক পরে। পরবর্তীতে আর্যরা এখানে উৎপাত করলেও অনেক অনার্য সংস্কার আর্য সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেয়। আর্য উপাদানের মিশেল থাকলেও মনসার বাপ কোন অর্থেই আর্য শিব না। অর্থাৎ, এর মৌলিকতা হারিয়ে যায় নাই। অনার্য দেবতা আর্য সমাজে নানা ইশারাকে ধারণ করেই গৃহীত হয়। একই কথা মনসার ক্ষেত্রেও সত্য। শিব-মনসার কাহিনীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, নাথ এবং এখানকার লৌকিক ধর্মের নানা উপাদান পাওয়া যায়। যেমন- বৌদ্ধ জাঙ্গুলী দেবী। কোন কোন মতে স্বরস্বতী আর মনসা এক সময় একই ছিল। আর্য অনার্য ভেদ করে বাংলার শিবকে খুঁজে পাওয়া কঠিন না। শিবের চরিত্র বর্ণনা খেয়াল করলে সেটা সহজে বুঝা যায়। দেখা যায়, এইখানকার কৃষকদের নিজস্ব আচরণে শিব একাকার। শিব কৃষিকাজ করে, অলস, আফিম-ভাং খায়। তার কামচেতনা লৌকিক। কোন অর্থেই সেটা দেবসুলভ না। বাংলার পুরুষ চরিত্র শিবে স্পষ্ট হাজির। এর মধ্য দিয়েই কৃষিকাজ দেববৃত্তি বলে কায়েম হয়। এখানে স্ত্রীর মধ্যে মায়ের রূপ খোঁজা হয়। শিব স্ত্রৈণ। পিতৃতান্ত্রিকতার বাইরে না। মনসার চরিত্র কোনোভাবেই দেবীসুলভ না। অমার্জিত, রুক্ষ। ভক্তের পূজার কাঙ্গাল। একটু ভক্তিতে সব অবহেলা, লাঞ্ছনা ভুলে যায়।এই দিক থেকে যতই আর্য মিশেল থাক না কেন শিব অনার্য পুরুষ, অন্যদিকে মনসা অনার্য নারী।
নারীর ঘরের কাহিনী
মনসামঙ্গলের কাহিনী মূলত, দুই নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার কাহিনী। মনসা আর বেহুলা। যেখানে বাংলার নারীদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, তারা আজন্ম নিগৃহীত। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে প্রায় হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে মনসার কাহিনী। যা নিখাদ নারীর অনিশ্চিয়তা থেকে নিশ্চিত গন্তব্যের কথা বলে। আগেই বলা হয়েছে, বাংলার নারীদের ভেতর নানা ব্রত কথা প্রচলিত আছে। সেই ব্রত-কথাতে মনসা ছিল। মনসা-মঙ্গলের কাহিনী নানা আঙ্গিকে নানা রীতিতে পরিবেশন করা হয়। কোন কোন রীতিতে বিধবা নারীরাই এটি পরিবেশন করেন। কিন্তু মনসামঙ্গলের প্রাচীন যুগ থেকে সমকালের চর্চায় পুরুষরাই নেতৃত্ব দিয়েছে।
পিতা শিবের মত মনসায় কোন ধরনের আর্য ছাপ নাই। সে অনার্য সর্প দেবী। উনকোটি নাগের মা। লোভ হিংসার বশীভূত। মনসার জন্ম কোন নারীর গর্ভে না। শিবের বীর্য পদ্ম পাতায় রাখলে, সেখান থেকে তা পদ্ম নাল বেয়ে পাতালে নেমে যায়; সেখান থেকেই মনসার জন্ম। তাহলে মনসার জন্ম পার্বতী থেকে হয় নাই কথার মানে, মনসার জন্ম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না। সেকারণে তার চাই সন্তানের দাবি প্রতিষ্ঠা। এই দাবিতে সে অনড়। একই সাথে চাই মানব সমাজে দেবীরূপে নিজের অধিষ্ঠান। আবার দেখা যাচ্ছে মনসার জন্ম যেহেতু পার্বতী থেকে হয় নাই ফলে এখানে তর্ক হল বাপের সাথে মেয়ের। সন্তান হিশাবে স্বীকৃতির দাবি, আবার পূজা চাওয়া এক অর্থে পিতা-কন্যার দ্বন্দ্ব। আসলে মনসার চাওয়ার ভেতর দিয়েই নারীর চাওয়া স্পষ্ট। নারী অধিকার চায়। সে অর্থে মনসার চাওয়াটা হল নারীর কর্তাসত্তাকে সমাজ চেতনায় স্পষ্ট করে তোলা।
অপরদিকে মানুষ বেহুলা তার বাসর রাত থেকে শুরু করে স্বামীর সেবাসঙ্গী হয়। স্বামী আরামে ঘুমিয়ে পড়ে। বেহুলা পাহারা দেয়। আবার মৃত স্বামীকে নিয়া দেবপুরীতে যায়। দেবতাদের নাচ দেখায়। নাচ এখানে প্রতীকি বিষয়। যেটা একটা প্রক্রিয়া বা তৎপরতা। সেটা মানবজীবনের মূর্ত বয়ান। সংগ্রাম, ত্যাগ আর পরিশ্রমের। যার মধ্য দিয়ে সে নিজের জীবন সঙ্গী স্বামীকে উদ্ধার করে। তাকে আবার বাঁচিয়ে তোলে। এর ভেতর দিয়ে জীবনের ছাপ, কর্মের ছাপ পরিস্কার। নারীই সাজিয়ে দিচ্ছে জীবনকে। নারী তার নারীত্বের প্রকৃতি, দাবি ও কর্তাসত্তার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করে।
মনসার জন্ম রহস্য আর অখণ্ড নারী-পুরুষের ধারণা
আগেই বলা হয়েছে মনসার জন্ম কোন নারীর গর্ভে না। সন্তানের দাবি প্রতিষ্ঠার যে লড়াই তার বাইরে এই জন্মের আলাদা তাৎপর্য আছে। একে চিন্তার দিক হতে নানানভাবে হাজির করা যায়। সন্তানের মধ্যে মা-বাপ দুইয়ের অংশ থাকে। আর মনসায় পুরাটাই বাপ। তার মানে কি। মনসার ভেতর বাইরে শিব ছাড়া অন্য কথা নাই। এখানে শিব নারী হয়ে উঠল। শিব একই সাথে প্রকৃতি আবার পুরুষও বটে। সেই অর্থে মনসার জন্মের ভেতর দিয়া মানব জন্মেও পুরাটাই উপলব্ধ হয়। তাই মনসার লড়াই এই অর্থে শিবের নিজেরও লড়াই বটে। এখানে বাংলার ভাবে নারী-পুরুষের অখণ্ডতার ধারণা অসাধারণভাবে হাজির। নারী-পুরুষের আলাদা ধারণার ভেতর দিয়েও কি চমৎকার তারা আবার এক হয়ে আছে। আবার একই সাথে মনসাকে পূজা দেয়া মানে শিবকে পূজা দেয়া।
মানুষের কথা
মনসা-মঙ্গলে হিন্দু ধর্মীয় উপাদান যুক্ত আছে। এগুলো আর্য প্রভাবে যোগ হয়েছে। একে কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের আচার বলা যায় না। এটি এখানকার মানুষের আপনার সম্পদ। একই সাথে কৃত্য, সাধনা, দর্শন ও ভয়ের দুনিয়াকে জয় করার হাতিয়ার। তাই স্বর্গ আর দুনিয়ার ফারাক করার চেয়ে মানুষের অস্তিত্বকে নানান আয়োজনে জারি রাখাই এখানকার আসল কথা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মনসার গানে উল্লখযোগ্য পরিবেশনকারী দল মুসলমান সম্প্রদায় হতে আসা। এগুলো তাদের পারিবারিক কৃত্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর সাথে যুক্ত। অসাম্প্রদায়িকতা বলে বাইরের যে সংস্কৃতি এখানে চাপিয়ে দেয়া হয়, সেখানে দেখা যায় বাংলার ঐতিহ্যিক এবং সহজাত ঘরানায় এর চেয়ে ভালো চর্চার উদাহরণ আছে। মানুষের মিলেমিশে থাকার ইতিহাস চেতনা অনেক পুরানা। অন্ত্যজ মানুষের একই ইতিহাস। তাদের শ্রেণী অভিরুচি একই। কিন্তু পাশাপাশি তাদের সমাজ জীবনের নানা ধরনের সংকটও স্পষ্ট। নানা সংস্কৃতির নিপীড়ন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক হয়ে ওঠা, নিজেকে জাহির করা, এবং সেখানে নারীর বাসনা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়।
মনসা-মঙ্গলের লোকনাটকের নানান আঙ্গিকের পরিবেশনায় দেখা যায়, বর্তমানকালে এসে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী প্রাধান্য লাভ করেছে। এরমধ্যে দেবীর কথা আছে, দেবী বন্দনা আছে। কিন্তু সেই কাহিনী শেষ পর্যন্ত মর্ত্যরে মানুষের সুখ-দুঃখ আর বৈরীতার কাহিনী। এমনকি শিব-মনসার চরিত্রে মানুষের কথাই আসে। পিতা আর কন্যার লড়াই আসলে মানুষেরই লড়াই। দেবতা উপলক্ষ্য মাত্র কিংবা ইতিহাসেরই প্রতীকি তাৎপর্যময়তা। মানুষের বেঁচে থাকা, টিকে থাকার সংগ্রাম এই কাহিনীর আসল কথা।
জ্যান্তে-মরা
মনসার কাহিনীর টানটান একটি অংশ হল লখিন্দরকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া। অনিশ্চিত যাত্রা। যেখান থেকে এসেছে ভাসান। ভাসান আসলে কি? এই ভাসানের যাত্রী কে? লখিন্দর রূপী মানুষ। সে না জীবিত, না মরা। ভাসান মানে ভাসমান থাকা। যা ডোবেও না আবার ঘাটেও উঠে না। ভেসে থাকে। এই হল ভাসান। এখান থেকেই এর আসল মানে দাঁড়াল--জ্যান্তে মরা। বাঁচাও না মরাও না। জীবন মৃত্যুর মধ্যিখান। কিন্তু শেষমেশ এর মানে হল, কোনো মৃত্যু নাই। কারণ এরমানে বুঝা যাবে সেই কাহিনীতে। যাতে তার সাথে সহযাত্রী ছিল বেহুলা। লখিন্দর যে অর্থে মৃত, বেহুলা সে অর্থে জ্যান্ত। লখিন্দরের দুনিয়াবী চৈতন্য নাই, বেহুলার আছে। এরমধ্যে সে দেবলোকে পৌঁছে। স্বর্গের দেবতাদের নাচ দেখিয়ে মুগ্ধ করলেন। স্বর্গ হল পরলোক। সেখানে জীবিত মানুষ যেতে পারে না। যে যেতে পারে সে আর ফিরতে পারে না। তাহলে, বেহুলা কেমনে সেই দুই দুনিয়া হাসিল করল। এখানেই জীবন-মৃত্যু সংক্রান্ত বাংলার ভাব। বাংলার ভাবদর্শনের দিকে তাকালে আমরা জানতে পারি তা সম্ভব। বাংলার ভাব সাধনায় জ্যান্তে মরার কথা বার বার এসেছে। এখানকার নাথ, তান্ত্রিক সহ নানা সহজিয়া ঘরানায় এই ধারণা পরিচিত। যে জ্যান্তে মরে সে দুনিয়াটারে স্বরুপে চেনে। এটা আত্মকে সচেতন করে। তার সাথে দুনিয়াবী রাজনৈতিক, সমাজদর্শন আর ভাব জগতের মিল ঘটে। যে জ্যান্তে-মরা সে বুঝে দুনিয়ার আসল ভাব পরিচয়।
উত্সঃ চিন্তা




2 comments:

Post a Comment