ঢাকা ক্লাবের জš§কথা
ইতিহাস পাতা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা হয়ে যায় এই বাংলা ও আসামের রাজধানী। তখন ঢাকায় ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়তে থাকে। সেই সাথে এখানে দেশি-বিদেশি বণিকদের পদচারণাও বাড়তে থাকে। ঢাকার শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারী ও নাগরিকদের জন্য সামাজিকতা ও অবসর বিনোদনের কেন্দ্রীয় কোনো জায়গা তখনও গড়ে ওঠেনি। এক রকম বাধ্য হয়ে ইংরেজরা একটি ক্লাব গঠনের প্রয়োজন অনুভব করতে থাকে। এই ক্লাব গঠনের সাথে অবশ্য ঘোড়দৌড়ের বিষয়টিও জড়িত। ঘোড়া ছিল সাহেবদের অন্যতম সহচর, ভালোবাসা। এ কারণেই উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জিমখানা ক্লাবের উৎপত্তি। সেই সময়ে ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতার আয়োজন করত জিমখানা ক্লাবগুলো। সব মিলিয়ে সেই সময়ে ইংরেজদের ভীষণভাবে প্রয়োজন দেখা দেয় একটি ক্লাব গঠনের। বাংলা বিভক্তির ছয় বছর পর, ১৯১১ সালে অবশেষে স্থাপিত হয় ঢাকা ক্লাব। ১৯১১ সালের ১৯ আগস্ট প্রতিষ্ঠা হলেও ক্লাবের আইনগত ভিত্তি স্থাপিত হয় আরো পরে, ১৪ সেপ্টেম্বর। পূর্ব বাংলা এবং আসামের যৌথ পুঁজি বিনিয়োগকারী কোম্পানিসমূহের নিবন্ধক কর্তৃক ভারতীয় কোম্পানি আইন ১৮৮২ অনুযায়ী ক্লাবটিকে আইনগত মর্যাদা প্রদান করা হয়। ঢাকা ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ছয় জন। তারা হলেন"লে. কর্নেল ই.এ.ডাব্লিউ. হল (সিভিল সার্জন, ঢাকা এবং সুপারিনটেনডেন্ট, মিডফোর্ড হাসপাতাল), সি.আর ডাব্লিউ, ব্রায়ান (নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী), এইচ. জি. বেলি (কমান্ডেন্ট মিলিটারি পুলিশ ব্যাটালিয়ন, ঢাকা), জে. ও রেনি (নির্বাহী কর্মকর্তা, পিওডাব্লিউওডি, ঢাকা) এবং এ.টি. হ্যালিডে (ভারতীয় পুলিশ, ঢাকা)। এদের মধ্যে ই.এ. হল ছিলেন ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে উদ্যোগী ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের সবাই ছিলেন ব্রিটিশ"কেউ রাজকর্মচারী, কেউ ব্যবসায়ী। শুরুতে ঢাকার নবাবই ক্লাব স্থাপনের জমি দেন। কিছু রেকর্ড প্রমাণ করে ঢাকা ক্লাবের বর্তমান জমি পাওয়া গিয়েছিল ঢাকার নবাবদের কাছ থেকে ১৯৪৩ সালে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ অনুসারে, ১৯৪১ সালে রমনা এলাকার যেটুকু নবাবদের কাছে ছিল সরকার তা তাদের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিলেন এবং তারপর ঢাকা ক্লাবকে ইজারা দিয়েছিলেন রমনার ৫২৪ বিঘা। এর মধ্যে রেসকোর্স ছিল ২৯০ বিঘা, গলফ কোর্স ২১৯ বিঘা এবং বাকি ১৫ বিঘা ছিল ক্লাব ভবন ও চত্বর। বর্তমানের শেরাটন হোটেল, বারডেম হাসপাতাল, বেতার ভবন ঢাকা ক্লাবের সেই জায়গার ওপরই গড়ে উঠেছে।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকা ক্লাব
জš§লগ্ন থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ক্লাব পরিচালিত হয়েছে ব্রিটিশদের দ্বারা, ইউরোপিয়ানদের জন্য। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর চিত্র পাল্টে যায়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা ক্লাব পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। তবে পূর্ব পাকিস্তানিদের হাতে নয়। ক্লাবের অবস্থান ঢাকাতে হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব থাকে ঢাকার বাইরের মানুষদের হাতে। পরেও অনেক ইউরোপিয়ান সদস্য ছিলেন ঢাকা ক্লাবে। তবে দেশ বিভাগের পর অনেকেই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করতে থাকেন। ফলে বিদেশিদের সংখ্যা কমতে থাকে। ওই জায়গাটি পূরণ হয় পশ্চিম পাকিস্তানি লোকজন দিয়ে। বিশেষ করে করাচি থেকে আসা উচ্চপদীয় কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা। ১৯৭১-এর আগ পর্যন্ত ঢাকা ক্লাবে বাঙালির হার ছিল শতকরা ২০ জন। পূর্ব পাকিস্তানের ওই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসক মুহম্মদ আজিজ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন, গভর্নর স্যার ক্যামারস বর্ন ঢাকা ক্লাবে আসতেন। বিশেষ করে গভর্নর বর্ন ও ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক শাহাবুদ্দিন টেনিস খেলতে ঢাকা ক্লাবে আসতেন। আরো আসতেন বিচারক থমাস অরমন্ড ও আমিন আহমেদ চৌধুরী।
স্বাধীনতার পর ঢাকা ক্লাব
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা ক্লাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে বাঙালিয়ানা, তবে তা হঠাৎ করে নয়। সত্যি বলতে, অভিজাতদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি দেশ স্বাধীনের পরও বহুদিন লালন করে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি। সময়ের সাথে তাল মেলাতে পরবর্তীতে এই ক্লাবে যোগ হয় পহেলা বৈশাখ, নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তীসহ জাতীয় অনুষ্ঠান উদযাপন। দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা ক্লাবের অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। ক্লাবের আয়ত্তে থাকা ঘোড়দৌড়ের মাঠটি রূপান্তরিত হয় সোহরাওায়ার্দী উদ্যানে। বিচারক আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯৪৭ সালে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তিনি দেখা করে গলফ কোর্সটির সুরক্ষা ও ব্যবহারের জন্য ঢাকা ক্লাবের হয়ে অনুমতি চান। বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার আমিন আহমেদ চৌধুরীর অনুরোধ রেখেছিলেন। তবে গলফ কোর্সটিতে এখন ঢাকা ক্লাবের সদস্য ছাড়া অন্যরাও খেলেন। ঢাকা ক্লাবের ৫২৪ বিঘা জমি থেকে কমতে কমতে (সোহওয়ার্দী উদ্যান, ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন, বেতার ভবনকে জমি ছাড়ার কারণে) ঢাকা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৫ একর জমি। এ জায়গাটুকুতে সভাকক্ষ, সেমিনার কক্ষ, হল ঘর, অতিথি কক্ষ, রান্নাঘর ও খাবার ঘর এবং টেবিল টেনিস, বিলিয়ার্ড, স্কোয়াশ, সাঁতার, লন টেনিস ইত্যাদি খেলার সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। ঢাকা ক্লাবের সবচেয়ে পরিবর্তন লক্ষ করা যায় সাম্প্রতিক সময়ে। ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে ক্লাবের সাংগঠনিক বিন্যাস অপরিবর্তিত রয়েছে এখনো। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন- আগে সদস্যদের ছেলে-মেয়েরা সদস্য হতে পারতেন না, কিন্তু এখন হতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ে নেয়া হয়েছে প্রগতিশীল, সৃষ্টিশীল, পেশাজীবী যেমন, সাংবাদিক, শিক্ষক, সাহিত্যিকদের সদস্য করার ক্ষেত্রে নমনীয় পদক্ষেপ। যার কারণে এসব পেশাজীবী অনেক ব্যক্তিই ঢাকা ক্লাবের সদস্য হতে পারেন। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠান পালন করছে ঢাকা ক্লাব। পয়লা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তী প্রভৃতি বাংলাদেশি সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে এই ক্লাবে।
ঢাকা ক্লাবের অভ্যন্তরে
ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক্লাবে সদস্যদের জন্য রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। ক্লাবের সদস্যসহ পরিবারের সদস্যদের আর অতিথিদের জন্য রয়েছে বহুমাত্রিক আয়োজন। অত্যন্ত উন্নতমানের রেস্টুরেন্ট রয়েছে ক্লাব অভ্যন্তরে। অভিজ্ঞ দেশি-বিদেশি শেফ দ্বারা তৈরি করা হয় নানা ধরনের কাবাবসহ মাংসের উপাদেয় নানা আইটেম। রয়েছে ফিশকারির বর্ণাঢ্য আয়োজন। দেশি খাবার ছাড়াও চায়নিজ, থাই, ইতালিয়ান, ইন্ডিয়ানসহ সাবকন্টিনেন্টালের উপাদেয় খাবার পরিবেশন করা হয় ক্লাব সদস্য, তাদের পরিবার ও অতিথিদেরকে। ঢাকা ক্লাবের বিভিন্ন ফুড আইটেমের রান্নার খ্যাতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছেছে বহির্বিশ্ব অবধি। এখানকার স্মোকড হিলশা বিখ্যাত ও অত্যন্ত সুস্বাদু। এর খ্যাতি এতটাই যে, সিঙ্গাপুরের ট্যাংলিন ক্লাব রেসিপি নিয়েছে এখান থেকে। এর পাশাপাশি ঢাকা ক্লাবের কাচ্চি বিরিয়ানির রেসিপিও নিয়েছে তারা। ক্লাবের অভ্যন্তরে ১৯ রুমের একটি রেস্ট হাউস রয়েছে। একটি প্রেসিডেনশিয়াল শুইটসসহ মোট ১৮টি ডবল বেড রুম রয়েছে এখানে। ঢাকা ক্লাবের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ হেলথ ক্লাব। ক্লাব সদস্যরা এখানে নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। এছাড়াও রয়েছে সুইমিংপুল, টেনিস কোর্ট, স্কোয়াশা ক্লাব, স্নুকার ক্লাব, গলফ ক্লাব এবং বিলিয়ার্ড ক্লাব। ক্লাবের সদস্যদের পরিবারের জন্য রয়েছে গানের স্কুল, নাচের স্কুল, ছবি আঁকার স্কুল, সাঁতার শেখার ব্যবস্থা। এই ক্লাবে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। যেখানে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বই। বইয়ের সংখ্যা ১০ হাজার। তদুপরি হেরাল্ড ট্রিবিউন থেকে শুরু করে বিদেশি বহু পত্র-পত্রিকা এবং দেশের প্রধান প্রধান বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকসহ উল্লেখযোগ্য সাময়িকী রয়েছে লাইব্রেরিতে। ক্লাব সদস্যদের বাড়িতে বই নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। ২০০৯ সালের নভেম্বরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে এ ক্লাবে ‘বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ’ যাত্রা শুরু করে। দেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা পেইন্টিং নিয়ে সুসজ্জিত লাউঞ্জটি। ক্লাব সদস্যদের পার্টির জন্য প্রাইভেট লাউঞ্জ হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি ঐতিহ্যবাহী রান্নার নানা আইটেম নিয়ে শওকত ওসমান রচিত ‘রেসিপি ফ্রম দ্য রাজ’ এবং ঢাকা ক্লাবের ইতিকথা নিয়ে ওয়াকার এ খান রচিত ‘ঢাকা ক্লাব ক্রনিকল’ বই দুটি প্রকাশ করেছে এই অভিজাত ক্লাবটি।
৯৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন
পবিত্র রমজানের কথা বিবেচনা করে ঢাকা ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান এবার এগিয়ে আনা হয়েছে। গত (২০১০) পহেলা আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে ক্লাবের ৯৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর নানা আয়োজন। নয়দিনব্যাপী এই আয়োজনের মধ্যে রয়েছে আজীবন সম্মাননা প্রদান, স্কোয়াশ, বিলিয়ার্ড, গলফ, টেনিসসহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, দেশি-বিদেশি শিল্পীদের পরিবেশনায় সংগীতানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গত দুই বছরের মতো এবারও গুণীজন সংবর্ধনার আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠান। জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ক্লাবের একজন সদস্যকে এই সম্মাননা দেয়া হয়। এবার সম্মাননা পেলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উপ-প্রধান ও বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার, বীর উত্তম, পিএসএ। গত ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় ক্লাব লাউঞ্জে ‘অঞ্জলী লহ মোর’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। একই অনুষ্ঠানে ক্লাবের আরো ২৫ জন প্রবীণ সদস্যকে সমাজে তাদের বিশেষ অবদান এবং ক্লাবের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততার জন্য ক্লাবের ‘লিভিং লিজেন্ড’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন- জহির উদ্দিন আহমেদ, এমএ রউফ চৌধুরী, লতিফুর রহমান, শফকাত হামিদ, চৌধুরী মনোয়ার আহমেদ সিদ্দিকী, মো. আনিস উদ দৌলা, ড. মুহম্মদ জহির, ইমাম হোসেন খান, তারিক ইব্রাহীম, ড. জগলুর রহমান খান, তারিকুল আলম খান, শামসুল আবেদীন আকন্দ, ওবায়েদ আর জায়গীরদার, এসএ রেজা হোসেন, সিজে হায়দার, গোলাম আকবর চৌধুরী, মো. সিরাজুল ইসলাম, এস ই কবির, মো. ইফতেখারুল আলম, এমএম ইস্পাহানি, আতাউদ্দিন খান এফসিএ, সদরুদ্দিন এইচ জোওয়া, এফএ গজনবী, সৈয়দ একে মাহমুদুল হক ও হাবিবুল্লাহ খান।
ঢাকা ক্লাব লিমিটেড-এর সচিব গ্রুপ ক্যাপ্টেন মুজাহিদুল ইসলাম এনডিইউ, পিএসসি (অব.) বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমরা সব সময়ই একটু জাঁকজমকভাবে উদযাপন করি। ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবের সদস্যরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন, এমন ব্যক্তিদেরও আমরা এই অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করি। এবারও ক্লাবের পক্ষ থেকে একজনকে আজীবন সম্মাননা ও ২৫ জনকে ক্লাবের ‘লিভিং লিজেন্ড’ সম্মাননা দেয়া হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শতবর্ষ উদযাপন করা হবে আরো জাঁকজমকপূর্ণভাবে। এ জন্য নানা আয়োজনের পরিকল্পনাও শিগগিরই নেয়া হবে।’ উল্লেখ্য, ৯৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার টাইটেল স্পন্সর ছিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবি)।
যুদ্ধজয়ী টেবিলের গল্প
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পুরো দেশ তখন বিজয়ের উৎসবে মত্ত। বিকেলে রমনার রেসকোর্সে সারেন্ডার করবেন তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী। রমনার রেসকোর্স তখনও ঢাকা ক্লাবের আয়ত্তে। হাজারো লোক উপস্থিত হয়েছেন পাকিস্তানি যুদ্ধবাজ নেতার নিচু মুখ দেখতে। সবকিছু প্রস্তুত, কেবল চেয়ার-টেবিলে অভাব। অন্তত দুটো চেয়ার এবং একটি টেবিল খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তাৎক্ষণিক দুটি চেয়ার ও একটি টেবিলের যোগান দেন ঢাকা ক্লাবেরই এক দেশপ্রেমিক স্টাফ। সহকর্মীর সহযোগিতায় দ্রুতগতিতে একটি কাঠের টেবিল ও দুটি কাঠের চেয়ার এনে দেন রেসকোর্সে। কে জানত, সেই সাধারণমানের কাঠের চেয়ার-টেবিলই একদিন হয়ে উঠবে অসাধারণ এক ইতিহাসের অংশ। ঢাকা ক্লাবের সেই চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করেই, চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানি সমরনেতা জেনারেল অরোরা। পরবর্তীতে চেয়ার দুটির খোঁজ না মিললেও ঐতিহাসিক সেই টেবিলটি বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
এক নজরে
অফিসিয়াল নাম: ঢাকা ক্লাব লিমিটেড
স্থাপিত: ১৯ আগস্ট ১৯১১
রেজিস্ট্রি: ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯১১
প্রেসিডেন্ট (যে পর্যন্ত রেকর্ড আছে): মি. ডাব্লিউ এইচ নেলসন, এফসিএস
প্রথম বাঙালি প্রেসিডেন্ট: বিচারক আমিন আহমেদ চৌধুরী (১৯৪৭)
স্বাধীনতার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট: মি. এমজি মূর্তজা
প্রথম মহিলা সদস্য: গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী
প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট: গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী
বর্তমান প্রেসিডেন্ট: সাদাত হোসেন সেলিম
বর্তমান সদস্য সংখ্যা: ২৬০০ জন
বর্তমান মহিলা সদস্য: ৮০ জন
‘ঢাকা ক্লাব আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল’
সাদাত হোসেন সেলিম। ঢাকা ক্লাবের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। পর পর তিনবার এই পদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ঢাকা ক্লাবের উন্নয়নে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বহু গুণের অধিকারী এই মানুষটির আরও কিছু পরিচয় আছে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, খ্যাতিমান আলোকচিত্রী, পাখি-প্রেমিক ও এই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ, লেখক এবং একজন শীর্ষ কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব। শতবর্ষের প্রাক্কালে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘ঢাকার ঐতিহ্য চারশ’ বছরের। এর সাথে ঢাকা ক্লাবের একশ’ বছরের ইতিহাসও জড়িত। আমরা শতবর্ষী অনেক প্রতিষ্ঠান দেখি, যাদের আর আগের কলেবর নেই। তবে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক্লাবের কলেবর বেড়ে জাতীয় পর্যায়ে স্বমহিমায় টিকে আছে। এক দৃষ্টিতে এটি একটি অভিজাত ক্লাব। আবার আরেক দৃষ্টিতে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্লাবকে জাতীয় চিন্তার সূতিকাগার বলা যায়। দেশের বরেণ্য সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিশিষ্টজনেরা এখানকার সদস্য। এখানে বসে তারা বৃহৎ স্বার্থের অনেক কিছুই চিন্তা করেন। অনেক সাহিত্যিক তার জনপ্রিয় গল্প বা উপন্যাস এখানে বসেই সৃষ্টি করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা ক্লাব খেলাধুলায় বিশেষ অবদান রেখেছে। যেমন- টেনিস, বিলিয়ার্ড, স্নুকার ও স্কোয়াশ খেলাকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আমরা শহীদদের স্মরণে ঢাকা ক্লাবের অভ্যন্তরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেছি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে ঢাকা ক্লাবের টেবিলে ওপর চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হয়েছিল।’ ক্লাব প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে এই ক্লাবের সদস্য করা সম্ভব নয়। তবে এটি যেন জনবিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান না হয় সে জন্য আমরা সমাজের সাথে আরও সম্পৃক্ত হতে চাই। বর্তমানে পয়লা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তীসহ প্রায় প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করে ঢাকা ক্লাব। ভবিষ্যতে লালন ও বাউল উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সাথে ২০০৮ সাল থেকে সীমিত পর্যায়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।’ ঢাকা ক্লাবের প্রাণপুরুষ সাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘ঢাকা ক্লাবের ইতিহাসের সাথে যেহেতু ঢাকার ইতিহাস জড়িত, তাই আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকার চারশ’ বছরের ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। বিশেষ করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§কে জানানোর চেষ্টা করব যে, তারা একটি ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো শহরের অধিবাসী।’
0 comments:
Post a Comment