১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউ-উদ-দৌলার ক্ষমতা হারানোর মধ্য দিয়ে ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতা দখল করে। ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সমাজ, সভ্যতা ধ্বংস শুরু হয়। মুসলমানদের এ চরম দুরবস্থার মধ্যেই ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু দুঃসাহসিক বাঙালি মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ১৭৮০ সালে ভারতীয় বড় লাট স্যার ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কলকাতায় একটি ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। ওয়ারেন হেস্টিংস তাদের প্রস্তাবে একমত হয়ে ১৭৮০ সালের অক্টোবরে কলকাতার বৈঠকখানা রোডে একশত টাকায় একটি বাড়ি ভাড়া করে আলিয়া মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু করেন। সেই থেকে পথ চলা শুরু আলিয়া মাদ্রাসার।
গোটা ভারত বর্ষে মুসলমানের জন্য মাত্র একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় দিন দিন এর ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকে। পরে পদ্মপুকুর লেনে ১৭৮১ সালে কিছু জমি কিনে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৭৮৫ সালে মাদ্রাসাটি সরকারিকরণ করা হয়। পদ্মপুকুর লেনটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। ফলে মাঝে মধ্যেই উগ্র হিন্দুরা মাদ্রাসার বিভিন্ন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছিল। ১৮২৭ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসাটি পদ্মপুকুর লেনে ছিল। ১৮২৭ সালের আগস্টে ওয়েলেসলি হাজী মুহসীন স্কোয়ারে একটি জায়গা কিনে পদ্মপুকুর থেকে মাদ্রাসা ভবন স্থানান্তর করা হয়। ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও ইংরেজরা অধ্যক্ষের পদটি হাত ছাড়া করেনি।
সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ১৭৮০ থেকে ২০১০ সাল নাগাদ শতাধিক জ্ঞানী-গুণী বিশ্বখ্যাত আলেম, পিএইচডি, স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ মাদ্রাসা আলিয়ার অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা থেকে পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক অধ্যক্ষের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে সরকারি শিক্ষা ক্যাডারের অভিজ্ঞ মুসলিম অধ্যাপকদের মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রদান শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত ভাগ হওয়ার পর আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। আলিয়া মাদ্রাসার যাবতীয় আসবাবপত্র, লাইব্রেরীর মূল্যবান কিতাব, বোর্ডের যাবতীয় রেকর্ডপত্র লক্ষ্মীবাজারের ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান কবি নজরুল ইসলাম কলেজ) ও ডাফরিন মুসলিম হোস্টেলে রাখা হয় এবং সেখানে মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসাটি লক্ষ্মীবাজারেই ছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত ভাগ হওয়ার শুরুতেই মাদ্রাসা আলিয়া কলকাতায় থাকবে না অন্য কোথাও যাবে এই নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। অধ্যক্ষ খান বাহাদুর মুহাম্মদ জিয়াউল হকের (এম.এ.) প্রচেষ্টায় আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে আসে।
খ্যাতিমান প্রিন্সিপালগণ: প্রথম প্রিন্সিপাল ব্রিটিশ নাগরিক ইস্টিনজার। সর্বশেষ ব্রিটিশ প্রিন্সিপাল মি. হারলি। প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল খান বাহাদুর মাওলানা কামাল উদ্দিন। এরপর খান বাহাদুর মাওলানা মুসা, খান বাহাদুর মাও. জিয়াউল হক, হাফেজ মাও. আব্দুল হাফিজ, মাও. আব্দুল লতিফ, মাও. ড. লুৎফুল হক, মাও. ইউনুস শিকদার, প্রফেসর মাও. মো. সালাহ্উদ্দিন ও ড. মাও. ইয়াকুব হোসাইন প্রমুখ।
স্বনামধন্য হেড মাওলানাগণ: মোল্লা মদন, মাও. সুফি সফিউল্লাহ, সামসুল ওলামা বেলায়েত হোসাইন, মাও. জাফর আহমেদ ওসমানী, সৈয়দ মুফতি আমিমুল ইহসান, মাও. ওবায়দুল হক ও আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরী (রহ.) প্রমুখ।
১৯৫৬ সালে তদানিন্তন শিক্ষামন্ত্রী আশরাফ আলী চৌধুরী ও অধ্যক্ষ মৌলভী মকবুল আহমদের একান্ত প্রচেষ্টায় লালবাগ থানার বখশী বাজার এলাকায় প্রায় ৫ একর জমির উপর সরকারিভাবে মাদ্রাসা আলিয়া স্থাপিত হয়। ১৯৬১ সাল থেকে ১-২নং বকশি বাজারে আলিয়া মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু হয়। ৭০ দশকে কামিল মাদ্রাসা হিসেবে মাদ্রাসায় হাদীস, তাফসীর, ফিক্হ ও আদব বিভাগ খোলা হয়। তবে আরো একটি বিভাগ আছে: সেটি ক্বিরাত বিভাগ। বিভাগগুলোতে বুখারী, মুসলিম, মু’য়াত্তা-ই-মালিক, তারিখে ফিক্হ, তারিখে ইসলামসহ ছিহাহছিত্তার সকল কিতাব পড়ানো হয়। ৭০ দশকেই মাদ্রাসায় দাখিল ও আলিম শ্রেণীতে বিজ্ঞান শাখা খোলা হয়।
আল্লামা কাশগরী (র.) নামে সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার ২৫০০ ছাত্রের জন্য একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। হল সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ৭৮টি রুমে ২৮৩ জন ছাত্র রয়েছে। ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করলে জানা যায়, ছাত্রাবাসে আবাসন সংকট রয়েছে।
দুষ্প্রাপ্য বইয়ের লাইব্রেরী
আলিয়া মাদ্রাসার লাইব্রেরীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ দু®প্রাপ্য মূল্যবান সাহিত্য, ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা, ইংরেজী, আরবী, ফার্সি, উর্দু প্রভৃতি ভাষায় রচিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপি এবং প্রায় ২০ হাজার বই রয়েছে। এর মধ্যে ফেরদৌসীর মুল শাহানামার পাণ্ডুলিপিও আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায়ই বিভিণœ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এখানে পড়াশুনার জন্য আসেন।
অধ্যক্ষ যা বলেন
মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এ, কে, এম ইয়াকুব হোসাইন বলেন, একাডেমিক ভবনটি জরাজীর্ণ। এটা পুনঃনির্মাণসহ ২০তলা ভবন করা প্রয়োজন। মাদ্রাসায় শিক্ষকদের ৬৪ পদের মধ্যে কিছু পদ শূন্য ছিল। আমি আসার পর ২৫ জন শিক্ষক জয়েন করেছেন। আরও কিছু পদ শূন্য রয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসায় আটটি বিষয়ে অনার্স খোলার জন্য কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটিতে আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা মাদ্রাসা পরিদর্শন করে গেছেন। আমি আশাবাদী শীগগিরই আলিয়া মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞ ক্যাটালগার এনে ক্যাটালগ এবং ক্লাসিফিকেশন করার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশসহ ৫ লক্ষ টাকার একটি প্রকল্প ইউনেস্কো অফিসে জমা দেয়া হয়েছে। লাইব্রেরীর বইগুলো অমূল্য সম্পদ। এগুলো রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। তাই আশা রাখি ৫ লক্ষ টাকার প্রকল্পটি খুব শীঘ্রই বাস্তবায়ন হবে।
গাজী আব্দুল হাদী
তথ্য সূত্র: আলিয়া মাদরাসার প্রকাশনা
রশ্মি-২০০৩/০৪, স্মরণী ২০০২/০৩
0 comments:
Post a Comment