Friday, August 13, 2010

শরণখোলা, বাগেরহাট

0 comments
প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের পর্যটন শিল্পের জন্য উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রচার ও সদিচ্ছার অভাব এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ের অভাবে অপার সম্ভাবনাময় এ খাতটি এখানে বিকশিত হতে পারছে না। তবে সাইনবোর্ড- শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণে জন্য সরকার ৪৮কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ায় শরণখোলা রেঞ্জের পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। দক্ষিণের সাগরতীরের সুন্দরবনের আয়তন ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে সুন্দরবনকে পৃথিবীর ৫২২তম ঐতিহ্য হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে বিশ্বের বুকে পরিচিতির তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন সুন্দরবনে পর্যটকদের নিয়ে কাজ করলেও তাদের শতেক সীমাবদ্ধতা। তার পরেও সরকার সুন্দরবনে পর্যটন খাতে প্রতিবছর মোটা অংকের রাজস্ব লাভ করেছে। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এ খাতের রাজস্ব বেড়ে যেতে পারে কয়েকগুণ। বিশেষ করে এ বণের শরণখোলা রেঞ্জের কিছু অভয়াশ্রম হয়ে উঠতে পারে এক আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ ।

সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির বৃক্ষ, ১৬৫ প্রজাতির সাগর শৈবাল, ১৩ প্রজাতির পরাশ্রয়ী আর্কিড রয়েছে। সুন্দরী এ বনের প্রধান বৃক্ষ। মোট বনাঞ্চলের ৭৩ ভাগ জুড়েই রয়েছে সুন্দরী। এছাড়া কেওড়া, বাইন, পশুর, ধুন্দল, কাঁকড়া, বাইন, কাকড়া, গরাণ, হেঁতাল ও গোলপাতা উল্লেখযোগ্য। ২৬৯ প্রজাতির বন্যপ্রানী, ১৮৬ প্রজাতির পাখি ও ২১০ প্রজাতির মাছ রয়েছে এই রেঞ্জের বনে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে, বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রল হরিণ, ভয়ঙ্কর কুমীর, বানর, শূকর ও গুঁইসাপ উল্লেখযোগ্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও সমুদ্রের বিশাল জলরাশির কারণে সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলীয় অভায়ারণ্য সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এ অংশটি সুন্দরবনের পুর্ব বিভাগের শরনখোলা রেঞ্জের অন্তর্গত। সমগ্র সুন্দরবনের সর্বাপেক্ষা আকর্ষনীয় অঞ্চল কটকা ও কচিখালী রয়েছে এই অংশেই। কটকা কচিখালী ছাড়াও শরনখোলা রেঞ্জের সুপতি, বাদামতলা, জামতলা, তিনকোণা আইল্যান্ড ও জেলে পল্লী­ দুবলা পর্যটকদের কাছে সমাদৃত।

সাগর তীরে কটকা অভয়ারণ। এখানকার মনোরম পরিবেশ দেশী-বিদেশী পর্যটকদের প্রধানতম আকর্ষণ। ঘন বনানীর ছায়ায় নির্মিত বিশ্রামাগারের বারান্দায় বসে চোখের সামনে উত্তাল সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ পর্যটকদের উচ্ছÍসিত করে তোলে। বিকালে বিশ্রামাগারের চারপাশে হাজার হাজার চিত্রল হরিণের ছোটাছুটি, বানরের কোলাহল আর সকালে নদীর পাড়ে কুমীরের রোদ পোহানোর দৃশ্য অপূর্ব। এখানে বিশ্রামাগার প্রান্তিক-এ ৪ শয্যাবিশিষ্ট ২টি কক্ষ রয়েছে।

পূর্ব- অভয়ারণ্যের দক্ষিণ-পূর্বপ্রান্তে সাগর তীরে গড়ে উঠেছে কচিখালী। সুন্দরবন পর্যটকদের জন্য এখানে গড়ে উঠেছে একটি বড় ধরনের বিশ্রামাগার। এক শয্যাবিশিষ্ট তিনটি ও দুই শয্যাবিশিষ্ট একটি বেডরুম, ড্রইংরুম ও ডাইনিং রুমের সমন্বয়ে এ বিশ্রামগারটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রতি শীতমৌসুম অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস এখানে কৌতুহলী পর্যটকদের ভীড় থাকে। তারা এখানকার সাগরপাড় আর ছনক্ষেতে খুঁজে ফেরে বহু প্রত্যাশিত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ঝাঁক বাধা চিত্রল হরিণ ছুটে বেড়িয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দেয় পর্যটকদের আগামন বার্তা। তাই শুনে মুচকি হাসে গাছে গাছে বানরের ঝাঁক। নিস্তব্ধ প্রাকৃতিক পরবেশ আবার হঠাৎ করে চেনা অচেনা পাখ-পাখালির কলকাকলী জাগায় শিহরণ। কটকা কেন্দে র কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান জামতলা। জামতলায় রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। যেখান থেকে বিস্তীর্ণ ছনক্ষেতে হাজার হাজার হরিণের ছোটাছুটি আবার কখনও রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যেতে পারে।

কচিখালী আর কটকার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানের নাম বাদামতলা। বাদামতলা অত্যন্ত নির্জন এক সমুদ্র সৈকত। সেখানে আছড়ে পড়া সামুদ্রিক ঢেউ পর্যটকদের মন কাড়বে। শীতকালে বাদামতলার সৈকতে অজস্ত্র বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায়। কচিখালী ও জামতলা থেকে পায়ে হেটে বাদামতলা পৌছানো সম্ভব।

সাগরদ্বীপ দুবলাসহ সন্নিবেশিত ১০টি চরে মৎস্য মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মৎস্যজীবী ভীড় জমায়। অক্টোবরে এরা আসা শুরু করলে ও নবেম্বরে রাসমেলা নামক এক ধর্মীয় উৎসবের মধ্য দিয়ে তাদের বছরের কাজ শুরু হয়। দু’শ বছরের ঐতিহ্যলালিত এ রাসমেলাতেও দেশী-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শনার্থী ভীড় জমায়।

শরণখোলা রেঞ্জে যোগাযোগ ও যাতায়াতের জন্য এ রেঞ্জ বিশেষ উপযোগী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বাগেরহাট থেকে বাসযোগে শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারে আসতে হবে। এখানে সাশ্রয়ী ভাড়ায় বিভিন্ন ধরনের লঞ্চ ও ট্রলার ভাড়া পাওয়া যায়। শরণখোলা রেঞ্জ-এর মাধ্যমে পূর্ব বনবিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে শরণখোলা থেকে কচিখালী ও কটকায় যেতে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা সময় লাগে। শরণখোলা থেকে এর দূরত্ব যথাক্রমে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। শরণখোলা রেঞ্জের কটকাও কচিখালীতে আরামপ্রদ বিশ্রামাগারে পর্যটকরা যেমন রাত্রিযাপন করতে পারে, তেমনি ইচ্ছে করলে একদিনের মধ্যে সমগ্র এলাকা ঘুরে ফিরে আসতে পারে।

তবে এজন্য কিছু কাজ করা দরকার। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে পর্যটকদের বনে প্রবেশের রাজস্ব গ্রহণ ও অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শরণখোলা রেঞ্জ ভিত্তিক পর্যটকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারী উদ্যোগে নিরাপদ জলযানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রস্তাবিত সাইবোর্ড- শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়ক-এর কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বনদস্যু ও জলদস্যুদের কবল থেকে পর্যটকদের নিরাপদ রাখতে হবে। নিরাপদ রুটে নৌ-বাহিনী ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করতে হবে। সুন্দরবনের আকর্ষণীয় জায়গা চিহ্নিত করে পরিবেশ উপযোগী অবকাঠামো ও চিত্তবিনোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ রেঞ্জের উজ্জ্বলতম পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রচারও প্রসারের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করতে হবে। সুপতি ষ্টেশনে এবং কচিখালী থেকে জামতলা পর্যন্ত উডেন ট্রেইল তৈরি করে গভীর বনে পর্যটকদের নিরাপদ পথ চলার ব্যবস্থা করতে হবে। শরনখোলা রেঞ্জ অফিস বা তেরাবেকা টহল ফাড়ি সংলগ্ন এলাকায় মংলা করমজলের মত টুরিষ্ট স্পট স্থাপন করতে হবে।

0 comments:

Post a Comment