একটি সাদা ধবধবে ভিক্টোরিয়া আমলের বাড়ি। এটিকে কেন্দ্র করে চারদিকে বিশাল এক বইমেলা। শুধু বইমেলা বললে ভুল হবে, এটি প্রাণের মেলা। বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলা। যে বাড়িটিকে কেন্দ্র করে এতসব আয়োজন আবর্তিত হয় সেই বর্ধমান হাউসের ইতিহাসটুকু একেবারেই তুচ্ছ করার মতো নয়। বর্ধমান হাউসের ক্ষেত্রে যে কথাটি বেশি প্রচলিত আছে সেটি হচ্ছে বর্ধমানের মহারাজা এটি নির্মাণ করেন। 'ডায়াকি'র যুগে অবিভক্ত বাংলার গভর্নরের শাসন পরিষদের সদস্য হিসেবে মহারাজাকে তৎকালীন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় বছরে একবার আসতে হতো। তাই তিনি তার মর্যাদার উপযুক্ত এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। কিন্তু বাংলা বিশ্বকোষ (৩য় খণ্ড, ১৯৭৩, ঢাকা পৃ. ৩৬৬) অনুযায়ী ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা যখন প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিবর্তিত হয় তখন সাবেক হাইকোর্ট ভবন, কার্জন হল প্রভৃতির সঙ্গে এটিও নির্মিত হয়। সম্ভবত এটিকে সরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং অতিথিদের জন্য বাংলো হিসেবেই ব্যবহার করা হতো। বর্ধমানের মহারাজা যেহেতু ১৯১৯-২৪ সাল পর্যন্ত গভর্নরের শাসন-পরিষদের সদস্য ছিলেন তাই তিনি ওই সময় পর্যন্ত এ বাড়িতে রাজকীয় অতিথি হিসেবেই বাস করতেন। ফলে এক সময় তার নামানুসারে এ বাড়িটির নাম হয়ে যায় 'বর্ধমান হাউজ'। বাড়িটির গঠন প্রকৃতিতে এটিকে ভিক্টোরিয়ান রীতিতে ফেলা শ্রেয়তর হবে। এর অর্ধচন্দ্রাকৃতির বারান্দা, নিচতলার নাচের বলরুমের পাশাপাশি দ্বিতীয় তলায় ফায়ার প্লেস_ এসব কিছুই তারই সাক্ষ্য বহন করে।
প্রথম দিকে বর্ধমান হাউসকে দ্বিতল হিসেবেই নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে এটিকে ত্রিতলে উন্নীত করা হয়। বর্ধিত করার সময় এর আদি নকশার সঙ্গে সাদৃশ্য রাখার ফলে তৃতীয় তলাটিকে অবাঞ্ছিত মনে হয় না। পুরোটিকেই সম্পূর্ণ অংশ হিসেবেই গ্রাহ্য করা যায়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বর্ধমান হাউস তার এলাকার মধ্যে পড়ে। ফলে কিছুটা সময় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯২৬ সালের দিকে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন বর্ধমান হাউসের একটি অংশে বাস করতেন এবং তার অফিস ছিল বর্ধমান হাউজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার ল্যান্ডিংয়ের বাঁ দিকের ঘরটি। এখানে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে কাজ করতেন তিনি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন এই রুমটিতে তিনিও কিছুদিন ছিলেন। দেশ বিভাগের পর এটি পাকিস্তানের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এবার আসা যাক আমাদের স্বাধিকারের সঙ্গে বর্ধমান হাউসের সম্পর্কের উৎস প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল '৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির মাধ্যমে। '৪৭-এর দেশ বিভাগের পর ধর্মকে উপজীব্য করে দুটি জাতিসত্তাকে সৃষ্টি করা হয়। পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের আধিক্যের কারণে অবধারিতভাবে সেটি যুক্ত হলো হাজার হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানের সঙ্গে। পাকিস্তানের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ পশ্চিম ও পূর্বের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচানোর একটা চেষ্টা হিসেবে আবিষ্কার করেন পূর্ব-বাংলার একমাত্র ভাষা হতে হবে উর্দু। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রফিক, জব্বারের মতো অনেক তাজা প্রাণের আত্মাহুতি। তারপর থেকে কালক্রমে পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের দূরত্ব বাড়তে থাকে, যার পরিসমাপ্তি ঘটে '৭১-এর স্বাধীনতার লড়াইয়ের মাধ্যমে। '৫২ থেকে '৭১-এর মাঝের সময়টুকুতে প্রবলভাবে প্রবহমান ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এ আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক, অর্থনেতিকই ছিল না, সে সঙ্গে প্রবলভাবে সাংস্কৃতিকও ছিল।
যুক্তফ্রন্টের প্রস্তাবিত ২১ দফা ছিল বাংলার জনগণের মুক্তির সনদ। এর ২১ দফার ষোড়শে বলা হয়, 'যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসবহুল বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।' ২১ দফায় বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগার করার কথা বলা হয়, কারণ এটি ছিল পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন। ফলে পূর্ব বাংলার জনস্বার্থবিরোধী সকল কর্মপন্থা, নীতি ও চক্রান্ত এ বর্ধমান হাউস থেকেই পরিচালিত হতো। যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) প্রথম বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করার প্রাথমিক নির্দেশ দেন।
১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর আবু হোসেন সরকার বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমীর উদ্বোধন করেন। যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন বর্ধমান হাউস ত্যাগ করার পর এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে পরিণত হয়। ফলে পুরো ভবনটি খালি করতে বাংলা একাডেমীর প্রায় এক বছর লেগে যায়। বাংলা একাডেমীর প্রথম কার্যালয় হিসেবে একতলার পূর্বদিকের তিনটি কক্ষ ব্যবহার করা শুরু হয়। কালক্রমে বাংলা একাডেমী শুধু বাংলা ভাষার গবেষণাগার হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে জাতির আশা-ভরসার স্থল।
উত্সঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
0 comments:
Post a Comment