Sunday, August 15, 2010

ফেনসিডিল

7 comments
বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের সর্বনাশা ছোবলের ইতিহাস অনেক পুরনো। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম থেকে এশিয়া মহাদেশের উপর এই ছোবলের কালো ছায়া বিস্তার লাভ করে এবং বর্তমানে তা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মাদক দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ধরনেরও প্রসার ঘটেছে ব্যাপক হারে। মদ, গাঁজা, আফিম, চরস, মারিজুয়ানা, হেরোইন ইত্যাদি পুরাতন মাদক দ্রব্যের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে প্যাথিডিন ও ফেনসিডিলের মত জীবন রক্ষাকারী ঔষুধও। আমাদের দেশে মূলত: ৮০'এর দশক থেকেই মাদকদ্রব্যের ব্যবহার উদ্বেগজনক রূপ নেয়। এক শ্রেণীর বিপথগামী তরুণ / তরুণী উল্লেখিত মাদকের সঙ্গে ব্যাপকহারে জড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য মাদক দ্রব্যের মধ্যে ফেনসিডিল নামক ওষুধ জাতীয় দ্রব্যটির ব্যবহার এখন সবার শীর্ষে। অথচ এই ফেনসিডিল এক সময় এ দেশসহ আশেপাশের দেশগুলোতে ব্যবহৃত হতো জীবন রক্ষার তাগিদে। তখন কেউ জানত না যে এটি মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। ফেনসিডিল সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য এখানে উল্লেখ করা হল:

PHENSEDYL  থেকে ফেনসিডিল

ইংরেজি Phensidyl শব্দ থেকেই ফেন্সিডিল নামকরণ করা হয়েছে। ঋঅঘঈণ'র আভিধানিক বা আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে স্থুল কল্পনা বা কল্পনা শক্তি, কল্পিত বস্তু বা মূর্তি, খোশ-খেয়াল, অসাড় কল্পনা, খেয়ালী পছন্দ, শখ, রুচি, কল্পনা বা খোশ-খেয়াল চরিতার্থ করে এমন অথবা কল্পনা বা খোশ খেয়াল থেকে প্রসূত সাময়িক আকর্ষণ, নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা করা ইত্যাদি। সুতরাং ঋঅঘঈণ শব্দের অর্থই ফেনসিডিলের কার্যকারিতা সম্পর্কে ইঙ্গিতদানে যথেষ্ট বলে মনে করা হয়।

ফেনসিডিল কি ও কেন : আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর পূর্বে ফেনসিডিল ছিল কেবলই একটা সাধারণ কাশির ওষুধ বা ঈড়ঁময ঊষরীরৎ। এদেশে ফেনসিডিল উৎপাদন বা আমদানির বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান নেই। ১৯৮৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের মে এন্ড বেকার নামে একটি প্রতিষ্ঠান ফেনসিডিল বাজারজাত করত, কিন্তু ওই বছর দেশের জাতীয় ওষুধ নীতির আওতায় এটিকে নেশার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কায় সরকার ফেনসিডিল বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু রোন পুল্যাংক নামে একটি ভারতীয় বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি নীলরঙা লেবেলে ১২৫ মিলিলিটারের ক্ষুদ্র বোতলে ফেনসিডিল বাজারজাত অব্যাহত রাখে। যার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ভারতীয় প্রায় ৯০ রুপি।

ফেনসিডিল কি দিয়ে তৈরি : ফেনসিডিল তৈরির উপাদান হিসেবে মূলত ৩টি কেমিক্যালের নাম জানা যায়। এগুলো হচ্ছে_ (১) কোডিন ফসফেট, (২) প্রমিথিজিন হাইড্রোক্লোরাইড ও (৩) ইফিড্রিন হাইড্রোক্লোরাইড। এর মধ্যে কোডিন ফসফেট হচ্ছে মরফিন-প্যাথেডিন গ্রুপের সিনথেটিক ডেরিভেটিভ এবং এটিতেই রয়েছে নেশার উপাদান।

কোথা থেকে কিভাবে আসে : ফেনসিডিলের মূল এবং একমাত্র উৎস হল ভারত। অবৈধ পাচার প্রতিরোধে নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় (!) দেশের প্রতিটি সীমান্ত হয়ে বিভিন্ন উপায়ে এই ফেনসিডিল আসে। সীমান্ত এলাকা থেকে সাধারণত ট্রাক-বাসের টুলবঙ্, কেবিন ও লাগেজবঙ্ েফেনসিডিল দেশের সব অঞ্চলে পেঁৗছে যায়। এক্ষেত্রে আরেকটি সুবিধাজনক পদ্ধতি আছে, সেটি হল প্লাষ্টিকের জেরিকেন। লুজ ফেনসিডিল জেরিকেনে করে নিয়ে এসে পরে বোতলজাত এবং বিক্রি করা হয়। এই পদ্ধতিতে যশোর থেকে কুষ্টিয়া-ফরিদপুর হয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে মাছের ট্রলার বা ডিজেল বোটের মাধ্যমে বেশিরভাগ ফেনসিডিল আসে। ফেনসিডিল পরিবহনের এই রুটকে ব্যবসায়ীরা বলে কাটালাইন। এছাড়া মাছের পোনা ও বীজভর্তি মাটি ও এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি বা জারের মধ্যেও ফেনসিডিল আনা হয় বলে জানা গেছে।

কারা খায় : বিশেষত শিক্ষিত তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যেই ফেনসিডিলের ব্যবহার অধিক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী এই নেশায় ব্যাপকভাবে আসক্ত। তবে দেশের বেকার শ্রেণীর হতাশাগ্রস্ত একটি বৃহৎ অংশ ফেনসিডিল ব্যবহারের মাধ্যমে সাময়িক সুখ (!) লাভের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।

এ ব্যবসায় জড়িত কারা : প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেম বিবর্জিত অসাধু ব্যবসায়ীরাই এই ব্যবসায় জড়িত। এছাড়া তুলনামূলক অশিক্ষিত লোকজনই ফেনসিডিল বিক্রি করে থাকে। মহিলারাও এই নেশা ও পেশার সঙ্গে সমানভাবে জড়িয়ে পড়েছে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও বিশিষ্ট অনেক ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও ফেনসিডিলের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে আজকাল।

ফেনসিডিল থেকে ডাইল : ভক্তদের দেওয়া বিচিত্র সব নাম ও উপমার ভিড়ে নেশার ফানুস ফেনসিডিল যেন তার আসল নাম হারিয়ে ফেলেছে। ফেনসিডিল এখন পরিচিত প্রধানত 'ডাইল' নামে। ফেনসিডিলকে সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে তা থেকে 'ফেনসি' বাদ দিয়ে মূলত এই নেশাদ্রব্যটির নাম হয়ে গেছে 'ডাইল'। এছাড়া ফেনসি, মাল, জিনিস, ফ্যান, টাকুর, নফে ইত্যাদি নামেও এটি বিভিন্ন এলাকায় পরিচিত। তবে 'ডাইল'ই ফেনসিডিলের বর্তমানে একমাত্র সর্বপরিচিতি ও সর্বজ্ঞাত নাম। আসুন সবাই মিলে এই মরন নেশা ফেনসিডিলকে না বলি।

7 comments:

Post a Comment