Wednesday, August 25, 2010

ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক কলেজ

1 comments
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও চিত্কৎসা ব্যবস্থায় উদ্ভিদের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা প্রাচীনকাল থেকেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে সাথে আমাদের দেশে হারবাল চিকিৎসার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ। কিšতু এখানকার গ্র্যাজুয়েটদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, সরকারের সঠিক নীতির অভাব ও লোকবল সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে এ কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। ঢাকার মিরপুর-১৩ নম্বর সেকশনে অবস্থিত সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত । দেশে হারবাল মেডিসিনের একমাত্র সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজলভ্য করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে ও প্রায় ১৪ কোটি টাকা অর্থায়নে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৯-১৯৯০ শিক্ষাবর্ষ থেকে এই কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। রিপোর্টটি তৈরি করেছেন সুজা উদ্দিন

সৌন্দর্যময় ক্যাম্পাস: তিন একর জায়গায় বাউণ্ডারি প্রাচীর ঘেরা সুন্দর পরিবেশে সাজানো গোছানো ক্যাম্পাস। এখানকার অবকাঠামিক সৌন্দর্য দৃষ্টিনন্দন। একাডেমিক ভবন, প্রোডাকশন ও গবেষণা ভবন (ছাত্রী হোস্টেল), ৩ তলা বিশিষ্ট ২০০ শয্যার হাসপাতাল, ছাত্র হোস্টেল, অফিসার্স ও কর্মচারি কোয়ার্টার। হাসপাতালে চালু আছে বহিঃবিভাগ, আন্তঃবিভাগ, জরুরী বিভাগ, ইউনানী ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিভাগ, পঞ্চকর্ম বিভাগ, প্যাথলোজি ও সার্জারি বিভাগ। রোগীদের জন্য ২৪ ঘণ্টা হাসপাতাল খোলা থাকে। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে রয়েছে মনোরম ভেষজ বাগান। এ বাগানে সাধারণ ভেষজ উদ্ভিদের পাশাপাশি রয়েছে চৈ, কর্পুর, গন্ধভাদুলে, জিনসেং, নিসিন্দা, ক্ষেত্রপাপড়া, ঢোলসমুদ্রকর্ণ, সারিবা, শতারবি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। এখানে একটি ঔষধ প্রস্তুত ইউনিট আছে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণা করে বিভিন্ন রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরি করে থাকে।

কোর্স কারিকুলাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মেসি অনুষদের মাধ্যমে এ কলেজের ভর্তি, পরীক্ষা গ্রহণ ও গ্র্যাজুয়েটদের সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। এখানে ২টি বিভাগ রয়েছে- ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক। কোর্স ৫ বছর মেয়াদী। কোর্সের নাম ব্যাচেলর অব ইউনানী মেডিসিন এ্যাণ্ড সার্জারি (বিইউএমএস) ও ব্যাচেলর অব আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এ্যাণ্ড সার্জারি (বিএএমএস)। কোর্স শেষে কলেজ হাসপাতালে এক বছরের ইন্টার্ণশীপ ট্রেনিং করানো হয়। অন্যান্য মেডিকেল কলেজের সিলেবাসের মত এখানে মূল ২০টি বিষয় পড়ানো হয়।

বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্র: এখান থেকে পাসকৃত ডাক্তারগণ ভারত, কানাডা, চীন, জাপান, ইউকে ও আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে পারেন। ভাল রেজাল্ট থাকলে স্কলারশিপও পাওয়া যায়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল, পিএইচডি করা যায়। এই কলেজ থেকে পাস করে ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তারি পেশা ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্র রয়েছে। সাধারণ ক্যাডারে বিসিএস পরীক্ষাও দেয়া যায়। বর্তমানে ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতালের মধ্যে ৪৫টিতে অল্টারনেটিভ মেডিকেল অফিসার (এএমও) হিসেবে এখানকার পাসকৃত শিক্ষার্থীরা চাকরি করছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন করে অল্টারনেটিভ মেডিকেল অফিসার (এএমও) পদ তৈরি ও নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৫৩টি উপজেলায় পদ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় অধিকাংশ ফার্মাসিউটিক্যালে আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরি শুরু করেছে। যেমন-স্কয়ার, ইবনে সিনা, একমি, বায়োফার্মা, হামদর্দ, নেপচুন, এসকেএফ, জেসন, মডার্ণ হার্বাল, গ্রীণ ফার্মা ইত্যাদি। এসব জায়গায় মেডিকেল অফিসার ও প্রোডাকশন অফিসার হিসেবে কাজের সুযোগ রয়েছে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: বর্তমানে এ কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০০। এর মধ্যে ছাত্র ১৯০ জন ও ছাত্রী ১১০ জন ছাত্রী। প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ইউনানী শাখায় ২৫জন ও আয়ুর্বেদিক শাখায় ২৫ জন করে মোট ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সাধারণত জানুয়ারি মাসে ভর্তি ফরম বিতরণ হয় এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ভর্তি পরীক্ষার আবেদনের যোগ্যতা, পরীক্ষা পদ্ধতি ভর্তি ফি সাধারণ মেডিকেল কলেজের মতই। এখানে শিক্ষক ও মেডিকেল অফিসার রয়েছে মাত্র ২৮ জন। এই স্বল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে যথাযথভাবে কলেজের শিক্ষাদান ও ২৫০ শয্যার হাসপাতালে সেবা দেয়া সম্ভব হয় না।

ছাত্র সংসদ ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম: মেডিকেল কলেজটি ছোট হলেও এখানে রয়েছে কার্যকর ছাত্র সংসদ। ১৯৯৫ সালে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ভিপি ছিলেন কেএম এনামুল হক তৌফিক ও জিএস কেএম ইকবাল হোসেন। এ পর্যন্ত তিনবার নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে গত ১২ জানুয়ারি। ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের অভাব অভিযোগের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে তা দূর করতে ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এছাড়া ডিবেটিং ক্লাব ও নাট্য সাংস্কৃতিক দল নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে। শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর শিক্ষা সফর করে।

সমস্যা নিয়ে চলা: ছোট পরিসরের ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। তাই সবার মাঝে রয়েছে যথেষ্ট আšতরিকতা ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পড়ালেখার শত চাপ, তারপরও পরস্পর আনন্দ উচ্ছ্বাসে দিন কাটায়। তবে নানারকম সমস্যা তাদেরকে সবসময় পীড়িত করে। কলেজে গিয়ে পরিচয় হয় বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী তš§য়, হƒদয়, মামুন,শবনম, নিশি, শাহরিমা পারভীন তš§ী, লোপা, সোহেল, রহিম, লিখন, গাজী, জাকিয়া, রাজ্জাক, ইমরান, মাহাবুব, মুক্তা, সুমি, সম্পা, শিল্পী, বোরহানসহ আরো অনেকের সাথে। তারা জানায়, তাদের সুখ-দুঃখের নানা কথা। এখানে আবাসন সমস্যা রয়েছে। ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের আবাসন সমস্যা প্রকট। আবুল কাশেম নামে ১৪০ সিট বিশিষ্ট একটি হোস্টেল রয়েছে। মোট ছাত্রের তিনভাগের দুইভাগ ছাত্ররা থাকতে পারে, বাকিরা বাইরে থাকে। ছাত্রীদের জন্য পৃথক কোন ছাত্রী হোস্টেল নেই। তারা থাকে ঔষধ প্রোডাকশন ইউনিটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায়। এখানে মাত্র ৬৪ জন ছাত্রী থাকতে পারে।

আয়ুর্বেদিক বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্রী জাকিয়া সুলতানা বলেন, অর্ধেক ছাত্রী হোস্টেলে থাকতে পারে না। কিন্তু সবার হলে থাকা জরুরী। এক রুমে ৮/১০ জন গাদাগাদি করে থাকতে হয়। কমন রুম বন্ধ থাকায় তারা বিনোদন ও আনুষঙ্গিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নিজস্ব হোস্টেল থাকায় তারা সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, ছাত্ররা যে হোস্টেলে না থাকে সেটি মূলত মেয়েদের হোস্টেল ছিল।

ইউনানী দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইমন হোসেন বলেন, তাদের শিক্ষক ও মেডিকেল অফিসার স্বল্পতা প্রকট। ঔষধ প্রস্তুত ইউনিটে রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাব।

ছাত্র সংসদের ভিপি মামুন হোসেন অনাদী বলেন, আমরা একইসাথে এমবিবিএস সমমান সিলেবাস এবং অতিরিক্ত ইউনানী, আয়ুর্বেদিক বিষয় পড়ছি। কিন্তু আমাদেও ইন্টার্নি ভাতা এবং ছাত্রবৃত্তি দেয়া হয় না। এ কলেজ নিয়ে সরকারের সঠিক নীতিমালা নেই। দীর্ঘদিন সরকারি নিয়োগ বন্ধ আছে। এখনও বিএমডিসি স্বীকৃৃতি চালু হয়নি। কাগজে-কলমে কলেজটি এখনও ডিগ্রী নাম থেকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, প্রয়োজনীয় শিক্ষক না থাকায় ক্লিনিক্যাল মেথড বিষয়ে যথাযথ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মডার্ণ মেডিসিনের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।

কলেজের সহকারি অধ্যাপক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. এম মুস্তফা নবী বলেন, সীমিত সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে আমরা শিক্ষার মান ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। নিয়মের ঘাপলা থাকায় কলেজের নামে বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার একটু সুদৃষ্টি দিলে কলেজের উন্নয়ন হবে এবং শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ভাল ভূমিকা রাখতে পারবে।

কলেজের নাম নিয়ে জটিলতা

কলেজের নাম নিয়ে রয়েছে জটিলতা। বাহ্যিক অবয়বে ও সাইনবোর্ডে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল লেখা থাকলেও, কাগজে কলমে রয়েছে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ডিগ্রী কলেজ। শিক্ষকদের পদোন্নতিতে রয়েছে সমস্যা। কলেজের বয়স ২০ বছর পার হলেও মাত্র ১ জন সহকারি অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা পাস করে সাধারণ বিসিএস-এ অংশ নিতে পারে, কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ নেই। গ্র্যাজুয়েটরা এখনও বিএমডিসি স্বীকৃৃতি পায়নি ও পেশাগত রেজিস্ট্রেশন মেলেনি। এতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে পুুলিশী হয়রানিসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তাদের।

1 comments:

Post a Comment