Monday, August 23, 2010

জগদল বিহার, নওগাঁ

0 comments
নওগাঁ জেলার ৬৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী এক উপজেলার নাম ধামইরহাট। এই উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে জগদল মৌজায় এক মাঠের মাঝখানে অবস্থিত বিহারটির নাম জগদল বিহার। সবুজ-শ্যমল ঘেরা প্রাচীন এই নিদর্শনটি নওগাঁ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খ্যাতি বহন করছে।

এই বিহারটির ইতিহাস নিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর আগে এ অঞ্চলে রাজা-প্রজার শাসন চলত বলে ধর্মভীরু সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য তৈরি করা হয় বিভিন্ন মন্দিরসহ কয়েকটি উপাসনালয়। তবে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ও ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের লেখা 'আইন-ই-আকবর' নামক গ্রন্থ থেকে জগদল বিহার সম্পর্কে কয়েকটি মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।

জানা গেছে, একাদশ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে এ জনপদে বসবাস করত সেই সময়ের কিছু প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার পরিবার। রামপালের গৌড় রাজা বিহারটি অন্য এক রাজার কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করে 'রামাবতি' নগর নামক রাজধানী স্থাপন করেন। এই রামাবতির রাজধানীর উপকণ্ঠে জগদল বিহারটি স্থাপন করেন। কালের পরিক্রমায় এই বিহারটি ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ৩ দফা খনন পরিচালনা করার ফলে এই প্রত্ন স্থলে দৈর্ঘ্যে ৮০ মিটার এবং প্রস্থে ৭৮ মিটার পরিমাপের একটি চতুষ্কোণাকার পূর্বমুখী স্থাপনার ভিতের অংশ অনাবৃত হয়েছে। এর মাঝখানে রয়েছে ছাদবিহীন চাতাল এবং চারটি বাহুতে সারি সারি অপরিসর প্রকোষ্ঠ। উত্তর বাহু এখনও অন্তরিত অবস্থায় রয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিম বাহুতে প্রকোষ্ঠের সংখ্যা ৮টি করে এবং পূর্ব বাহুতে ৯টি অনুমিত রয়েছে। পশ্চিমের বাহুতে প্রকোষ্ঠ ছাড়াও ঠিক মাঝামাঝি অংশে চত্বর ও পেছন দিকে একটি প্রধান মূর্তি কোঠা রয়েছে। এছাড়া চারটি কোণের প্রতিটিতে রয়েছে তোপমঞ্চ আকারের অপরিসর মূর্তি কোঠা। আর এ বৈশিষ্ট্যটির উপর নির্ভর করে এই স্থাপনাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন 'পঞ্চায়তন' মন্দির নিদর্শন গণ্য করা হয়। পঞ্চায়তন মন্দিরটির গবরাট, সরদল, দরজার বাজুবন্ধ প্রভৃতি অংশে প্রচুর পালিশকৃত কালো পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলোতে নানা ধরনের রূপচিহ্ন ও দেব-দেবীর (দ্বারপাল, অপ্সরা, বোধিসত্ত্ব ও তথাগত) উৎকীর্ণ রয়েছে। এছাড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে কালো পাথরের উৎকীর্ণ একটি খদিরবানী তারা, একটি সম্বল (?), একটি স্ফিতোদর নরের ধড় অংশ এবং চুনাপাথরের উৎকীর্ণ একটি ক্ষুদ্রাকার হেবজ শক্তি মূর্তি।

উল্লেখ যে, অনুরূপ একটি হেবজ শক্তির মূর্তি এর আগে নওগাঁর ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বিহারে আবিষ্কৃত হয়েছিল। অন্যান্য পুরাবস্তুর মধ্যে রয়েছে পোড়া মাটির ফলক, মৃতপাত্র, পোড়ামাটির গোলক ও কারুকাজ করা ইট প্রভৃতি। অপরদিকে পোড়ামাটির ফলকগুলোতে বিধৃত হয়েছে মানুষ কিংবা পশু। আরো পাওয়া গেছে লিপিভাষ্য উৎকীর্ণ দুটি পাথরের খণ্ডাংশ। এসব কিছুর মধ্যে খ্রিস্টাব্দ ১২-১৩ শতকে প্রচলিত নমুনারীতির ছাপ বজায় রয়েছে। এই মহাবিহারের প্রধান উপাস্য দেবতা ছিলেন অবলোকিতেশ্বর। এছাড়া এ প্রত্নস্থলে মাত্র ৩০০ মিটার পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে 'কাট্টা' নামের একটি মৃতপ্রায় নদী এবং ২.৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন মাপের প্রচুর দীঘি ও ঢিবি। যত্রতত্র আবাদি জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরনো খোলামকুচি ও পাটকেল। পার্শ্ববর্তী জগৎনগর গ্রামে এগুলোর পরিমাণ আরো বেশি। দীঘিগুলো প্রায় সবই উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। কয়েকটির নাম হলো টোককামারি, গচতার, লালগর, দিগুর দীঘি ও ঐতিহাসিক আলতাদীঘি। পার্শ্ববর্তী দক্ষিণের গ্রাম চান্দর এবং আড়ানগরেও অনুরূপ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এসব গ্রাম থেকে সংগৃহীত প্রচুর পুরাবস্তু রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

এই বিহারটিকে বটকৃষ্ণ রায়ের জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষও বলা হয়ে থাকে। এই বিহারের প্রথম নামটির (জগদল বিহার) সুনাম বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যে ছড়িয়ে পড়লেও দ্বিতীয়টি নানা কারণে এমনকি নিজ জেলা সদরের মানুষের কাছেও এখনো তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। অযত্ন, অব্যবস্থাপনা ও সংস্কারের অভাবে প্রাচীন এ ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্বের স্থাপত্যটি হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে তার সৌন্দর্য। তৎকালীন রামপালের গৌড় রাজা রামাবতি নগরে একটি মন্দির তৈরি করেন, যা বাঙালিদের শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আর এ জগদল বিহারে স্বনামধন্য পণ্ডিত ও দানশীল বিভূতি চন্দ্র প্রায়ই ৬০টি তিব্বতি বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেন বলে বিহারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়। তথ্য বিভ্রান্তির কারণে অনেকে জগদল বিহারটি দিনাজপুর জেলায় উল্লেখ করলেও আসলে প্রকৃতপক্ষে এটি যে নওগাঁ জেলায় অবস্থিত তা অনেক ইতিহাসবিদেরই অজানা। আবার কেউ দু'পক্ষের তথ্যগুলোকে একই মনে করেন। তবে একথা সত্য যে, নওগাঁ জেলা আগে দিনাজপুর জেলার একটা অংশবিশেষ বলে দাবি করেন ইতিহাসবোদ্ধারা। জগদল বিহারের আর একটি নাম রামৌতি। বিহারের চারপাশে সেই সময়ে সুভকর গুপ্ত, ধর্মকার গুপ্ত, সাক্ষ্যশ্রী নামক অনেক জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত ,মনীষী ব্যক্তি বসবাস করতেন। এখানে এলে জানা যাবে বাংলাদেশের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক। বৈদেশিক পর্যটকদের জগদল বিহারের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সবার কাছে তুলে ধরার দাবি নওগাঁ জেলাবাসীর অনেকদিনের।

**বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ**

0 comments:

Post a Comment