Saturday, August 28, 2010

মুখোশচিত্র

0 comments
বাংলার লোক কারুশিল্পের ইতিহাসের এক অনন্য শৈল্পিক অংশ মুখোশচিত্র। সামাজিক ইতিহাসের একটি মূল্যবান সম্পদও বটে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'দেশের লোকসংস্কৃতির মধ্যে অতীত যুগের সংস্কৃতির বহু নিদর্শন আজ সংযুক্ত আছে, সেগুলোর অন্যতম মুখোশচিত্র। এটি আমাদের জাতির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপকরণ'। মানবসমাজের মুখোশচিত্র-সম্পর্কিত শিক্ষার তথ্য ও তত্ত্বসংবলিত বিষয়কে সাধারণ অর্থে মুখোশচিত্রের ইতিহাস বলা হয়। মুখোশচিত্র গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সৃষ্টি। চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত মুখোশ মুখে লাগিয়ে মঞ্চে অভিনয় ও পূজা-পার্বণে নৃত্য পরিবেশিত হয়। যেকোনো অনুষ্ঠানে নৃত্য-অভিনয়ের সঙ্গে মুখোশের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে নানাভাবে মুখোশের আবির্ভাব ঘটে। বাংলাদেশের গ্রামের বিভিন্ন মেলায় বা যাত্রানুষ্ঠানে, চৈত্র-সংক্রান্তিতে নৃত্যের আয়োজন হতো, সেই মেলায় বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পসরা সাজানো হতো নানা ধরনের মুখোশ দিয়ে। ধরনের মুখোশ আছে যেগুলোকে খেলনাজাতীয় মুখোশ বলা যেতে পারে। আবার অনেক মুখোশ আছে যা নৃত্য, অভিনয় এবং পূজা-পার্বণে ব্যবহার করা হয়। মুখোশচিত্রের প্রতিটি শিল্পীই তাদের তৈরি মুখোশকে সামান্য রদবদল করে বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টি করে। যেমন_ বাঘ, ভালুক, বানর, দেবদেবী ইত্যাদি। আর এসবই শিল্পীর হাতের সৃষ্ট কলাকৌশল।

অদৃশ্য ও কল্পিত বিষয়কে মুখোশে প্রকাশ করা হয় যা মঙ্গল বা অমঙ্গল বাচক ঐন্দ্রিজালিকতা সৃষ্টির জন্য মুখোশচিত্রকে ৭টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। পৌরাণিক মুখোশ, লোকায়ত মুখোশ, গ্রামীণ মুখোশ, প্রাণী মুখোশ, সামাজিক মুখোশ, মিশ্র মুখোশ এবং অন্যান্য মুখোশ। লোকজ আচার-অনুষ্ঠানে লোকনৃত মুখোশের ব্যবহারের মূলে রয়েছে আবহমান গ্রাম-বাংলার নর-নারীর নানা অভিব্যক্তি যেমন_ বীরত্বব্যঞ্জক, কামভাব বা সম্মোহন ভাবের প্রকাশ। এছাড়া নানা কুপ্রভাব দূরীকরণে লোকসমাজের যুগ-যুগান্তরের সংস্কার ও বিশ্বাস অনুযায়ী আচার-অনুষ্ঠানে বিভিন্ন লোকনৃত্য প্রভৃতি ছাড়াও বিভিন্ন কাজে মুখোশচিত্র তৈরি হয়েছে।

মুখোশ সামাজিক বা ধর্মীয় ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ ও শক্তি সাধনার স্বরূপের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাছাড়া লৌকিক ও পৌরাণিক গল্পসমূহ হাসি-তামাশা, বিদ্রুপ ভয়ভীতির জন্যও মুখোশ মুখে লাগিয়ে নৃত্য এবং অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান। সভ্যতার আদি স্তরে শক্তিকে বশ করার প্রয়োজনে ও পরে সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শিশুদের খেলনা হিসেবেও মুখোশচিত্র ব্যবহার হয়। এখন প্রশ্ন আসে মুখোশচিত্রের উৎপত্তি হলো কিভাবে। মানুষের আদিযুগের বর্বর দশা থেকেই তার লোক কারুশিল্পে মুখোশ তৈরির কৌশল শিক্ষার সূত্রপাত। নৃতত্ত্ববিদ, পুরাতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের প্রচেষ্টায় আদিযুগের মানুষেরা প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করার অদম্য ইচ্ছায় বুদ্ধির সাহায্যে নানা উপায় ও কৌশল আবিষ্কার করেছিল এবং এই কৌশলগুলো তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের শিখিয়ে দিত। সম্ভবত লোক কারুশিল্পে এভাবেই বংশানুক্রমে মুখোশচিত্রের উৎপত্তি হয়েছিল।

বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই লোক কারুশিল্পের মুখোশের প্রচলন ছিল। ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, বগুড়া, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চলে আজো কিছু কিছু মুখোশের প্রচলন কোনোরকম টিকে আছে। এসব অঞ্চলের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবসহ অন্যান্য মেলা পার্বণে মুখোশ পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা বৈশাখের উৎসবে বিভিন্ন মুখোশচিত্র তৈরি করে শোভাযাত্রা সহকারে বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন করে।

মুখোশ কাঠ, কাগজ, মাটি, বেত, শোলা ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে। মুখোশ তৈরিতে লাল, নীল, হলুদ, এবং কালো রং প্রধান। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মালাকার, পাল, কুমার, আচার্য এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পী মুখোশ তৈরি করে থাকেন। মুখোশ তৈরি করতে গ্রাম-বাংলার দেবদেবীর মুখাকৃতি এবং বিভিন্ন ধরনের পশুপ্রাণীর মুখের মতো তৈরি করে যা ডাইস বা ছাপ হিসেবে পরিচিত, তার ওপর মুখোশের কাঠ ও বেত তৈরি করে নিতে হয়। পরে এগুলো শিল্পীরা হাতে টিপে টিপে দেবদেবীর কিংবা পশু আকৃতির মুখোশ তৈরি করেন। যেমন_ মুণ্ডু মূর্তির মুখোশ, বড়াম চণ্ডীর মুখোশ, বড়খা গাজীর মুখোশ, ধর্ম ঠাকুরের মুখোশ, সত্য নারায়ণ ও সত্য পীরের মুখোশ, পীর গোড়া চাঁদের মুখোশ, ওলা বিবির মুখোশ, ভৈরবের মুখোশ, ঘাটু দেবতার মুখোশ, মানিক পীরের মুখোশ ইত্যাদি।

রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার সুশান্ত পাল। নওগাঁ আত্রাইয়ের নয়ন মালাকার, বিশ্বনাথ মালাকার, মাগুরার শালিখা উপজেলার শংকর মালাকারসহ কয়েকজন মুখোশচিত্র শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তারা মুখোশচিত্র ধর্মীয়, সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারের প্রয়োজনে তৈরি করেন। তারা এই মুখোশচিত্র তৈরি করতে মাটি, কাগজ ও শোলার দ্বারা বংশানুক্রমে মুখোশচিত্র তৈরি করার কৌশল শিখেছেন। তারা বলেন, 'আজ কোনোরকমে আমরা টিকে আছি। এই শিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছে'।

আসলেই মুখোশচিত্র এখন লুপ্তপ্রায়। মুখোশচিত্রের শিল্পীরা এখন কালের বিবর্তনের সঙ্গে মুখোশচিত্রের পাশাপাশি তৈরি করেছেন শোলার আধুনিক কাজ এবং শখের হাঁড়িসহ অন্যান্য কাজ। তার কারণ মুখোশচিত্রের আর আগের ঐতিহ্য নেই। কিছু একটা করে তো তাদের চলতে হবে। তবুও তারা অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে এ মুখোশচিত্রটিকে ধরে রেখেছে। আমাদের লোক কারুশিল্পে মুখোশচিত্রের সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন শুধু জাদুঘরে কিংবা বিভিন্ন মেলা উৎসবে সীমাবদ্ধ না রেখে এ কাজে জড়িত শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এ শিল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব।
হাসান মাহমুদ রিপন

0 comments:

Post a Comment