দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি ব্রজলাল বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ (বি.এল কলেজ) ২০০২ সালে সমাপ্ত করেছে মহাকালের যাত্রাপথে শতবর্ষের পরিক্রমা। ১৯০২ সালের ৩ জুলাই এই কলেজের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাস শুরু হয় একই বছরের ২৭ জুলাই। শিক্ষা প্রসারের যে মহতী পরিকল্পনা নিয়ে এ শিক্ষায়তনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, শতবর্ষেরও বেশী সময় ধরে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে সে পরিকল্পনা আজ সফল। সরকারি বিএল কলেজ এখন সারাদেশে উচ্চ শিক্ষার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শতাব্দীকালে এ প্রতিষ্ঠানটিকে অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক চড়াই-উৎরাই। মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেক বিরুদ্ধ পরিবেশের। সে ইতিহাস একই সাথে ধারণ করে আছে চেতনার সীমাবদ্ধতায়, সংকল্পের দৃঢ়তায় ও অতিক্রমণের সাফল্যে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে ভৈরব নদের তীর ঘেঁষে ছায়া সুনিবিড় সুন্দর পরিবেশে স্থাপিত এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির স্বাপ্নিক রূপকার ও প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার বাঐডাঙ্গা গ্রামের ব্রজলাল চক্রবর্তী বি.এ (ট্রিপল), এম.এ (প্রথম শ্রেণীতে প্রথম), বি.এল।
০০ এনামুল হক
শুরুতে কলেজটির নাম ছিল ‘দৌলতপুর হিন্দু একাডেমী’। নামকরণ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় একটি বিশেষ ধর্মীয় এবং নৈতিক লক্ষ্য নিয়েই এ শিক্ষায়তনটি গড়ে তোলা হয়েছিল। শুরুতে হিন্দু একাডেমীকে দুটো অংশ বা শাখায় ভাগ করা হয়েছিল- ক. সারস্বত চতুষ্পাঠী ও খ. কলেজ বা একাডেমী। উভয় ক্ষেত্রেই ছাত্র এবং শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন আবাসিক। হিন্দু ধর্মীয় প্রাচীন আশ্রমিক আদলে (বিশেষতঃ উচ্চ বর্ণের হিন্দু) মেধা ও মননে আধুনিক ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনই ছিল ব্রজলাল চক্রবর্তীসহ উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য। এ কারণে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমী প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রথম পাঁচ বছরে কোন মুসলমান ছাত্রকে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষায়তনটিতে অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। ১৯০২ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত পরিদর্শনে আসা অধিকাংশ কর্মকর্তা কলেজটির সার্বজনীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ফলশ্রুতিতে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত কলেজটি সরকারি অনুমোদন পায়নি। এ সময় পর্যন্ত ছাত্ররা প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিত। অবশেষে ১৯০৬ সালের পরে বাধ্য হয়েই এ কলেজে মুসলমান ছাত্রদের ভর্তির অনুমতি দেয়া হয়। বর্তমান নড়াইল জেলার মির্জাপুর নিবাসী সৈয়দ নওশের আলী (পরবর্তীকালে এম.এল.এ. মন্ত্রী এবং বৃটিশ ভারতে যুক্ত বাংলার পার্লামেন্টের স্পীকার) ও নগরীর পার্শ্ববর্তী আটরা এলাকার মোঃ একরাম উদ্দিন প্রথম মুসলিম ছাত্র যারা এ কলেজে ভর্তি হন। তারা যথাক্রমে এ কলেজ থেকে ১৯০৯ ও ১৯১১ সালে আই এ পাস করেন। তবে ১৯৫৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত কলেজে অহিন্দু ও নি¤œ বর্ণের হিন্দুদের পাশাপাশি কোন ছাত্রীকে ভর্তি করা হয়নি। ১৯৫৬ সালে হোসনে আরা বেগম (পরবর্তীতে ডাক্তার) ও হাসমত আরা হেলেন (শিল্পী) নামে দু’জন ছাত্রী ভর্তি হন। তৎকালীন ছাত্র এ কে চাঁদ মিয়াসহ (পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কলেজের ছাত্র সংসদের প্রথম মুসলমান সহ-সভাপতি) মুসলমান ছাত্রগণ কলেজের নাম থেকে সাম্প্রদায়িক পরিচয় বহনকারী হিন্দু শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য জোরালো ভূমিকা রাখেন। কিন্তু তখন তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৯ এ ‘হিন্দু’ শব্দ ও ১৯৫০ সালে ‘একাডেমী’ শব্দ দুটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হয় ব্রজলাল কলেজ। ১৯৬৭ সালের ১ জুলাই কলেজটি সরকারিকরণ করা হয়। সেই থেকে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশে সরকারি ব্রজলাল কলেজ (বিএল কলেজ) নামে সমধিক পরিচিত। প্রতিষ্ঠার পর এ কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শিব চন্দ গুই (১৯০২-১৯০৩) ও প্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক (১৯৫২-১৯৫৪)।
‘দৌলতপুর হিন্দু একাডেমী’ প্রতিষ্ঠার সময় এর জমির পরিমাণ ছিল ০.২ একর (০৬ বিঘা)। কিন্তু শিক্ষায়তনটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে বিশাল পরিকল্পনা ছিল মাত্র দুই একর জমি তার জন্য আদৌ যথেষ্ট ছিল না। ভৈরব নদীর তীরবর্তী যে এলাকায় হিন্দু একাডেমী গড়ে তোলা হয়েছিল তার সংলগ্ন বিশাল এলাকা ছিল দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসিন কর্তৃক দানকৃত সৈয়দপুর এস্টেটের (মুসলমানদের কল্যাণের জন্য উৎসর্গীত) ওয়াক্ফ ভূসম্পত্তি। সৈয়দপুর এস্টেটের এই জমির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল খুলনা জেলার ডি.এম এবং কালেক্টরের ওপর। ব্রজলাল চক্রবর্তী হাজী মুহম্মদ মুহসিনের দানকৃত ওয়াক্ফ ভূসম্পত্তি ‘দৌলতপুরের হিন্দু একাডেমী’ এর জন্য দান হিসাবে পাওয়ার নিমিত্তে বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু ‘একাডেমীর’ নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে প্রথম অবস্থায় সে চেষ্টা সফল হয়নি। পরে ১৯০৬ সালে কলেজের দরজা সকল সম্প্রদায়ের জন্য উš§ুক্ত করে দেয়ার পর আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার সৈয়দপুর এস্টেটের ৪০ একর জমি ‘দৌলতপুর হিন্দু একাডেমী’কে লিয়েনে প্রদান করে। এই ৪০ একর জমির স্বত্ব ছিল সরকারের হাতে। মানব কল্যাণের জন্য ‘হিন্দু একাডেমী’কে তা ব্যবহার করতে দেয়া হয়। ফলে কলেজের মোট ব্যবহার্য জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২ একর (পূর্বে ক্রয়কৃত ২ একর এবং সৈয়দপুর এস্টেট থেকে লিয়েনে প্রাপ্ত ৪০ একর)। সেই সাথে হাজী মুহম্মদ মুহসিনের শিক্ষা তহবিল থেকেও কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিমাসে ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা করে পেতে শুরু করেন। (যা কয়েক দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল) এভাবে ভূসম্পত্তি এবং আর্থিক উভয় ক্ষেত্রেই এ কলেজ হাজী মুহম্মদ মুহসিন প্রতিষ্ঠিত ‘সৈয়দপুর এস্টেটের’ কাছে ঋণী। ব্রজলাল শাস্ত্রী এই ঋণ স্বীকার করেছেন। বর্তমানে কলেজের পশ্চিম পাশে ১ দশমিক ৩২ একর জমি ও কলেজের উত্তর পশ্চিমাংশে ভৈরব নদের তীরে কবিরাজের ঘাট নামক স্থানটির কলেজের সম্পত্তিও ভূমি দস্যুরা দখল করে রেখেছে।
বিএল কলেজের কৃতী শিক্ষার্থীরাঃ গত একশ’ বছরে সরকারি বিএল কলেজে অনেক কৃতী শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই অর্জন করেছেন দেশজোড়া খ্যাতি ও সুনাম। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতিমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি গোলাম মোস্তফা, কবি-নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফর, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমেদ, গবেষক শিবশঙ্কর মিত্র, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ঐতিহাসিক শেখ আব্দুল জলিল, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হাসান আজিজুল হক, অভিনেতা গোলাম মোস্তফা স্থাপতি এম শহীদুল্লাহ, ডাঃ এম এ মানাফ, ডাঃ এম আর খান, ডাঃ বেগ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ প্রমুখ।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনঃ সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও রয়েছে বিএল কলেজের বড় ভূমিকা। দেশের অন্যতম খ্যাতিমান অভিনেতা গোলাম মোস্তফা এ কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও এ কলেজে লেখাপড়া করেছেন সঙ্গীত শিল্পী ভারতী ঘোষ, সঙ্গীত শিল্পী অধ্যাপক অসিত বরণ ঘোষ, ওস্তাদ কালিপদ দাস, অধ্যাপক সাধন রঞ্জন ঘোষ, অধ্যাপক মোঃ আব্দুল করিম প্রমুখ।
এ কলেজের খ্যাতিমান কয়েকজন শিক্ষকঃ খ্যাতিমান শিক্ষকরা বিএল কলেজে শিক্ষাদান করে দেশের শিক্ষা প্রসারে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। এই খ্যাতিমান শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ড. মোহাম্মদ এনামুল হক। যিনি পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া গণিতবিদ অধ্যক্ষ চারু চন্দ বসু, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, প্রফেসর মোঃ শরীফ হোসেন, অধ্যাপক মোঃ মোবাশ্বের আলী, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও রাজনীতি
রাজনীতির অঙ্গনেও সুনাম রয়েছে এ কলেজের শিক্ষার্থীদের। ব্রিটিশ বিরোধী ও মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এ কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজনীতিক হিসেবে যারা দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে আছেন এডভোকেট সৈয়দ নওশের আলী, কমরেড আব্দুল হক, এএফএম আব্দুল জলিল, শ্রী শরৎ চন্দ মজুমদার, এডভোকেট আব্দুল জব্বার, সালাউদ্দিন ইউসুফ, এস এম আমজাদ হোসেন, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, শেখ রাজ্জাক আলী, এম মনছুর আলী, লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এইচ এম এ গাফফার বীর উত্তম,এডভোকেট এনায়েত আলী, সৈয়দ দিদার বখত, এম নুরুল ইসলাম, স.ম বাবর আলী, এডভোকেট ফিরোজ আহমেদ, আসাদুজ্জামান রিপন, জহির উদ্দিন স্বপন প্রমুখ। এদের মধ্যে সৈয়দ নওশের আলী ও শেখ রাজ্জাক আলী জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং শ্রী শরৎ চন্দ মজুমদার, সালাউদ্দিন ইউসুফ, কমরেড রতন সেন, এস এম আমজাদ হোসেন, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, এম মনছুর আলী, লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এইচ এম এ গাফফার বীর উত্তম ও সৈয়দ দিদার বখত বিভিন্ন সময় সরকারের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঢেউ লাগে বিএল কলেজেও। আর এ আন্দোলনে বিএল কলেজের ছাত্রদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। এ আন্দোলনে সেই সময় যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন, কাজী মাহবুবুর রহমান, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী, নুরুল ইসলাম, শেখ রাজ্জাক আলী, এস এম এ জলিল, জিল্লুর রহমান, কাজী নুরুল ইসলাম, গোলাম সারওয়ার, এ কে মোস্তফা, আইনুল হক, মোশররফ হোসেন, আব্দুল করিম, ইনামুল হক, তাহমিদ উদ্দিন প্রমুখ।
0 comments:
Post a Comment