Sunday, August 8, 2010

পানাম নগর

12 comments
সোনারগাঁও ‘পানাম নগর’ নামেও পরিচিত। সোনারগাঁয়ের সঠিক অবস্থান নির্দেশ ও নির্মাণকাল নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। প্রাচীন সুবর্ণ গ্রাম নাম থেকেই প্রাক-মুসলিম যুগে এর গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। তখন সোনারগাঁ ছিল দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক কেন্দ্র। ১৬১০ সালে ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী করা হলে রাজনৈতিক গুরুত্ব হারায় সোনারগা। ফলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে তার যশ ও প্রতিপত্তি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মধ্যযুগীয় সোনারগাঁয়ের পাদপীঠে একাংশকে ঘিরে গড়ে ওঠে পানাম নগর। সে সময় পানাম নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সুতি বস্ত্র তথা বিলাতি থান কাপড়ের বিশাল বাণিজ্য। ফলে সোনারগাঁ আবারও ফিরে পায় তার হারানো ঐতিহ্যের কিয়দংশ। পানাম নগর নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ থানাধীন ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের মোগড়াপারা ক্রসিং থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। ধারণা করা হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে গড়ে ওঠা হিন্দু আমলের রাজধানী শহরটির অবস্থান ছিল বর্তমান পানাম নগরেই। পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা মুসলিম রাজধানী শহরটির অংশবিশেষও ছিল বর্তমান পানাম এলাকায়। কিংবদন্তি আছে, এখানে তৎকালীন মুসলিম শাসকদের আবাসস্থল ছিল। পানাম নগরীতে এখনও মুঘল আমালের তিনটি ইট নির্মিত সেতু রয়েছে"পানাম পুল, দালালপুর পুল ও পানাম নগর এখনও বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে মুঘল ঐতিহ্য। মোগড়াপারা ক্রসিং থেকে নীলকুঠি পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কটি সোনারগাও ও পানাম নগরের একমাত্র প্রাচীন নির্দশন। মূলত ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার ফলে গড়ে উঠেছিল পানাম শহরটি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কিছু ধনবান হিন্দু ব্যবসায়ী স্থায়ীভাবে পানাম নগরে বসবাস করতে শুরু করেন। এখনও টিকে থাকা নগরের বাড়িগুলো ছিল হিন্দু ব্যবসায়ীদের আবাসিক ভবন। পানাম নগরে গড়ে ওঠা ইমারতগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। তখনকার দিনে শৌর্য-বীর্যে পানাম নগরের ধারের কাছেও ছিল না পূর্ববঙ্গের কোনো শহর। নগরের পল্লি বৃদ্ধির কাজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। একক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এ শহরটি গড়ে পাঁচ মিটার চওড়া ও ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটিমাত্র সড়কের দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত। সবগুলো ইমারতের সদর বা সম্মুখভাগ রাস্তার দিকে। ভগ্নপ্রায় অযতেœ লালিত এ শহরে এখনও অবশিষ্ট আছে ৫২টি বাড়ি। নগরের চারপাশ কৃত্রিম খাল পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। বহির্দিক থেকে আকস্মিক কোনো আক্রমণ ঠেকানোর লক্ষ্যে চারপাশ ঘিরে এসব পরিখা খনন করা হয়েছিল। নগরের পশ্চিম পাশ্বস্থ সরু ও খালের ওপরই নির্মিত পানাম নগরে প্রবেশের সেতুটি। এ খালটি আবার উত্তর ও দক্ষিণ পাশের প্রশস্ত খাল দুটিকে সংযুক্ত করেছে। নগরের একটু পূর্বে গেলেই চোখে পরে মেঘনা-মেনিখালীর স্রোতধারা। পানাম নগরে নির্মিত ইমারতগুলো কোথাও পরস্পর বিচ্ছিন্ন আবার কোথাও সন্নিহিত। ইমারতগুলো উত্তরদক্ষিণে বিস্তৃত ও আয়তাকার আর উচ্চতায় এক তলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত। নগরের প্রত্যেকটি বাড়ির পেছনে রয়েছে পুকুর। সে সময় বাড়ির বাসিন্দরা যৌথভাবে এসব পুকুর ব্যবহার করত। নির্মিত প্রত্যেকটি ইমারতের অবয়ব তিনতলা নমুনায় বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। ভবনগুলোর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দিক হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন কারুকার্যের ঝুল বারান্দা, উন্মুক্ত গ্যালারি আর দেউড়ি নির্মাণ। ভবনের ছাদগুলোতে রয়েছে বিশেষ অলংকরণের ছাপ। ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর ব্যতিক্রম অলংকরণের রূপায়িত হয়েছে ইমারতগুলোর অঙ্গসজ্জা। তবে কোথাও কোথাও স্থানীয়, নকশার ছাপও দেখা যায়। পানাম নগরের সব ভবনই ইট নির্মিত। বৈচিত্রসৃষ্টির লক্ষ্যে ভবনের বহির্ভাগে গোলাকার, খিলানাকার চোখা, অর্ধবৃত্তাকার, বক্ররেখা প্রভৃতি প্রকৃতির ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ভবনের অভ্যন্তরভাগের কারুসজ্জায় ব্যবহƒত হয়েছে চিনি টিকরি বা চীনা মাটির বাসনের টুকরো। বহির্ভাগের অলংকরণেও এর কদাচিৎ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পানাম শহরের গড়ে ওঠা ভবনগুলোকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়" মধ্যবর্তী হলঘর সংবলিত ধরন, মধ্যবর্তী অঙ্গন (উঠান) সংবলিত ধরন ও সমন্বিত ধরন সে সময় ভবনের মাঝের হল ঘরকে ব্যবহার করা হতো সংযোগ কেন্দ্র হিসেবে। তাই এগুলোকে নিপুণ কারুকার্যের সহায়তায় অতীব মনোরোম করে তোলা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে পানাম নগরে গড়ে উঠেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাদের সিংহভাগ দেশ ত্যাগ করলে পানাম অনেকটি জনমানবহীন শহরে পরিণত হয়। প্রকৃতির অনিন্দ্যসুন্দর রানী এ ধ্রুপদী শহরটি পরবর্তী সময়ে আপন সৌন্দর্যে আবারও লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। ঘন অরণ্যের চির সবুজ বাংলাদেশ। বর্ষায় কদম তরু, শরতের কালঃ পদ্ম পুকুরে শাপলা ঘেরা হাসছে রাজ হাঁস। মাছের দল ঝাঁক বেঁধে ছোটে। গাঁয়ের ছেলেরা আনন্দউল্লাসে মেতে ওঠে। এ যেন বারবার হৃদয়ে দোলা দেয়া কবি কথারই প্রতিধ্বনি"এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/হাজার দেশের রানী সেজে আমার জন্মভূমি। পানাম নগরের ভগ্নপ্রায় দালানগুলোর দিকে তাকালে যেন মনে হয় সত্যি তাই। হৃদয়ের গহিন থেকে বেরিয়ে আসে আদেশ-আবদারের মিশ্র বজ্রকণ্ঠ­"হে বাংলা তুমি আবারও জেগে ওঠ পানামের মতো। ফিরে আস সুবর্ণ গাঁয়ের সেই শান্তির পরশেঃ।
০০ আল মেহেদী ০০

12 comments:

Post a Comment