Sunday, August 29, 2010

জাতীয় জাদুঘর

0 comments
ঢাকা নগরীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর অবস্থিত। সমকালিন বিশ্বের স্মৃতির মিনার এ মিউজিয়ামের যাত্রা শুরু ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট। শুরুতে এর নাম ছিল ঢাকা জাদুঘর। ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা জাদুঘর থেকে তা জাতীয় জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। এ দীর্ঘ পথ চলায় (১৯১৩-১৯৮৩) রয়েছে তার সুখ-দুঃখের অসংখ্য স্মৃতি। ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা পেলেও এই প্রচেষ্টা শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। ১৮৫৬ সালে ঢাকা নিউজ পত্রিকায় জাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল। অনারারি সেক্রেটারি হিসেবে এ আবেদন জানিয়েছিলেন এস. রবিনসন। এ ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সে সময় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কমিটি গঠন করাসহ বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এরপর মাঝে অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়। ১৯০৯ সালের দিকে শিলং থেকে কিছু মুদ্রা ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু এগুলো সংরক্ষণের জন্য তখন কোনো উপযুক্ত স্থান ছিল না। এ অবস্থায় ১৯১০ সালের ১ মার্চ তৎকালিন ব্রিটিশ সরকারের মুদ্রাতত্ত্ববিধ এইচ. ই স্ট্যাপলটন গভর্নর স্যার ল্যান্সলেট হেয়ারকে ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাব দেন। ১৯১২ সালের ২৫ জুলাই পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হলে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুধীজনদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৩ সালের ২৫ মার্চ সরকার জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি অনুমোদন করে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রভিশনাল জেলারেল কমিটি গঠন করেন। ঢাকার তৎকালিন কমিশনার নিকোলাস ডি বিটসন পদাধিকার বলে এ কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল প্রাথমিকভাবে পুরোনো সচিবালয়ের (বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষে ‘ঢাকা জাদুঘর’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। তবে দর্শকদের জন্য জাদুঘরটি খুলে দেয়া হয় ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট। প্রথমে এর নিদর্শন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৭৯টি। বঙ্গভঙ্গরদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতেই যেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা জাদুঘর। ১৯১৪ সালে নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নলীনিকান্ত ভট্টাশালীকে জাদুঘরের কিউরেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। নলীনী অক্লান্ত পরিশ্রম করে গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন জনপদ ঘুরে অসংখ্য প্রতœসম্পদ সংগ্রহ করেছিলেন। তার একনিষ্ঠ প্রচেষ্ঠার ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই জাদুঘরটি একটি ঐতিহাসিক গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়। ঢাকা জাদুঘরকে পুরোনো সবিচালয় ভবন থেকে ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকার নায়েব নাজিমের নিমতলীসহ প্রাসাদের বারদুয়ারীতে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৩৬ সালে পূর্বের কমিটি বিলুপ্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সভাপতি করে নয় সদস্যের একটা নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত ছিল। ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকা মিউজিয়াম অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠিত হয় এবং ঢাকা জাদুঘর একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে জনচাহিদাসহ নানাদিক বিবেচনায় এনে শাহবাগ এলাকায় জাদুঘরের জন্য আট একর জমির উপর একটি বৃহদাকার স্বয়ংসম্পূর্ণ ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অধ্যাদেশ জারি করে ঢাকা জাদুঘরের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ, নিদর্শন, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শাহবাগসহ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাথে আত্তীকৃত করা হয়। বর্তমানে জাদুঘরের চারতলা ভবনজুড়ে মোট ৪৪টি গ্যালারিতে উল্লেখযোগ্য নিদর্শনের স্থায়ী প্রদর্শনী আছে। বর্তমান জাতীয় জাদুঘরের বিকাশের পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল অধ্যাপক আহমদ হাসান দানী’র। তার কল্যাণেই ঢাকার বনেদী পরিবারের সংগ্রহসমূহ যেমনÑ(তাইফুর আবুল হাসনাত) জাদুঘরের জন্য নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে ১৯৯৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৮২ হাজার ৪৭৫টি নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে। নিদর্শনগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছেÑলালমাই ও ময়নামতি থেকে প্রাপ্ত প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছরের পুরনো প্রস্তর খণ্ড। দিনাজপুরের বান গড়ের ১০ম-১১শ শতাব্দীর বৃষ্টি পাথরের নাগদরজা। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগসাকি শহরে নিক্ষিপ্ত আনবিক বোমার খণ্ডাংশ, অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলো হচ্ছেÑবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা নিদর্শন, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের ব্যবহƒত জিনিস, ঢাকাই মসলিন, সম্রাট শের শাহের আমলের মুদ্রা প্রভৃতি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণাধীন মোট চারটি শাখা জাদুঘর রয়েছে। এগুলো হলো আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, ঢাকা; জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, চট্টগ্রাম; ওসমানী জাদুঘর, সিলেট এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা, ময়মনসিংহ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কথা ভেবে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ১৯৭৯ সালে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এছাড়া ১৯৭৬ সালে জাতীয় জাদুঘরের অধীনে স্কুল কার্যক্রম কর্মসূচি চালু করা হয়। নিদর্শনের প্রকৃতি অনুসারে সমগ্র জাদুঘরকেÑইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা, জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা, সমকালিন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা এবং প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ নামে মোট চারটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। এছাড়া সংরক্ষণ রসায়নাগার ও জনশিক্ষা নামে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আরও দুটি বিভাগ রয়েছে। সংরক্ষণ রসায়নাগার বিভাগে জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন নিদর্শনসমূহকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করার কৌশল শিক্ষা দেয়। আর জনশিক্ষা বিভাগের অধীনে জাদুঘর সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

হাজার রেকর্ড বক্ষে যাহার/ বুক খুলে সে দেখায় তাকে কাছে পেলে মানুষ / নয়ন দুটি জুড়ায়। আমাদের জাতীয় জাদুঘর হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শন তুলে ধরার মধ্য দিয়ে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করেছে। তার মাঝে স্থান পেয়েছে কুরান-পুরাণ থেকে শুরু করে এশিয়া-আফ্রিকাসহ পুরো পৃথিবীর নানা দুর্লভ কীর্তি। জাদুঘরের মতো প্রসারিত হোক আমাদের হৃদয়। সব কিছুর মর্মমূলে জাগ্রত থাকুক মাতৃভূমির চেতনা।
০০ আল মেহেদী ০০

0 comments:

Post a Comment