চারশো বছরেরও বেশি বয়স শহরটির। কিন্তু এর ঐতিহ্যকে হাজার বছরের ঐতিহ্য বলা চলে নিঃসন্দেহে। স্থাপত্য-সংস্কৃতি- সংগীত-রীতি সবকিছুতেই সমৃদ্ধ এই নগর। প্রাচীন ঢাকার আরেক বিস্ময় ছিল এর বস্ত্রশিল্প। 'সিলসিলাতি তাওয়ারিখের' ইতিহাসবিদ সোলায়মান উল্লেখ করেছেন বাংলার একপ্রকার সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র সেখানকার মুসলিম তাঁতিরা বয়ন করেন যা একটি আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে বহন করা যায়।
ঢাকার ঐতিহ্য বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল ঢাকাই বস্ত্রের জন্য। এই বস্ত্রশিল্প মূলত মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ণতা লাভ করেছিল। রকমারি বস্ত্রশিল্পের মাঝে এদেশের চারু ও কারুশিল্পীদের সৃষ্ট আপন মনের মাধুরী মেশানো মসলিন বস্ত্র ছিল প্রধান। মসলিন তার সূক্ষ্মতা ও রমণীমোহন পেলবতার জন্য জয় করে নিয়েছিল সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, নায়েবে নাজিম, শাহজাদা-শাহজাদীদের হৃদয়। সূক্ষ্ম বস্ত্রের জন্য প্রাচীন বাংলার গৌরব ছিল অবশ্য প্রাক-মুসলিম যুগেই। ওই সময়ের ঢাকাই বস্ত্রের ইতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও মধ্যযুগীয় বাংলার মুসলিম সুলতানদের আমলে মসলিন বিষয়ক কথকতা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ত্রয়োদশ শতকে বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যখন সোনারগাঁও আসেন তখন তিনি সোনারগাঁওয়ের মুসলিম তাঁতিদের বয়নকৃত সূক্ষ্ম বস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। চতুর্দশ শতকে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজকরা কংসুলোর নেতৃত্বে সোনারগাঁও, পাণ্ডুয়া ভ্রমণ করেছিলেন। চীনা দূতদের মালদহের আম খাওয়ানোর পাশাপাশি সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র উপহার দেওয়া হয়েছিল। চীনাদের ইতিহাস মিংশরে বাংলার মসলিনের কথা উল্লেখ আছে। চীনা দূতরা বাংলার মুসলিম কারিগরদের বয়নকৃত কয়েক পদের বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এরও আগে আরবীয় বণিক, ঐতিহাসিক সোলায়মানের নবম শতাব্দীতে লেখা 'সিলসিলাতি-তাওয়ারিখের' ইতিহাসবিদ সোলায়মান উল্লেখ করেছেন বাংলার একপ্রকার সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র সেখানকার মুসলিম তাঁতিরা বয়ন করেন যা একটি আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে বহন করা যায়। এ সূত্র থেকেই প্রমাণ মেলে বাংলার মসলিনের নান্দনিক আকর্ষণ হাজার বছর আগেই আরব বিশ্বে পেঁৗছে যায়। সে সময় জেদ্দা, বসরা, মশুল বন্দরেও ব্যবসায়ীদের আরাধ্য বস্ত্র হিসেবে পরিচিতি পায় বাংলার মসলিন। তবে সে সময় বাংলার সূক্ষ্ম বস্ত্র কি নামে পরিচিত ছিল তা জানা যায়নি। সপ্তদশ শতকে ইংরেজদের কাছে ঢাকাই বস্ত্র পরিচিতি লাভ করে 'মসলিন' হিসেবে। ইংরেজরা কেনইবা ঢাকাই বস্ত্রের নাম 'মসলিন' দিয়েছিলেন তার কারণও জানা যায় না। মসলিন গবেষকরা ধারণা করেন ইরাকের 'মোসুল' বন্দরে বাংলার বস্ত্রের উপস্থিতির কারণে বাংলার বস্ত্র 'মসলিন' আখ্যায়িত হতে পারে। বাংলার বস্ত্রের 'মসলিন' নামকরণ যেভাবেই হোক না কেন মসলিনের আকর্ষণীয় ও রুচিস্নিগ্ধ নামের আড়ালে রাজসিক আভিজাত্যের বর্ণাঢ্য ছাপ পাওয়া যায়। মলমল খাস, মলবুস খাস নামক মসলিন ছিল শ্রেষ্ঠ। 'অাঁবে-ই-রওয়া' নামে এক ধরনের উৎকৃষ্ট মসলিন সোনারগাঁও, ঢাকা, জঙ্গলবাড়ি, বাজিতপুর, তিতাবাদির মুসলিম কারিগররা বয়ন করত। 'অাঁবে-ই-রওয়া' ফারসি শব্দ, অর্থ (প্রবাহিত স্বচ্ছ রজতধারা) 'শাবনাম' মসলিনের অর্থ ভোরের শিশির। মলমল খাস, মলবুস খাস, অাঁবে-ই-রওয়া, শাবনাম, ঝুনা, বদনখাস, আলিবালি, শরবন্দ, শরবেত হরেক পদের মসলিন তৈরিতে মুসলিম কারিগরদের সুনাম ছিল। উপরোক্ত বস্ত্রগুলোর বর্ণাঢ্য নামের কারিশমাই প্রমাণ করে এই বস্ত্রগুলো নির্মাণের পেছনে রাষ্ট্রের উঁচুস্তরের লোকজনের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা সর্বোপরি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। এ নামগুলো ছিল মুসলিম রাজন্যদের দেওয়া, তাতে কি সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে। মধ্যযুগীয় ইতিহাসের পণ্ডিত ডঙ্ আবদুল করিম এবং তার পাশাপাশি ইংরেজ ঐতিহাসিকরাও দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেছেন মসলিন বয়ন শিল্পে ঢাকা, সোনারগাঁও, তিতাবাদি, জঙ্গলবাড়ি, ধামরাই, বাজিতপুরের মুসলিম কারিগরদের বিশেষ অবদান ছিল। শুধু মসলিন বয়ন শিল্পই নয়, মসলিন কাপড়কে আকর্ষণীয় ও বর্ণাঢ্য করে তোলার জন্য সোনা-রূপার সূক্ষ্ম কারুকাজের শিল্পীরাও ছিল অধিকাংশ মুসলিম। সুতায় রং করা, রিফু করা, ইস্ত্রি করার কাজেও ঢাকা, সোনারগাঁওয়ের তাঁতিদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষত মলমল খাস, মলবুস খাস মসলিন ছিল দিলি্লর সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের জন্য। 'সরকার-ই-আলী' মসলিন ছিল মুর্শিদাবাদের নবাব ও নায়েবে নাজিমদের জন্য। মসলিনে যত বেশি সুতা থাকত এবং যে মসলিনটি ওজনে হালকা ছিল সে মসলিনই সর্বোৎকৃষ্ট মসলিন হিসেবে বিবেচিত হতো। সম্রাট আওরঙ্গজেবকে একখণ্ড মলমল খাস মসলিন পাঠানো হয়েছিল, যার ওজন ছিল ৭ তোলা এবং ওই সময়ই ওই মসলিনটির মূল্য ছিল ৪০০ টাকা। সুবাদার ইসলাম খান দিলি্লর সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং সম্রাজ্ঞী নূরজাহানকে সোগারগাঁওয়ের খাসনগরের তৈরি ২০ হাজার টাকার 'মলমল খাস' মসলিন পাঠিয়েছিলেন। এসব মসলিন এত সূক্ষ্ম এবং ওজনে এত পাতলা ছিল যে, অধিকাংশ মসলিনের ওজনই ৭ তোলা থেকে ২০ তোলার অধিক হতো না। একবার 'অাঁবে-ই-রওয়া' নামে মসলিনের এক খণ্ড কাপড় প্রাসাদের সম্মুখস্থ জমিনের ঘাসের ওপর শুকাতে দেওয়া হয়েছিল। কোনো এক কৃষকের গাভী মসলিনকে ঘাস মনে করে পুরো মসলিন খণ্ডটিই উদরস্থ করেছিল। নবাব আলিবর্দী খাঁ ওই গাভীর মালিকের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে শহর থেকেই বের করে দিয়েছিলেন। এমনি অনেক রসালো চকমপ্রদ উপাখ্যান মসলিন সম্পর্কে ছড়িয়ে আছে।
*মাহমুদুল হাসান
0 comments:
Post a Comment