Wednesday, August 15, 2012

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মেহেরপুর

0 comments
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল মেহেরপুর জেলার ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে। পরবর্তীকালে এ এলাকাটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এখান থেকেই অস্থায়ী সরকারের ঘোষণা এবং ১৭ এপ্রিল শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের হেডকোয়ার্টার্সও স্থাপিত হয়েছিল এ মুজিবনগরে। তাই এ স্থানটি বাংলাদেশের কাছে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে স্মৃতিসৌধটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল এটি উদ্বোধন করা হয়। স্মৃতিসৌধটি ৩৮ একর জমির ওপর নির্মিত। মূল স্মৃতিসৌধটি ২৩টি কংক্রিটের ত্রিকোণ স্তম্ভ সমন্বয়ে উদীয়মান সূর্যের প্রতিকৃতিতে নির্মিত। স্মৃতিসৌধ ছাড়াও এখানে একটি বিডিআরের সীমান্তফাঁড়ি ও একটি ডাকবাংলো নির্মাণ করা হয়েছে। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের স্থপতি হচ্ছেন তানভীর করিম।
'এই যে ২৩টি সফেদ দেয়াল। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের সংগ্রামী ঐতিহ্যের প্রতীক।' মুজিবনগরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু তোরণ। বঙ্গবন্ধু তোরণ দিয়ে ঢুকেই সাইনবোর্ডে লেখা, বাঁ দিকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানচিত্র আর সোজা স্মৃতিসৌধ। এই স্মৃতিসৌধ উদীয়মান সূর্যের প্রতিকৃতিতে নির্মিত। ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের ওপর মূল বেদিকে কেন্দ্র করে দাঁড়িয়ে আছে ২০ ইঞ্চি পুরু ২৩টি দেয়াল। সমকোণী ত্রিভুজাকৃতির দেয়ালগুলোর উচ্চতা ৯ থেকে ৪২ ফুট। এগুলো দিয়ে বোঝানো হয়েছে উদীয়মান সূর্যরশ্মি।
স্মৃতিসৌধে একটি স্থান সিরামিক ইট দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানেই শপথ গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ। স্মৃতিসৌধের মূল বেদি থেকে বের হওয়ার জন্য রয়েছে ৯টি সিঁড়ি। ৯টি সিঁড়ি ৯ মাস স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতীক। পর্যটক দেখলে সুভাষ মলি্লক এভাবেই মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের কথা জানিয়ে থাকেন। স্মৃতিসৌধের কাছেই তাঁর বাড়ি। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের এখনো জীবন্ত সাক্ষী।

বাঁ দিকের পথে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মানচিত্র। এই পথেই রয়েছে অত্যাধুনিক একটি মোটেল, আধুনিক মসজিদ, সরকারি শিশুপল্লী, শপিং মল, পোস্ট অফিস, ডিজিটাল টেলিফোন এঙ্চেঞ্জ। এ ছাড়া আছে প্রশাসনিক ভবন, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র, প্রাথমিক বিদ্যালয়, আনসার ও ভিডিপি অফিস, রেস্ট হাউস ও ব্যারাক, পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড, অফিস ভবন, বাস টার্মিনাল, হেলিপ্যাড, পিকনিক স্পট, গাড়ি পার্কিং, পাবলিক টয়লেট, লন টেনিস কোর্ট। আরো আছে ছয় দফার ভিত্তিতে ছয় ধরনের ছয়টি বিশাল বাহারি গোলাপ বাগান। সবকিছু দেখে মনে হবে মুজিবনগর কমপ্লেঙ্ ছোট একটি সাজানো গোছানো আধুনিক শহর। এভাবেই পিচঢালা পথে হাঁটতে হাঁটতে গোলাপ বাগানের পাশে পাবেন কয়েকটি চায়ের দোকান।

তার পাশেই 'মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানচিত্র'। সেক্টর-ভিত্তিক গড়ে তোলা হয়েছে এই মানচিত্র। ২০০১ সালে ৪৫ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকার প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পায়। প্রায় ৬৬ একর জায়গার পুরো কমপ্লেঙ্টি।

মানচিত্রের চারপাশে গ্যালারি। গ্যালারির ওপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে হয়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ১১টি সেক্টরে ভাগ করা ছাড়াও আছে ঐতিহাসিক ঘটনাচিত্র, মানচিত্রে যুদ্ধকালে দেশের চারটি পথ দিয়ে শরণার্থী গমন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস, আ স ম আবদুর রবের পতাকা উত্তোলন, শাজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ, শালদাহ নদীতে যুদ্ধ, কাদেরিয়া বাহিনীর জাহাজ দখল ও যুদ্ধ, শুভপুর ব্রিজে সম্মুখযুদ্ধ, কামালপুর ও কুষ্টিয়ার মিরপুরের যুদ্ধ, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস, পাহাড়তলী ও রাজশাহীর হত্যাযজ্ঞ, জাতীয় শহীদ মিনার ধ্বংস, সচিবালয়ে আক্রমণ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংস, পিলখানা আক্রমণ, রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ভাস্কর্য।

মানচিত্রের চারপাশে আছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাত্রি, অগি্নসংযোগ, পাকিস্তানি বাহিনীর নারী নির্যাতন, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, ১২ আনসার কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার এবং সেক্টর বণ্টনসহ অরোরা নিয়াজি ও এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভাস্কর্য।

মুজিবনগর কমপ্লেঙ্কে আরো সুন্দর করে তুলতে ১৯৯৯ সালে বন মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ পরিকল্পনা নেয়। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয় ছয়টি গোলাপ বাগান। এক কোটি ৫৫ লাখ টাকায় আনা হয় ছয় প্রজাতির দুর্লভ জাতের জাপানি গোলাপগাছ। এক নম্বর বাগানে লাগানো হয় শোভাবর্ধনকারী হরেক দেশীয় ফুলগাছ। সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী দুই হাজার ৩০০ গোলাপের গাছ দিয়ে বাগানটি তৈরি হয়। ২০০১ সালের এপ্রিলে বাগানটি পরিচর্যার জন্য ১২ কর্মচারী নিয়োগ দেয় বন মন্ত্রণালয়। ২০০৪ সালের ১ জুলাই প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে যায়। কিন্তু কর্মচারীদের চাকরি রাজস্ব খাতে অর্ন্তভুক্ত না হওয়ায় বেতনও বন্ধ হয়ে যায়। পরিচর্যার অভাবে বাগানের অনেক ফুলগাছ মরে গেছে। একটা সময় বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতো দর্শনার্থীরা, আর এখন কেউ ঘুরেও তাকায় না।

0 comments:

Post a Comment