হঠাৎ হঠাৎ কিছু গান আমাদের মাথায় ঘুরতে থাকে। ঘুরেফিরে সেই গানটিই মাথার মধ্যে বারবার বাজতে থাকে। এমন অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। কিন্তু কেন এমন হয়, তা অনেকের কাছেই এক রহস্য। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, কেন এমন হয়? কেন কিছু গান আমাদের মনে গেঁথে যায়? এখনো এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা পরিচালিত না হলেও উত্তর হিসেবে প্রাথমিক কিছু অনুমান দাঁড় করিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ ব্যাপারটিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে আখ্যায়িত করছেন তাঁরা। কারও কারও মতে, মানুষের প্রজাতি হিসেবে বিবর্তনের সঙ্গে এর রয়েছে গভীর সম্পর্ক।
লন্ডনের গোল্ডস্মিথ কলেজের অধ্যাপক ভিকি উইলিয়ামস দুই বছর আগে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তিনি দেখেছেন, বিজ্ঞানীরা বিগত সময়ে একে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেছেন—‘মনে গেঁথে যাওয়া লক্ষণ’, ‘আঠালো সংগীত’, ‘সৃজনশীল অস্থিরতা’ প্রভৃতি। তবে কিছু গান মাথায় ঘুরতে থাকার বিষয়কে খুব সাধারণভাবে ‘কানপোকা’ বলে অভিহিত করেন অনেকে। এটা আক্ষরিক অর্থে কানের কোনো পোকা নয়। যে গানগুলো বেশির ভাগ মানুষের মনে গেঁথে যায়, সেগুলো বিবেচনা করা হয় ‘কানপোকা’ হিসেবে। সংগীত মনোবিজ্ঞানী উইলিয়ামস এ ধরনের প্রায় ২ হাজার ৫০০টি ‘কানপোকা’ গানের তালিকা করেছিলেন, এগুলোর ধরন বোঝার জন্য। কিন্তু তাতে খুব বেশি কাজ হয়নি।
একই গানের কথা একাধিক ব্যক্তি খুব কমই বলেছে। এ থেকে বোঝা যায়, একেকজনের ক্ষেত্রে একেকটা গান ‘কানপোকা’ হিসেবে কাজ করে। তবে কোন পদ্ধতিতে কিছু গান মানুষের মনে গেঁথে যায়, তার কিছুটা অনুমান দাঁড় করিয়েছেন উইলিয়ামস। তিনি কিছু সাধারণ প্রভাবক শনাক্ত করেছেন।
প্রথমত, উইলিয়ামসের মতে, প্রথম শোনা কোনো একটি গান একজন মানুষের মাথায় গেঁথে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, একই গান অনেকবার শোনা হলে সেটিও ‘কানপোকা’র ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু অনেক সময় দীর্ঘদিন শোনা হয়নি, এমন কোনো গানও আচমকা মাথায় ঘুরতে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের অনুমান, হয়তো পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে গানটি মাথায় চলে আসে। উইলিয়ামস বলেছেন, ‘একদিন অফিসে একটা পুরোনো জুতার বাক্সের দিকে আমার নজর পড়ে। জুতার দোকানটির নাম ছিল “ফেইথ’। আর “ফেইথ” শব্দটি দেখেই আমার মাথায় চলে এসেছিল জর্জ মাইকেলের “ফেইথ” শিরোনামের গানটি। তারপর দীর্ঘক্ষণ গানটি আমার মাথায় ছিল।’ সদ্য-প্রকাশিত অনেক গানও কানপোকার ভূমিকা নিতে পারে।
কেন এমন হয়—এ প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান দিতে উইলিয়ামস বলেছেন, হয়তো এই মনে গেঁথে যাওয়া গানগুলো মানুষের ‘অজ্ঞাত স্মৃতি’র একটা অংশ। স্মৃতির এ অংশের কারণে হঠাত্ করে আমাদের কোনো বিশেষ খাবার খেতে ইচ্ছে হয় বা বহুদিন না-দেখা কোনো বন্ধুর কথা মনে পড়ে। এ ছাড়া সংগীত মানুষের খুবই ব্যক্তিগত ও আবেগগত বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত। এটি মানুষের মস্তিষ্কে বেশ কিছু পথে সংকেতবদ্ধ হয়ে থাকে, যার কারণে প্রাসঙ্গিক অনেক স্মৃতির সঙ্গে গানগুলোও জড়িয়ে থাকে।
অন্য গবেষকদের মতে, এ ঘটনার সঙ্গে বিবর্তনের সম্পর্ক আছে। আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল প্রায় দুই লাখ বছর আগে। কিন্তু লিখিত ভাষা আবিষ্কৃত হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার বছর হলো। এর আগে দীর্ঘসময় মানুষকে সবকিছু মুখস্থ রাখতে হতো। এই মনে রাখার কাজটা সহজ করার জন্য তারা গান, ছড়া ও সুর ব্যবহার করত। মন্ট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল লেভিটিন বলেছেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে আমাদের অনেক তথ্য স্মরণ রাখতে হয়েছে—কোন খাদ্য বিষাক্ত, কোনটা বিষাক্ত নয়; কীভাবে প্রাথমিক চিকিত্সার মাধ্যমে ক্ষত সারাতে হয় প্রভৃতি অনেক ধরনের তথ্য।’ শুধু আদিম যুগে নয়, আজকের দিনেও পৃথিবীতে অনেক সংস্কৃতিতে এই শ্রুতিনির্ভর মৌখিক চর্চার চল বিদ্যমান। মানুষের ইতিহাসের অনেকটা সময় ধরে এই ছড়া-গান-ছন্দের মাধ্যমে তথ্য মনে রাখার অভ্যাসের কারণে গানগুলো মাথায় গেঁথে যাওয়ার ব্যাপারটি ঘটে বলে মনে করেন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা।
0 comments:
Post a Comment